ডা. রতীন মণ্ডল
প্রথমে ২টি ঘটনা বলি। একবার ২ দিনের জ্বর নিয়ে ৩০ বছর বয়সী একজন রোগী আমার কাছে আসলেন। দেখার পর মনে হলো ভাইরাল ফেভার। রোগীর প্রেশার কম আর খেতে পারছে না তাই রুটিন টেস্ট দিয়ে ভর্তি করলাম।
ভর্তি হবার ২ ঘণ্টা পর (তখনও রিপোর্ট আসেনি) রোগী হঠাৎ আরও অসুস্থ হয়ে গেল। প্রেশার ২০০/১৩০, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, রোগীকে আইসিইউতে নেওয়া হলো, কিছুক্ষণ পর (৩০ মিনিট এর মধ্যে) রোগী মারা গেল। ওই সময় আমি আর ভাগ্যক্রমে বিধু স্যার সেখানে উপস্থিত ছিলাম। রোগী মারা যাওয়ার পর রিপোর্ট আসল। আমরা দেখলাম প্লাটিলেট কাউন্ট ৩০ হাজার।
রোগীর লোকের কাছে আবারও ইতিহাস নেওয়া হলো। জানা গেল, গতকাল অনেক জ্বর হওয়ার পর গ্রামের ঔষধের দোকানদার তাকে ডিক্লোফেন (diclofen) ট্যাবলেট দিয়েছিল। রোগীর প্লাটিলেট কাউন্ট কম ছিল, তার ওপর ডিক্লোফেন (diclofen) খেয়ে ব্রেনে রক্তক্ষরণ হয়ে রোগী মারা গেছে। শিক্ষণীয় হচ্ছে- প্লাটিলেট কাউন্ট দেখে তা স্বাভাবিক হলে তারপর এনসেইড (NSAID) দেওয়া উচিত।
দ্বিতীয় ঘটনা- ৩/৪ দিন আগে একজন ডায়াবেটিসের রোগী জ্বর নিয়ে আমার কাছে আসলেন। আমার মনে হলো তার প্রস্রাবে ইনফেকশন, আমি প্রস্রাবের পরীক্ষা দিলাম, কিডনির টেস্ট আগে করা ছিল, নরমাল ছিল তাই আর করালাম না। রোগী বাসায় গেল।
২ দিন পর রোগী হাসপাতালে ভর্তি হলো। রোগীর তেমন কোনো উন্নতি নেই, সি/এস দেখার পর অ্যান্টিবায়োটিক পরিবর্তন করব। ভাবলাম কিডনি কেমন আছে দেখি। আগের রিপোর্টটা খুঁজে পেলাম না, তাই কিডনির পরীক্ষাটা করতে দিলাম। রিপোর্ট আসার পর আমার কোনোভাবেই সঠিক মনে হয়নি। কারণ এস ক্রিটেনিন ১২এমজি/ডিএল।
ল্যাবে বললাম রিপিট করো। ফল একই আসল। এস ইলেকট্রোলাইস করে দেখলাম হাইপারকালামিয়া (hyperkalaemi) আছে। গতকাল রোগীর ডায়ালাইসিস করা হয়েছে। তাহলে এসব টেস্ট কী অকারণে করা হয়েছিল?
শিক্ষণীয় হচ্ছে- ডায়াবেটিস/হাইপ্রেশারের রোগীর মাঝে মাঝে (অন্তত ৬ মাসে ১ বার) এবং যে কোনো গুরুতর অসুস্থতায় শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো পরীক্ষা করা দরকার। এই রোগীকে প্রথমেই কিডনির পরীক্ষা দিলে, রোগী বলত সামান্য জ্বর নিয়ে এলাম আর ডাক্তার অকারণে এতগুলো পরীক্ষা দিল। আর রোগী যখন খারাপ হয়ে গেল তখন রোগীর লোকের ভাষ্য-আপনি আগে কেন কিডনি টেস্ট করালেন না।
এবার আসি পরীক্ষা-নিরীক্ষায়। আমরা সাধারণত কয়েকটি পরীক্ষাকে রুটিন টেস্ট বলে থাকি। এগুলো হলো- সিবিসি (CBC), আরবিএস (RBS), এস ক্রিটেনিন (S. creatinine), ইউরিন আর/ই (Urine R/E), ইসিজি (ECG)।
সিবিসি (CBC) করে আমরা অনেকগুলো তথ্য পাই। যেমন- শরীরে রক্তের পরিমাণ কেমন, শরীরে কোনো ইনফেকশন আছে কি না, ব্লাড ক্যান্সার আছে কি না এবং প্লাটিলেট কাউন্ট কেমন। যা কমে গেলে শরীর থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে। এই টেস্ট না করে কোনো রোগীর সার্বিক শারীরিক অবস্থা বোঝা যায় না।
আরবিএস (RBS) পরীক্ষা দিয়ে কারো ডায়াবেটিস আছে কি না তা স্ক্যানিং করি। ১৮ বছর পর এই পরীক্ষা বছরে অন্তত একবার করা উচিত। তবে যাদের বাবা-মায়ের ডায়াবেটিস আছে আর যাদের ওজন বেশি তাদের বছরে অন্তত ২ বার (৬ মাস পরপর) করা উচিত। কারও যদি ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত থাকে বা সে যদি চিকিৎসা না গ্রহণ করে তবে তার কিডনি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, অন্ধত্বসহ আরও অনেক জটিল রোগ হতে পারে।
এস ক্রিটেনিন (S. creatinine) এই টেস্ট দিয়ে কিডনি ঠিক আছে কি না দেখা হয়। কিডনি রোগ যত তাড়াতাড়ি ধরা পরবে তত ভালো হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। যাদের ডায়াবেটিস/হাইপ্রেশার আছে তাদের কিডনি নষ্ট হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি। তাছাড়া যে কোনো ধরনের এনসেইড (NSAID), কিছু প্রেশারের ওষুধ, কিছু ডায়াবেটিসের ওষুধ, বাত রোগের ওষুধ, ক্যান্সারের ওষুধ দেওয়া না দেওয়া, কী ডোজে দিতে হবে তা এস ক্রিটেনিনের (S. creatinine) ওপর নির্ভর করে। বছরে অন্তত একবার এই পরীক্ষা করানো উচিত।
ইউরিন আর/ই (Urine R/E) এটি খুবই সাধারণ একটি পরীক্ষা কিন্তু খুবই তথ্যবহুল। এটি দিয়ে প্রস্রাবে ইনফেকশন আছে কি না, কিডনিতে কোনো সমস্যা আছে কি না, পাথর আছে কি না, ডায়াবেটিস আছে কি না ইত্যাদি জানা যায়। এছাড়াও কারও কিডনিতে সমস্যা কেবল শুরু হয়েছে কি না (যা চিকিৎসায় ভালো করা সম্ভব) তাও বোঝা যায় (প্রস্রাবের সঙ্গে প্রোটিন গেলে বুঝতে হবে কিডনিতে সমস্যা আছে)।
গত সপ্তাহে একজন ডায়াবেটিস রোগী দেখেছিলাম, যিনি ঔষধ খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন ঔষধ খাবার আর দরকার নেই, তার ডায়াবেটিসের পরীক্ষা, কিডনির পরীক্ষা আর ইসিজি (ECG) করতে দিলাম। ইসিজিতে রিসেন্ট অ্যান্টেরিয়র এমআই (Recent anterior MI) আসলো। ইকো করার পর ইসকায়েমিক কার্ডিওমায়োপ্যাথি আসলো।
ডায়াবেটিস ও হাইপ্রেশারের রোগীর বছরে অন্তত একবার ইসিজি (ECG) করা উচিত। কারণ বয়স্ক এবং ডায়াবেটিসের রোগীর বুকে কোনো ব্যথা ছাড়াই হার্ট অ্যাটাক হতে পারে।
আমার নন-মেডিকেল বন্ধুদের বলছি কেউ যদি এসব টেস্ট করেন, তাহলে ভাববেন না আর জীবনেও এসব করা লাগবে না, আপনি যদি আজ সব টেস্ট করেন আর কালকেই যদি আপনার বুকে ব্যথা হয় তবে আবারও ইসিজি করতে হবে। দয়া করে ভুল বুঝবেন না। ডাক্তার যে টেস্ট করতে দেন তা আপনার জন্যই, আপনার চিকিৎসার জন্যই, আপনার সুস্থতার জন্যই।
আমি আমার শিক্ষার্থীদের বলছি, তোমরা কোনো রোগীকে চিকিৎসা দেওয়ার আগে সবসময় চেষ্টা করবে রুটিন পরীক্ষাগুলো করাতে। কারণ একটা জিনিস মনে রাখবে, মেডিকেল সাইন্সে তুমি কখনোই হিরো হতে পারবে না। কিন্তু তোমার এক ভুলে তুমি জিরো হয়ে যাবে।
রোগীকে পরীক্ষা করাতে বলবে, রোগী যদি করতে না চায়, চিকিৎসা দেবে, রোগী ভালো না হলে তোমাকে বেশি চার্জ করবে না। কারণ চিকিৎসার দরকারি পরীক্ষাতো তারা করান নাই। কিন্তু তুমি যদি পরীক্ষা না করাতে দাও আর রোগীর উন্নতি না হয় বা ঔষধের কোনো সাইড ইফেক্ট হয় তবে তোমার ঘাড় ধরে বলবে আপনি কেন পরীক্ষা না করিয়ে চিকিৎসা দিলেন?
সবার জন্য বলছি আপনি আপনার টিভি, ফ্রিজ, বাইক, গাড়ি মাঝে মাঝে চেক করেন, সার্ভিসিং করেন। বছরে ১ বার নিজের শরীরের সার্ভিসিংও করান। বছরে ১ বার সিবিসি, আরবিএস, এস ক্রিটেনিন, ইউরিন আর/ই, ইসিজি, ফাস্টিং লিপিড প্রোফাইলস করে একজন ফিজিশিয়ানকে দেখান। এ সবের জন্য ২ হাজার টাকার বেশি খরচ হবে না। নিজের জন্য বছরে অন্তত ২ হাজার টাকা খরচ করুন, তাহলে ভবিষ্যতে অনেক ভালো থাকবেন।
লেখক : এমবিবিএস, এফসিপিএস (মেডিসিন), প্রতিষ্ঠাতা : ডাক্তারখানা
ওডি/এমএ
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড