সাব্বির আহমেদ
আমাদের শিক্ষার শুরুটা হয়েছে পিটুনির মাধ্যমে। পড়াশেখার জন্য বাড়িতে বাবা-মায়ের পিটুনি। স্কুল-মাদ্রাসায় স্যার-হুজুরের পিটুনি। সেটি যেনতেন পিটুনি নয়। তখনকার অভিভাবকদের ভাষায়- ‘শুধু পরাণাটা থাকলে হলো, হাড্ডি-মাংস লাগবে না।’ এসব কথায় উৎসাহ পেয়ে শিক্ষকরাও দ্বিগুণ উৎসাহে নেমে পড়তেন মাইর উৎসবে! অনেক সময় মারের চোটে শরীরের এমন অবস্থা হতো- কাপড়-চোপড় রাখাই দায় হতো। ব্যথার জায়গায় মলম লাগিয়ে শুয়ে পড়া ছাড়া উপায় ছিল না। স্যারের মারের চোটে ক্লাস পালাতে হতো।
এসব উদাহরণগুলো এই কারণে দেওয়া যে, তখনকার সময়ে শ্রেণিকক্ষে এসব পিটুনিকে অভিভাবকরা কিছু মনে করতেন না এবং ভাবতেন সন্তানের ভালোর জন্যই শিক্ষকের অধিকার রয়েছে এমন পিটুনি দেওয়ার। আবার প্রতিটি ক্লাসে দুষ্টু, ইঁচড়েপাকা, বেয়াদব টাইপের কিছু ছাত্র থাকত। এরা ক্লাস ক্যাপ্টেনের কথা শুনত না, ক্লাসে গোলমাল করত, শিক্ষকদের সালাম দিত না, ক্লাসেও আসত না; আবার সিনেমা হলে যেত, লুকিয়ে বিড়ি ফুঁকত। এদের যদি কখনো কোনো অপরাধে শিক্ষকরা বাগে পেতেন তবে জব্বর মাইরের দৃশ্যটা হতো দেখার মতো!
যে শিক্ষকরা আমাদের এভাবে বেদম মাইর দিতেন তাদের এখনো আমরা মনে করি জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। আমি বলছি না শিক্ষকের পিটুনি ভালো কী খারাপ। সেটা নিয়ে তর্ক থাকতেই পারে। অতিরিক্ত পিটুনি নিশ্চয় খারাপ। বর্তমানে শ্রেণিকক্ষে ছাত্রদের পেটানো আইনত নিষিদ্ধ। সেটা ভিন্ন বিষয়। এই সময়ে এসে শিক্ষকদের মর্যাদা লুণ্ঠিত হচ্ছে পদে পদে। উল্টো শিক্ষার্থীরা চড়াও হচ্ছে শিক্ষকের ওপর। বেতন-ভাতা বাড়ানোর দাবিতে প্রধানমন্ত্রী কিংবা শিক্ষামন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দিতে গিয়ে পুলিশের বেধড়ক পিটুনিতে রাস্তায় আহত হতে হচ্ছে শিক্ষকদের।
আগেকার সেই সম্মান, মূল্যবোধ কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। যেই শিক্ষককে মহান বলে জানতাম, যারা জাতির মেধা ও মননের এবং মানুষ তৈরির কারিগর তারা যেন আর নেই। পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্যবই থেকে মুছে ফেলা হয়েছে কাজী কাদের নেওয়াজের ‘শিক্ষা গুরুর মর্যাদা’ নামের কবিতাটি। যে কবিতা পড়ে শ্রেণি কক্ষে আমাদের এক শিক্ষক কেঁদেছিলেন। বুঝিয়েছিলেন সমাজে শিক্ষকের মর্যাদা কতটুকু। এই কবিতায় আমাদের উপলব্ধি করতে শিখিয়েছিল শিক্ষকের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ। শিক্ষক দেখলে আদব-কায়দা কেমন হওয়া উচিত। কবিতাটিতে দিল্লির বাদশাহ আলমগীর শিক্ষককে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘পুত্র আমার আপনার কাছে সৌজন্য কি কিছু শিখিয়াছে? বরং শিখেছে বেয়াদবি আর গুরুজনে অবহেলা!’ কথাটি তিনি এই কারণে বলেছিলেন, একদা বাদশাহ দেখতে পেলেন যে, ছেলে শিক্ষকের পায়ে পানি দিচ্ছিলেন আর শিক্ষক হাত দিয়ে পা ধৌত করছিলেন। বাদশাহর প্রশ্ন ছিল, কেন ছাত্র হাত দিয়ে পা ধুয়ে দেবে না?
মনে পড়ে শিক্ষকের কতই না সেবা করেছিলাম। কখনো শিক্ষক কোনো অন্যায় দেখে ফেলবেন এই ভয়ে তটস্থ থাকতাম। তাই শিক্ষকদের সম্মানহানি হতে দেখলে কষ্টই লাগে। শিক্ষকদের এই মর্যাদা কমার পেছনে, কিন্তু শিক্ষকরাও কম দায়ী নয়। বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গনে পড়ানোর চেয়ে দলাদলিতে ব্যস্ত, দুই পক্ষের মধ্যে মারামারির ঘটনাও ঘটেছে। কোচিং বাণিজ্য, প্রশ্নপত্র ফাঁস থেকে শুরু করে নানা অপকর্মে জুড়ে যাচ্ছে শিক্ষকদের নাম। যে শিক্ষককে আমরা চিনতাম জ্ঞানের আলোকবর্তিকা হিসেবে, সমাজের সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠ হিসেবে তারাই আজ নিজের চাওয়া-পাওয়ার কাছে এতটাই পরাজিত যে, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতাও ভুলতে বসেছেন। কাজী কাদের নেওয়াজের সেই শিক্ষকের মতো গলা উঁচু করে বাদশাহর সামনে বলতে পারেন না-
‘আমি ভয় করি না’ক, যায় যাবে শির টুঁটি,
শিক্ষক আমি শ্রেষ্ঠ সবার।
দিল্লীর পতি সে তো কোন ছার,
ভয় করি না’ক, ধারি না’ক ধার, মনে আছে মোর বল,
বাদশাহ্ শুধালে শাস্ত্রের কথা শুনাব অনর্গল।
যায় যাবে প্রাণ তাহে,
প্রাণের চেয়েও মান বড়, আমি বোঝাব শাহানশাহে।
লেখক : অধ্যাপক, চরনদ্বীপ রজভীয়া ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসা, বোয়ালখালি চট্টগ্রাম
বি. দ্র। উপরের মতামতের দায় সম্পূর্ণ লেখকের ওপর বর্তায়, এই লেখা লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব মতামত বিধায় লেখাটির কোনো দায়-দায়িত্ব দৈনিক অধিকার বহন করবে না।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড