শামসুল আরেফীন
বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে নতুন জ্ঞান সৃষ্টির পাঠশালা। একটি দেশ, তার সংস্কৃতি, তার সভ্যতা, তার উত্থান এবং পতন এবং সমৃদ্ধির ইতিহাস রচনা কল্পে বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে সবচেয়ে কার্যকরী প্রজেক্ট। এ কারণেই পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু বলেছিলেন, ‘দ্য কান্ট্রি ইজ গুড ইফ ইটস ইউনিভার্সিটিস আর গুড (The country is good if its universities are good)।’
পৃথিবীজুড়ে প্রায় ২৬ হাজারের মত বিশ্ববিদ্যালয় আছে (দৈনিক শিক্ষা, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৯)। কিন্তু খুব কম সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয়ই আছে যার একটি দেশকে নেপথ্যে থেকে জন্ম দেওয়ার ইতিহাস রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ড আমাদের সেই গর্ব এবং অহংকারের জায়গা। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টির নেপথ্যেই ঐতিহাসিক অনুকল্পের দেখা মেলে। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার পরে ঢাকা হারায় রাজধানী হওয়ার গৌরব। এর ফলে পূর্ববঙ্গের মুসলিম সমাজে যে নবজাগরণ সৃষ্টি হয় এবং একটি মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ঘটে তার বিকাশ ঘটে ১৯২১ সালে এ উপমহাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।
সেই থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ৪৫ টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে (ইউজিসি, ২০১৯)। তন্মধ্যে ৪ টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচালিত হয়ে আসছে। সেই অ্যাক্টের ২৫ তম ধারায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘The Academic Council shall be the academic body of the University, and shall, subject to the provisions of this Order, the Statutes and the University Ordinances, have the control and general supervision over, and be responsible for maintenance of standards of, instruction, education and examination within the University, and shall exercise such other powers and perform such other duties as may be conferred or imposed upon it by the Statutes. It shall have the right to advise the Syndicate on all academic matters।’ অর্থাৎ, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় দেখভালের সিদ্ধান্ত নিবে। বাকি ৪১ টা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে প্রচলিত আছে স্ব স্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের রেগুলেটরি রুলস যেখানে প্রয়োজন সাপেক্ষে লেখাপড়ার গুনগত মান বৃদ্ধির জন্য সরকার দিকনির্দেশনা দিতে পারবে।
বিগত কয়েক দশক ধরেই এদেশে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ১৯৭২ সালের কুদরত ই খুদা শিক্ষা কমিশন থেকে শুরু করে ২০১০ সালের কবির চৌধুরীর শিক্ষা কমিশন কোনোটিই শিক্ষাক্ষেত্রে যে সংকট তৈরি হয়েছে তার সুরাহা করতে পারেনি। বরং এদেশে এখনও প্রাথমিক স্তরে ১৪ ধরনের শিক্ষা কার্যক্রম চালু আছে।
উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে গত এক দশকে এদেশে ন্যূনতম নতুন ১২টি বিশ্ববিদ্যালয় যোগ হয়েছে। দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রায় ১০০ টির ও অধিক। তবুও উচ্চ শিক্ষায় প্রতিবন্ধকতার শেষ নেই। আর এই প্রতিবন্ধকতা দূর কল্পেই গত এক দশক ধরে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি “অভিন্ন শিক্ষক নিয়োগ এবং পদোন্নতির নীতিমালা” তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার মান ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে বৈষম্যের কথা উল্লেখ করে ২০১৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের ১৪৮তম সভায় গৃহীত হয় “অভিন্ন শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা” যা তাদের ওয়েবসাইটে ২০১৮ সালের ২২ জানুয়ারি প্রকাশিত হয়েছে এবং সম্প্রতি ২৫ আগস্ট, ২০১৯ শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির নেতৃত্বে শিক্ষা মন্ত্রণালয় নীতিমালাটা পাশ করে তা চূড়ান্তকরণের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য রেখেছে (দৈনিক শিক্ষা, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৯)।
ইউজিসির এ উদ্যোগের খবর প্রকাশ হওয়ার পর থেকেই সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মাঝে ক্রমে অসন্তোষ বাড়ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই প্রতিবাদে সোচ্চার হচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগে অভিন্ন নীতিমালাকে কালাকানুন অভিহিত করে তা প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ফোরাম।
নীতিমালার বিরোধিতা করে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ফোরাম বলেছে, ওই খসড়া নীতিমালা অনুমোদন করা হলে তা হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের পরিপন্থী। সংগঠনটি বলেছে, ভৌগোলিক অবস্থান, ইতিহাস-ঐতিহ্য, বিদ্যমান অবকাঠামো-ইত্যাদি দিক দিয়ে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। অথচ নীতি নির্ধারকদের মাঝে অনেকেই এই স্বাভাবিক বিষয়টাকে অস্বাভাবিক ভাবছেন এবং অভিন্ন নীতিমালার প্রস্তাব করেছেন।
ইউজিসির অবস্থানের বিরোধিতা করে ফোরাম বলছে, অভিন্ন নীতিমালা না করে বরং সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলে আলোচনার মাধ্যমে একটি ‘যুগোপযোগী বাস্তব নীতিমালা’ করা উচিত। ফোরামের এই মতামতের প্রতি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক, সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক পদের দুই হাজারের বেশি শিক্ষকের সমর্থন রয়েছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষকদের এ ফোরাম (দৈনিক জনকণ্ঠ, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৯)।
এ ছাড়া বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিসহ বিভিন্ন শিক্ষক সমিতি এই অভিন্ন নীতিমালাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে অভিন্ন নীতিমালায় এমন কি আছে যার জন্য বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাই এরকম সরব ভূমিকা রাখছেন ? ইউজিসির ওয়েবসাইটে দেওয়া নীতিমালাটি যদি আমরা বিশ্লেষণ করি তবে দেখতে পারবো মূলত তিনটি বিষয়ে অসংগতি শিক্ষক সমাজের চোখে পড়েছে।
প্রথমত, নীতিমালায় দেখা যাচ্ছে বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রভাষক পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রার্থীর এসএসসি এবং এইচএসসি (৫.০০ স্কেলে ন্যূনতম ৪.৫০) এবং স্নাতক এবং স্নাতকোত্তরের (৪.০০ স্কেলে ন্যূনতম ৩.৫০, কলা ও চারুকলা অনুষদে যেকোনো একটিতে ন্যূনতম ৩.২৫) প্রাপ্ত শিক্ষাগত যোগ্যতাকে স্ট্যান্ডার্ড ধরা হচ্ছে। এমফিল এবং পিএইচডি ডিগ্রি থাকলে সেটা অতিরিক্ত যোগ্যতা বলে বিবেচিত হচ্ছে এবং একারণে উপরে উল্লেখিত যোগ্যতার কোন শর্তই শিথিল যোগ্য নয়। দ্বিতীয়ত, নীতিমালায় দেখা যাচ্ছে বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সহকারী অধ্যাপক পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রার্থীর পূর্বে উল্লেখিত যোগ্যতার সাথে সাথে স্বীকৃত কোন জার্নালে (পিয়ার রিভিউড) ন্যূনতম ৩টি প্রকাশনা থাকার কথা বলা হচ্ছে। তৃতীয়ত, নীতিমালায় আরও বলা হচ্ছে যে, চাকরিজীবনে একজন শিক্ষক সর্বোচ্চ দুইবার আপগ্রেডেশনের জন্য আবেদন করতে পারবেন।
নিঃসন্দেহে যে ছাত্র কিংবা ছাত্রীর এসএসসি এবং এইচএসসি এবং স্নাতক এবং স্নাতকোত্তরের ফল ভালো সে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার অধিক দাবিদার। এক্ষেত্রে আমার প্রশ্ন হল, এদেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য চলমান যোগ্যতার সাথে এই যে এসএসসি এবং এইচএসসির বেঁধে দেওয়া যোগ্যতা সাংঘর্ষিক নয় কি? ধরুন একজন শিক্ষার্থী, এসএসসিতে জিপি এ ৪.০০ এবং এইচএসসি তে জিপিএ ৫.০০ পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো এবং স্নাতক এবং স্নাতকোত্তরের উভয় পরীক্ষায় রেকর্ড সংখ্যক মার্কস পেয়ে ১ম হল। এই নীতিমালার শর্ত অনুযায়ী এরকম শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার যোগ্য প্রার্থী কি? বিশ্ববিদ্যালয় প্রথমে যেকোনো ছাত্র কিংবা ছাত্রীকে ন্যূনতম যোগ্যতা সাপেক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ করে দিচ্ছে। আবার উক্ত শিক্ষার্থীই যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ ফল করলো, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ই বলে দিচ্ছে, “দুঃখিত, তুমি আমাদের এখানে শিক্ষক হওয়ার জন্য উপযুক্ত নও।’’
আরেকটি বিষয়, বলা হচ্ছে প্রভাষক নিয়োগের ক্ষেত্রে এমফিল এবং পিএইচডি ডিগ্রি অতিরিক্ত যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হবে। তার মানে কারো অনার্স মাস্টার্সে কাঙ্ক্ষিত ফল না থাকলে যতই তার পিএইচডি কিংবা ভালো পাবলিকেশন থাকুক না কেন সে প্রভাষক হওয়ার যোগ্যতা রাখে না।
এবার আসি প্রতিবেশী দেশ ভারতে কিভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। সে দেশে, অ্যাকাডেমিক ফলে যদি ৩০ মার্ক দেয়া হয়, তবে বাকী ৭০ ভাগ থাকে প্রার্থীদের প্রকাশিত গবেষণা সাময়িকীর উপর, গবেষক হিসেবে অভিজ্ঞতার উপর। এই নম্বর দেয়াটি প্রার্থীদের মধ্য থেকে জার্নাল বা সাময়িকীগুলোতে প্রকাশিত গবেষণাপত্র সাইটেশন, ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টরগুলোর যোগফলের উপর নির্ভর করে। এন্ট্রি পদে নিয়োগ পেতে হলে যেখানে মাস্টার্স ডিগ্রি ও সিজিপিএকে মোক্ষম ধরা হচ্ছে।
সেখানে বাইরের দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে গেলে প্রার্থীকে অবশ্যই পিএইচডি ডিগ্রি বাধ্যতামূলক করে দেয়া হয়েছে। বড় দেশগুলোর কথা বাদ দিলাম, এই এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে যেমন ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান, মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলোতে পিএইচডি ও প্রকাশিত গবেষণাপত্রের মানকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। পৃথিবীর সেরা একটি বিশ্ববিদ্যালয় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক পর্যন্ত নিয়োগ প্রক্রিয়ার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিন (https://academicpositions.harvard.edu/postings/9213) দেখবেন, সেখানে অ্যাকাডেমিক পদ পাওয়ার জন্য প্রার্থীদের যোগ্যতার খাতায় বলা হয়েছে- Candidates must hold a PhD and/or MD degree. অর্থাৎ প্রার্থীকে অবশ্যই পিএইচডিধারী হতে হবে। এর বাইরে বলা হয়েছে, Strong research record and a commitment to undergraduate teaching and graduate training. অর্থাৎ শিক্ষকতার জন্য শক্তিশালী অঙ্গীকার ও প্রশিক্ষণ থাকতে হবে (বিডিনিউজ২৪কম, ২০১৯, লিখেছেন নাদিম মাহমুদ, জাপানের ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত)।
আরেকটি বিষয়, নীতিমালায় বলা হচ্ছে প্রভাষক হতে সহকারী অধ্যাপকে প্রমোশনের জন্য প্রার্থীর স্বীকৃত জার্নালে ৩টি প্রকাশনা থাকতে হবে। কিন্তু স্বীকৃত জার্নাল বলতে এখানে কি বোঝানো হচ্ছে সেটি কিন্তু স্পষ্ট নয়? তাহলে দেখা যাচ্ছে দেশীয় কিংবা আন্তর্জাতিক যেকোনো স্বীকৃত জার্নাল হলেই প্রার্থী প্রমোশন লাভের জন্য বিবেচিত হবে। সবচেয়ে যে বিষয়টি নিয়ে শিক্ষক সমাজ উদ্বিগ্ন সেটা হচ্ছে, একজন শিক্ষক চাকরি জীবনে সর্বোচ্চ দুইবারের বেশি আপগ্রেডেশনের জন্য বিবেচিত হবেন না। তার মানে কেউ যদি সরাসরি প্রভাষক পদে যোগদান করে তাহলে দুইবার আপগ্রেডেশন পেয়ে সহযোগী অধ্যাপক হয়েই তাকে অবসরে যেতে হবে। যা কিনা উক্ত নীতিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
যেখানে বলা হচ্ছে, কারও যদি সরাসরি প্রভাষক হিসেবে যোগদান করার পরে ১২ বছরের সক্রিয় শিক্ষকতা কালসহ ১৩টি পাবলিকেশন এবং পিএইচডি ডিগ্রি থাকে এবং সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ন্যূনতম ৫ বছরের শিক্ষকতা করার অভিজ্ঞতা থাকে তবেই তিনি অধ্যাপক হওয়ার জন্য বিবেচিত হবেন। তার মানে হচ্ছে নীতিমালা অনুযায়ী, সকল যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও একজন শিক্ষক তখনই অধ্যাপক হতে পারবেন যদি শূন্য আসন না থাকে। এক্ষেত্রে অধ্যাপক হওয়ার যোগ্যতা শুধুমাত্র কারো পিএইচডি, কিংবা পাবলিকেশন নয়, শূন্য আসন না থাকা এবং সেই সাথে উপাচার্য এবং প্রশাসনের সাথে তেলবাজি করা।
এদেশে উচ্চ শিক্ষার হালচাল যে ভঙ্গুরে তা তো অস্বীকার করার নয়। পরিবারতন্ত্র, অর্থ তন্ত্র, আর রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কাছে বিপর্যস্ত শিক্ষক নিয়োগ। সেই সাথে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে অপর্যাপ্ত বাজেট। ইউনেস্কোর চাওয়া হলো, শিক্ষা খাতে বরাদ্দ হবে জাতীয় বাজেটের কমপক্ষে ২০ শতাংশ এবং জিডিপির ৬ শতাংশ। কিন্তু বাংলাদেশ এখনো সেই লক্ষ্যমাত্রা থেকে দূরে অবস্থান করছে। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) ই-৯ ভুক্ত দেশসহ ১৪টি দেশের শিক্ষা খাতের বরাদ্দের তথ্য তুলে ধরেছে। সেটি তুলনা করে দেখা গেছে, শিক্ষা খাতে বরাদ্দের হারের দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান পেছনের দিকে। যেমন নেপালে শিক্ষা খাতে ২০১৭ সালে বরাদ্দ ছিল জাতীয় বাজেটের প্রায় ১৬ শতাংশ। একই বছর শ্রীলঙ্কায় তা ছিল প্রায় ১৫ শতাংশ। আবার ইরানে ২০ শতাংশের বেশি। এমনকি আফগানিস্তানে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ১৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ। আর ইন্দোনেশিয়ায় ২০১৫ সালেই শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ২০ দশমিক ৫০ শতাংশ। ভারতে ২০১৩ সালে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল ১৪ শতাংশের বেশি (দৈনিক প্রথম আলো, ১২ জুন ২০১৯)।
তাহলে সমাধানের পথ কি?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শরীফ মজুমদার একটি ভালো সমাধানের পথ বাতলে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের (Springer, Elsevier, World Scientific, Taylor Francis, John Wiley ভিত্তিক মানদণ্ড) মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। একটি সংস্কার সরকার স্বায়ত্তশাসনের প্রতি সম্মান রেখেও করতে পারে। তা হল, শুধু প্রভাষক ও সহকারী অধ্যাপক হিসেবে স্থানীয় বা কন্টিনেন্টাল জার্নালে প্রকাশনা যথেষ্ট হতে পারে; কারণ প্রাথমিক দুই ধাপ পদোন্নতি না পাওয়াটা আমাদের অর্থনৈতিক বাস্তবতায় অমানবিকই বটে। কিন্তু পরের দুই ধাপে অর্থাৎ সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক পর্যায়ে পদোন্নতি স্থানীয় বা কন্টিনেন্টাল জার্নালে নির্দিষ্ট সংখ্যক গবেষণা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সেই আন্তর্জাতিক আউটলেটগুলোয় অন্তত একটি একটি করে দুটি গবেষণা প্রকাশ বাধ্যতামূলক করা উচিত (দৈনিক যুগান্তর, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫)।
অভিন্ন শিক্ষক’ নিয়োগ আইডিয়া মোটেই খারাপ কিছু নয়। তবে যে প্রস্তাবনা আসতে যাচ্ছে, সেটি কখনো বাস্তবতার নিরিখে হচ্ছে না। একজন শিক্ষক নিয়োগে সবচেয়ে কম যে যোগ্যতা হওয়া উচিত তা হলো- তার পিএইচডি ডিগ্রি আছে কিনা সেটি দেখা এবং দ্বিতীয় যোগ্যতা যেটি থাকা উচিত তা হলো- প্রকাশিত গবেষণাপত্রের সংখ্যা।
খসড়ায় প্রকাশিত গবেষণাপত্রের কথা বলা হলেও সেটির মানের বিষয়ে কোন কিছু বলা হয়নি। আর এইজন্য দরকার সরকারের যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত। আজকে যদি দেশেই গবেষণার খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে দেওয়া যায়, তাহলে যে ছেলেগুলো থিসিস করে শিক্ষক হচ্ছে, তাদেরকে পিএইচডি করেই শিক্ষক হিসেবে নেওয়া কঠিন কিছু হবে না। আরেকটি দরকারি কথা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে শিক্ষকদের যে মর্যাদা এবং আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে তা ফিরিয়ে আনতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুল সাধারণ শিক্ষক যে বেতন পান তা জীবনধারণের সাধারণ মানের জন্যও যথেষ্ট নয়। একটি চাকরি, যেখানে আর কোনো লজিস্টিক সাপোর্ট নেই, পর্যাপ্ত আবাসন ও পরিবহন সুবিধা নেই, ব্যক্তিগত স্টাফ না থাকার কারণে প্রয়োজনীয় ফটোকপি থেকে শুরু করে একটি চিঠিও নিজ হাতে নিকটবর্তী পোস্ট অফিসে দিয়ে আসতে হয়, সেই চাকরিতে বেতন যদি সাধারণ চাকুরেদের মতো হয় তাহলে জ্ঞানের মতো উচ্চতর সেবা আশা করা বাতুলতা। সেখানে গবেষণা তো সুদূর পরাহত।
অষ্টম বেতন স্কেলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদেরকে যেভাবে আগের প্রাপ্য বেতন থেকেও দুধাপ নিচে বেতন প্রস্তাব করা হয়েছে তা কোনোভাবেই তাদের মেধা, যোগ্যতা ও অবদানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, এটি চূড়ান্ত অপমানজনক। সিনিয়র সচিব ও কেবিনেট সচিবের পদ বিবেচনা করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের পদের অবনমন ঘটেছে অন্তত চার ধাপ। কোনো পেশার মর্যাদা অবনমন মানে হচ্ছে সমাজে এটি অপ্রয়োজনীয় এমন বার্তা প্রদান। এই বার্তা গোটা সমাজের মূল্যবোধ, চেতনা ও অগ্রগতির দিক থেকে নেতিবাচক একটি বিষয়। সুতরাং, রাষ্ট্রকেই রাষ্ট্রের প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতি তথা রাষ্ট্রের উন্নতির কল্পে শিক্ষকের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
লেখক: শিক্ষক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
ওডি/এমএ
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড