• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

আই এম আবরার, কিল মি!

  খালিদ ফেরদৌস

১১ অক্টোবর ২০১৯, ০২:২৯
খালিদ ফেরদৌস
খালিদ ফেরদৌস

ছাত্রলীগের সাবেক এক প্রতাপশালী নেতা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন, "I am Abrar kill me" নিঃসন্দেহে এটা তার রাজনৈতিক অবস্থান থেকে সাহসী শুধু নয় দুঃসাহসী বচন। এটা তার মতো অসংখ্য মানুষের মুখের তীব্র বুলি বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে আকুতি। এমন আওয়াজ সর্বমহল থেকে আসতে হবে। কারণ একজন আবরার তৈরি করতে রাষ্ট্রের প্রায় ৫০ লাখের অধিক টাকা ব্যয় (এটা ব্যয় না বলে বিনিয়োগ বললে ভালো হবে) হয়। সে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী (এখানে মেধাবী কথা মোটেও যত্রতত্র ব্যবহার হয়নি; যেটা ছাত্রনেতাদের ক্ষেত্রে যত্রতত্র ব্যবহার হয়) ছাত্র।

ছাত্র-ছাত্রীরা ভালোভাবে অবগত বুয়েটে ভর্তি হওয়া কত কঠিন একটা কর্ম। তারা সেরাদের সেরা। মা-বাবা ভালো করে জানে ছেলে-মেয়েদের বুয়েটে ভর্তির জন্য কতটা স্বপ্নবাজ, কতটা শিক্ষানুরাগী, কতটা সঞ্চয় করে কত পয়সা খরচ করতে হয়। আবরারের বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজনরা ভালো করে অনুধাবন করছেন একটা সাজানো স্বপ্ন কিভাবে জবাই করা মুরগির মতো ছটফট করে মরে যায়।

দেশের বর্তমান নানাবিধ নাটকীয় কাহিনী দেখে মনে হচ্ছে, দেশ এখন এজেন্ডা সেটিং থিওরিতে চলছে। যেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীরও একক নিয়ন্ত্রণ আছে বলে মনে হচ্ছে না। আমি এর আগে কয়েকটি থিওরি ও রোগ যেমন- NPD, SPD, ZES, Venustophia, প্যালিনড্রোমিক সংখ্যা বিষয়ে ধারণা দিয়েছিলাম। এখন নতুন একটা থিওরি সম্পর্কে ধারণা দিই। থিওরিটি হলো- এজেন্ডা সেটিং থিওরি (Agenda-setting Theory). যা সাংবাদিকতা পেশায় বহুল প্রচলিত। এটি একটি বিষয় বা ঘটনাকে ধামাচাপা দেবার জন্য ব্যবহার করা হয়। এখানে ডাহা মিথ্যেকে সত্যে এবং ডাহা সত্যকে মিথ্যায় রূপান্তর করার জন্য অপকৌশলের আশ্রয় নেওয়া হয় । এটাকে এডলফ হিটলার তথ্যমন্ত্রী গোহেলের মিথ্যাকে শতবার সত্য বলে বলে সত্য এবং সত্যকে শতবার মিথ্যা বলে বলে মিথ্যায় রূপান্তর বা প্রতিষ্ঠিত করার তত্ত্বের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।

এই এজেন্ডা সেটিং থিওরি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে নানাভাবে মানবতা অপমানিত হয় এমন স্লোগান বা মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে একটা শ্রেণি দেশবিরোধীরা হীন ও জঘন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকে। যারা হতে পারে পাকিস্তানি রাজাকার বা নব্য ভারতীয় দালাল অথবা স্বার্থান্বেষী চক্র। এদের বিচরণ পিয়ানো থেকে ক্যাসিনো, সংবাদপত্র থেকে প্রেমপত্র, বেঈমানি থেকে জায়নামাজি, হত্যা থেকে খাটিয়া। এদের চেহারা একই রকম। তারা আমাকে এই লেখার জন্য আপনাকে অন্য কারণে পিটিয়ে হত্যা করবে আবার লাশ নিয়ে খুনের বিচার চেয়ে মিছিল করবে। আবার নতুন এজেন্ডা সেটিং করে সেই ঘটনা ধূলিসাৎ করে দিবে। তারা এখন এমন স্লোগান নিয়ে মাঠে-ময়দানে- সহমত হও, নচেৎ সহমরণে যাও। গোমূত্র খাও, না হয় বিদ্যুতের খুঁটিতে বেঁধে পিটুনি খেয়ে মারা যাও। শুকরের মাংস খাও না হয় সহমরণে যাও। এরা প্রত্যেকটা দেশে বিভিন্ন নামে, রঙে, গোত্রে মিশে আছে। এদের কোনো ধর্ম নেই। এদের অভিধানে মানবহিতৈষী দর্শন বলে কোনো ধারণা নেই।

সাম্প্রতিককালে ভারতের সঙ্গে ফেনী নদী, এলএনজি চুক্তি, সম্রাটকে গ্রেফতার, শিবির সন্দেহে বুয়েটের ছাত্র আবরারকে পিটিয়ে হত্যা সব একই সূত্রে গাঁথা বলে মনে হচ্ছে। আমার একান্ত নিজস্ব মতামত- বর্তমান বাংলাদেশের প্রত্যেকটা বিষয়ের ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারকারী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এইসব ক্ষেত্রে সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছেন না বা তিনি অনুধাবন করতে পারছেন না। তিনি মনের অজান্তেই তার দল, জনগণ সর্বপরি দেশের বিরুদ্ধে কিছু কাজ করে ফেলছেন। যা ভবিষ্যতে তার এবং তার দলের জন্য বুমেরাং হতে পারে। এই ধারণা আরও প্রকট হয় যখন দেশের বর্তমান পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বলেন, মানবিক কারণে ফেনী নদীর পানি ভারতকে দেওয়া হচ্ছে। আমরা মানবিক কারণে ভারতীয় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের দুর্গাপূজা উদযাপন করতে ৫শ টন ইলিশ সস্তায় অর্থাৎ কেজি প্রতি ৬.৩০ ডলারে রপ্তানি করছি যেখানে দেশে ইলিশের কেজি ১২ ডলার।

ফেলানিরা সীমান্তের তারের কাঁটায় ঝুলবে, ভারত নিজ দেশের সুবিধার্থে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ রাখবে, বিএসএফ পাখির মতো গুলি বাংলাদেশি হত্যা করবে, তিস্তার পানি আটকিয়ে দেশের উত্তর অঞ্চল মরুভূমি করে দেবে; আর আমরা চুপচাপ বসে থাকব আর বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী দেশ হিসেবে চারদিন ভেসে থাকা ভারতীয় জেলেকে প্রাণপণ চেষ্টায় উদ্ধার করে জুস খাইয়ে, সেবা করে সুস্থ করব। সুযোগ পেলেই মানবতা দেখাব আর তারা বাংলাদেশের জেলেকে হাতকড়া পরিয়ে, কখনো পিঠমোড়া দিয়ে বেঁধে জেলে নিক্ষেপ করবে তা হয় না। ভারতের তাবেদারি করা বা তাদের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করার সময় আমাদের হাতে নেই।

এটা আপাতদৃষ্টিতে ভারত বিরোধী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ মনে হলেও এটা নিগুঢ়ভাবে স্বদেশপ্রেম। আর স্বদেশপ্রেম বা দেশীয় পণ্যের প্রতি ভালোবাসা শিখতে বাংলাদেশিদের ইউরোপ-আমেরিকা যাবার প্রয়োজন নেই। ভারতীয়দের কাছে গেলেই বোঝা যাবে স্বদেশপ্রেম কাকে বলে? কত প্রকার? কী কী? স্বদেশ প্রেম কাকে বলে তা আমাদের ছেলে-মেয়েরা প্রাইমারির স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েই শিখে যায়। তাই এটার সংজ্ঞায়ন নিষ্প্রয়োজন। আমাদের সময় এখন এগিয়ে যাবার। আমরা আর্থ-সামাজিকসহ অনেক সূচকে ভারতের চেয়ে এগিয়ে। ভারত এখন অর্থনৈতিক, ভূ-রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক দিক দিয়ে ইতিহাসের সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় পড়েছে। তাদের মুঠো থেকে নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কাসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশ বেরিয়ে এখন চীনের ছায়াতলে গিয়ে দেশকে তরতর করে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

অন্য দিকে ভারত তার পাশবর্তী দেশগুলোর টেকসই উন্নয়ন চায় না এটা প্রমাণিত। তারা ব্রিটিশদের শেখানো ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি প্রয়োগ করে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে চায় প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ওপর। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বলা যায়, ভারত আমাদের বন্ধু হলে যতটা লাভ তার চেয়ে শত্রু হলে বেশি লাভ। তারা জাতিসংঘের ভোটাভুটিতে ইদানিং রোহিঙ্গা ইস্যুসহ কোনো বিষয়ে সমর্থন করেনি। অথচ আমরা দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক ইস্যুতে অন্ধের মতো তাদের সমর্থন দিয়েছি। এটা করা হয়েছে মূলত চলমান সরকার দলীয় ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য; যা বুঝতে বিজ্ঞ রাজনৈতিক বিশ্লেষক হবার দরকার নেই। এখানে ক্ষমতাসীনদের জ্ঞাতার্থে বলা যায়, বর্তমানে বাংলাদেশের যে আর্থ-সামাজিক, প্রশাসনিক, ও রাজনৈতিক অবস্থা তাতে দেশের ক্ষমতার গদি পরিবর্তনের ক্ষমতা ভারতের নেই। শুধু ভারত নয় আমেরিকা, ইংল্যান্ড, চীন, রাশিয়া কারোরই নেই।

বর্তমান সরকার যেভাবে দেশের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তাতে আগামী দশ বছরে ক্ষমতা কাঠামোর তেমন কোনো পরিবর্তন হবে বলে মনে করি না। জাতীয় নির্বাচন তথা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমেরিকা-ইউরোপকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছেন; আমরা তোমাদের কথায় এখন উঠি-বসি না। আমরা এখন তলাবিহীন ঝুড়ি না। আমরা দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতির দেশ। আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও জিডিপি অগ্রগতি সারাবিশ্বের ভেতর তৃতীয় সেরা। আমাদের উন্নয়ন এখন চিরদিন পরমুখাপেক্ষী রাখা আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের এজেন্ডা বা কৌশলপত্রে চলে না। আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অন্য সব কারণে সমালোচনা করলেও এই ব্যাপারটায় একরোখা মনোভাবের জন্য ভূয়সী প্রশংসা করি।

তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এখন সময় এসেছে পাকিস্তানি রাজাকারদের মতো ভারতীয় দালাল-রাজাকার-চাটুকারদের বয়কট করা এবং সমূলে উপড়ে ফেলা। না হলে নিশ্চিতভাবে অচিরেই এদেশ তাদের আরও নিয়ন্ত্রণের গহ্বরে নিপতিত হবে। যখন স্বয়ং মহাপ্রতাপশালী ও উন্নয়নমনা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও কিছু করার থাকবে না।

এ দেশে এজেন্ডা সেটিং থিওরি চলতেই থাকবে। ভারত ও সুপার পাওয়ারদের হাত থেকে কার্যত কখনোই মুক্তি মিলবে না। প্রকৃত স্বাধীনতা ও টেকসই উন্নয়ন চিরকাল থেকে যাবে অধরা। যা কারও কাম্য নয়। বিষয়টিতে বর্তমান সরকারকে সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করে করণীয় ঠিক করে কাজ করতে হবে। এমন প্রত্যাশা দেশের আপামর জনগণ সকলের। আশা বঞ্চিত ও স্বপ্নভঙ্গ হওয়া জনগণের এই প্রত্যাশার যেন প্রাপ্তি ঘটে।

লেখক- এমফিল গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

মতামত বিভাগে প্রকাশিত প্রতিটি লেখা লেখকের ব্যক্তিগত অভিমত। সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে এর কোনো সম্পৃক্ততা নাও থাকতে পারে।

চলমান আলোচিত ঘটনা বা দৃষ্টি আকর্ষণযোগ্য সমসাময়িক বিষয়ে আপনার মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাই, সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইলকরুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড