সুলতান মাহমুদ বান্না
একটি উপমা দিয়েই শুরু করি- “সেদিন আমার এক বন্ধু বললো, আজকে একদম পানি মেপে মেপে গোসল করেছি। আমি বললাম, গোসল ঠিকমতো হয়েছে তো? উত্তর দিলো, হ্যাঁ। আমি বললাম, তাহলে অন্য সময় যতটুকু পানি ব্যবহার করো, তারচে’ কম ব্যবহার করলেও কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়, তাইতো? কোনো উত্তর নেই।” খেয়াল করলাম, বিবেক যেন তার মনে ভীষণ আঘাত করেছে, চেহারায় তা যেন স্পষ্ট।
আসলে আমাদের জীবনকে যদি এভাবে বিবেককে দিয়ে যাচাই করি, তাহলে আমাদের সবার মুখেরই উজ্জ্বলতা হারিয়ে যাবে। এক সময় আসবে আমাদের কোন জবাব মিলবে না, হা করেই থাকতে হবে। আমাদের মাতৃভূমি আজ গভীর সঙ্কটের সম্মুখীন। নিজেদের সৃষ্ট কিছু অপকর্ম ও বিতর্কিত কর্মকাণ্ড আর নিয়মিত অপচয় ও অপব্যয়েই আজ পরিবেশের বিরূপতা, সবমিলে বিপর্যয়ের মুখে বিশ্ব। জীবন চালনাই দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রতিবছর ঘটা করে ৫ জুন আমরা বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালন করি। কিন্তু বাকী দিনগুলোতে আমরা নিজের স্বার্থ বা ভোগ-বিলাসের কাছে নিজেকে আত্মসমর্পণ করে দিই। এটাই আমাদের জন্য দূর্ভাগ্য। যেই দূর্ভাগ্য সময় উপলব্ধি করেই ১৯৭২ সালে ৯৩টি দেশের প্রতিনিধিরা একত্রিত হয়ে পরিবেশের একটা ঘোষণাপত্র উপহার দিয়েছিলেন। যে ভাবনার প্রথমেই বলা আছে, বিশুদ্ধ নির্মল পরিবেশ মানুষের জন্মগত অধিকার। কিন্তু সেই অধিকার আজ শুধুই ছাপা কাগজে।
পৃথিবীর সকল সম্পদ আমাদের জীবনের জন্যই নয়, একটি বাসযোগ্য পৃথিবীর জন্যও আজ প্রয়োজন। কিন্তু আমরা নিজেদের নির্বুদ্ধিতা, অসচেতনতা, অবহেলা ইত্যাদি নানাভাবেই সম্পদ অপচয় করে যাচ্ছি। প্রতিদিনের ছোট ছোট কর্মের মাধ্যমে আমাদের জীবনের বড় বড় সমস্যা তৈরি করে চলেছি।
নিঃস্প্রয়োজন বা অযথা খরচ আমাদের যেন অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার অনেকেই চক্ষুলজ্জা ও খেয়ালের বশে দেদারসে অর্থ-সম্পদ অপচয় করছি। কেউ কেউ ভোগ-বিলাসের মাধ্যমে অহরহ অপচয় ও অপব্যয় করছি। আমাদের সমাজের অনেকেই নিজেকে সম্পদশালী ও অন্যদের চেয়ে শ্রেয় হিসেবে তুলে ধরার জন্য চড়াদামে জিনিসপত্র ক্রয় করেন, যা প্রকৃতপক্ষে তার জন্য আদৌ প্রয়োজনীয় নয়। এটিও একধরনের অপচয়।
অপচয় ও অপব্যয় ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। অপচয় ও অপব্যয় শব্দ দুটি অনেক ক্ষেত্রে সমার্থক হিসেবে ব্যবহৃত হলেও এ দুয়ের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। বৈধ কাজে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি মাত্রায় ব্যয় করার নামই অপচয়, অন্যদিকে অন্যায় ও অযৌক্তিক উপায়ে সম্পদের অপব্যবহারই অপব্যয়। আমরা আমাদের চারপাশ কিংবা জীবনের যে দিকেই তাকাই না কেন, কেবল অপচয়ের সমাহার দেখতে পাই। অপচয় শুধু আমাদের পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও কর্মক্ষেত্রেই দেখতে পাই না, ধর্মীয় ক্ষেত্রেও এর জৌলুসপূর্ণ অবস্থান দেখতে পাই। অপচয় থেকে দূরে থাকার জন্য প্রতিটি ধর্মেই কঠোরভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আমাদের ইসলাম ধর্মে অপচয় সংক্রান্ত মহাগ্রন্থ আল-কোরআন, বিভিন্ন হাদীসেও কঠোর নির্দেশ রয়েছে। আমি ওগুলো উল্লেখ না করে হযরত আলী (রা.) এর একটি বাণী উল্লেখ করলাম। তিনি বলেছেন, “সম্পদ হচ্ছে আমানত। কাজেই কোনোভাবেই এই আমানতের খিয়ানত করা যাবে না এবং তা সঠিককাজে সর্বোত্তম পন্থায় ব্যবহার করতে হবে।”
আমাদের ধনী-গরীব, নারী-পুরুষ, সাদা-কালো, ছোট-বড় সবারই জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজন খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য। এই মৌলিক চাহিদা আজ সামাজিক ও আর্থিক ভিন্নতার কারণে সমভাবে প্রয়োজন মেটাতে পারছে না। সমাজে কারো সম্পদ ভোগের পেয়ালা উপচে পড়ছে, আবার কারো পেয়ালা শূন্য থাকছে। যাদের পেয়ালা উপচে পড়ছে, তারা যদি অপচয় বন্ধ করি, শূন্য হাঁড়িতে ঢেলে দিই; তাহলে একদিকে যেমন উপচে পড়া তথা অপচয় বন্ধ হবে, তেমনি অন্যদিকে কোন হাঁড়িও শূন্য থাকবে না। অপচয় ও অপব্যয়ের সঙ্গে অবৈধ উপার্জনেরও একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। বৈধপথে অর্জিত সম্পদ দিয়ে প্রয়োজনের অধিক ব্যয় করা কষ্টকর। অধিক তো দূরের কথা, অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যয়ই মেটানো সম্ভব হয়ে উঠে না। অপচয় করবে কোত্থেকে? অপচয় ও অপব্যয়ে কোন প্রাপ্তি না থাকলেও মানুষ এ থেকে বিরত থাকছে না। তবে ভাবতে অবাক লাগে যখন দেখি, যারা সম্পদের সঙ্কটে ভোগে, তারাও অনেক সময় বেহিসাবী অপচয়ে জড়িয়ে পড়ে।
সেদিন মাগরিবের নামাজের জন্য ওজু করতে বসেছি। পাশে কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে এমন বয়সী একটা ছেলে ওজু করছে। খেয়াল করলাম, ওজু করার সময় পানির ট্যাপ বন্ধ করছে আর খুলছে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি এরকম করলে কেন? বললো, যাতে পানির অপচয় না হয়। তার এই চিন্তা-ভাবনা দেখে অভিভূত হলাম। তখন একটা হাদিসের কথা মনে আসলো। একদা প্রিয় নবী (সা.) হযরত সাদ (রা.) এর কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তিনি (হযরত সাদ রা.) ওজু করছিলেন। প্রিয় নবী (সা.) বললেন, হে সাদ! এ অপচয় কেন? সাদ বললেন, ওজুর মধ্যেও কি অপচয় আছে? নবী (সা.) বললেন, হ্যাঁ, তুমি প্রবাহমান নদীর তীরেই থাক না কেন।[আহমদ] এটা তো একটা ছোট অপচয় রোধের ঘটনা। এভাবেই যদি আমরা প্রতিনিয়ত আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহারিক কাজে অপচয় কমাতে পারি, তাহলে কি আমাদের দেশকে কি প্রাকৃতিকভাবে উন্নতির শিখরে নিতে পারব না?
পৃথিবীর এক-সহস্রাংশেরও কম ভূমিতে আমাদের ২৪ সহস্রাংশ মানুসের বাস। অর্থাৎ পৃথিবীর একটি শিশু গড়ে যে পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে বড় হয়, বাংলাদেশে একটি শিশু তার ২৪ গুণ কম পায়। স্বভাবতই সম্পদের ব্যবহারে আমাদের অবশ্যই মিতব্যয়ী হওয়া উচিত। তাইওয়ানে মাথাপিছু ৪০ হাজার ডলার আয়ের দেশের একটি ঘটনা। একজন ভিনদেশি একটি দোকানে গেছেন জুস খেতে। সেখানে দ্বিতীয়বার ফলের জুস খাওয়ার জন্য অর্ডার দিলে দোকানদার আগে দেওয়া ফেলনাযোগ্য গ্লাসটি চাইলেন। অতিথি রীতিমতো অবাক। তখন, দোকানদার তাকে বললেন, “যতক্ষণ পারো ব্যবহার করো, তারপর তার রিসাইক্লিং করো, তাও ফেলে দেবে না।” কৃচ্ছসাধন করেই তারা উন্নতির শিখরে।
বেশি কথা বলাও একধরনের অপচয়। কারণ-অকারণে, সময়-অসময়ে আমরা যেন কথা বলতেই বেশি পছন্দ করি। কিন্তু আমরা খেয়াল করি না যে আমরা কি বলছি, কেন বলছি, কোথায় বলছি। কথা বেশি বলতে বলতে আমরা বেফাঁস, বাজে কথাই বেশি বলে ফেলি। কাজের কথা, জরুরি বা দরকারি কথা বলাই হয় না। এই বেশি কথা বলতে যেয়ে সমাজে ঝগড়া-ঝাঁটি, মারা-মারি, খুন-াঁরাবি পর্যন্তও হয়ে থাকে। প্রতিটি কথার সাথে প্রতিটি সময়ও যে হারিয়ে যেতে থাকে, সেটাও আমরা খেয়াল করি না। তার মানে, কথার সাথে আমরা সময়ও অপচয় করতে সিদ্ধহস্ত। অথচ সমযের অপচয় নিয়ে এ পর্যন্ত কত বাণীই না আমরা প্রতিনিয়ত দিয়ে যাচ্ছি।
পৃথিবীর সবকিছুতেই রয়েছে অপূর্ব সমন্বয়, ছন্দ এবং চমৎকার ভারসাম্য, যা মানুষের বসবাসের অনুকূল ও উপযোগী অবস্থা গড়ে তুলেছেন সৃষ্টিকর্তা। তিনি প্রতিটি জিনিসকে এমনভাবে তৈরি করেছেন যে, সব কিছুর প্রয়োজন রয়েছে যা একে অন্যের সম্পূরক ও পরিপূরক। বাঁচার জন্য যা কিছু প্রয়োজন, মানুষ পৃথিবীর সকল অনুকূল পরিবেশ থেকেই তা গ্রহণ করছে। কিন্তু সেই আমরাই আবার বাস অযোগ্য করে তোলার জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছি। প্রতিনিয়ত করে যাচ্ছি অপচয় ও অপব্যয়।
আমরা অপচয় ও অপব্যয়ের পথ পরিহার করে সেই অর্থ সমাজের দুস্থ, দরিদ্র ও অবহেলিত মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটাতে বা সাময়িক সহায়তার জন্য ব্যয় করি। তাহলে সমাজ যেমন সুন্দর ও সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে, তেমনি আমরাও মানসিক প্রশান্তি পাব। এই জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আমাদের ঐকান্তিক সদিচ্ছা ও সচেতন মানসিকতা। অপচয় করে ক্ষতি ছাড়া কোনো লাভ নেই। নিজের জন্যেও অন্যকে সচেতন করুন। তাই আসুন, “আমরা নিজে সচেতন হই, অপরকে সচেতন করি, জীবনের ‘অপচয়’ রোধ করি”। লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট। [email protected]
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড