মুহাম্মদ জহিরুল হক
হিন্দুত্ববাদী বিজেপির সরকার বিতর্কিত ভারত-অধিকৃত কাশ্মীরের (আইওকে) বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা প্রত্যাহার করেছে। রাজ্যটিতে ভারী নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যেই গেল ৫ আগস্ট সংসদে কাশ্মীরকে কেন্দ্র শাসিত রাজ্যে রূপান্তরের ঘোষণা দেয় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। এমন একটি পদক্ষেপ ভারত শাসিত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরের অধিবাসীদের মধ্যে ভয়, শঙ্কা ও ক্ষোভের জন্ম দিচ্ছে। সেই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছে ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে শুরু করে উপমহাদেশের অন্য দেশ গুলোতেও।
সংবিধানের ৩৭০ ধারার বিশেষ মর্যাদা কাশ্মীরকে স্বায়ত্তশাসনে যে অধিকার দিয়েছিল তা বিভিন্ন সময় শিথিল করা হলেও এবার তা বাতিলের মাধ্যমে কাশ্মীরবাসীকে পরাধীনতার শেখল বেধে দিল। অতীতে ১৯৫৬ সালের পর দফায় দফায় ৩৭০ ধারাকে দুর্বল করা হয়েছে। ১৯৫৬ থেকে ১৯৯৪ সালের মধ্যে রাষ্ট্রপতির ৪৭টি আদেশের মাধ্যমে তাকে এমন জায়গায় নিয়ে দাঁড় করানো হয়েছে, যেখানে স্বায়ত্তশাসন কেবল প্রতীকী হয়ে উঠেছে। সেই সঙ্গে ৩৫এ ধারা মাধ্যমে কাশ্মীরবাসীর ভূমির ওপর, চাকরির ওপর তাদের যে অধিকার ছিল এবং স্থায়ী বাসিন্দা বলে কারা বিবেচিত হবে, সে বিষয়ে রাজ্যের যে এখতিয়ার ছিল, তারও অবসান হতে যাচ্ছে।
বিজেপি সরকারের এমন একচেটিয়া সিদ্ধান্ত কাশ্মীরে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে বলে অনেকে মন্তব্য করেছেন। সেই সঙ্গে ভারতের বিভিন্ন রাজ্য ও উপমহাদেশের দেশগুলোর সম্পর্ক ও আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে। এতে উপমহাদেশে নতুন করে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ছে।
সেখানকার বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে দৈনিক অধিকারের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি মুহাম্মদ জহিরুল হককে বিস্তারিত জানালেন ভারতের নয়াদিল্লিতে অবস্থানরত বাংলাদেশি সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটির আইনের শিক্ষার্থী রাইহান মাহমুদ।
দৈনিক অধিকার : কাশ্মীর ইস্যুতে নয়াদিল্লীর পরিস্থিতি কেমন? সচক্ষে কোনো বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করলেন?
রাইহান মাহমুদ : আমাদের এদিকে কূটনৈতিক অঞ্চল, এইখানের অবস্থা অনেকটা স্বাভাবিক। কিন্তু কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসনের সাংবিধানিক ধারা ৩৭০ বাতিল করার পর এখানকার মানুষ অনেক খুশি ছিল, বিশেষ করে হিন্দুরা। অনেকে ঢোল বাজায় ও মিষ্টি বিতরণ করছে।
দৈনিক অধিকার : নয়াদিল্লীতে অবস্থানরত কাশ্মীরী শিক্ষার্থীরা কোনো প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন?
রাইহান মাহমুদ : এইখানে অনেক মুসলিম ছাত্রের সঙ্গে কথা বলেছি এই ব্যাপারে। এরা ৩৭০ রদ করায় সরকারের প্রতি সন্তুষ্ট নয়। কাশ্মীরের শিক্ষার্থীরাও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। ওই ঘটনার পর ওদের পরিবার নিয়ে অনেকের মধ্যে উদ্বিগ্নতা দেখা গেছে, কারণ তাদের পরিবারের লোকদের সঙ্গে যোগাযোগের কোনো মাধ্যম নেই। কারণ ইন্টারনেট ও ফোন পরিষেবাদি বিচ্ছিন্ন করে ঐ অঞ্চলে কারফিউ জারি করা হয়েছে।
দৈনিক অধিকার : এই কাশ্মীর ইস্যু উপমহাদেশের পরিস্থিতি কোন দিকে যেতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
রাইহান মাহমুদ : ১৯৪৭ এর পর এই কাশ্মীর নিয়ে উপমহাদেশের ভূ-পরিস্থিতি উষ্ণ ছিল। সম্প্রতি সেটা আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে ভারতের সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করাতে। ভারত ভাগের সময় ‘শেরে কাশ্মীর’ হিসেবে খ্যাত শেখ আব্দুল্লাহ পূর্ণ স্বাধীনতা চেয়েছিলেন। পরে ভারতীয় সরকার বিশেষ মর্যাদায় স্বায়ত্তশাসন মেনে নিয়েছিলেন। এখন বিজেপি সরকার তাদের দেওয়া রাজনৈতিক ইশতেহার বাস্তবায়ন করার জন্য সংবিধানের ৩৭০ রদ করে যেটা ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে আরেকটা যুদ্ধের পরিস্থিতে সৃষ্টি করেছে। আন্তর্জাতিক আইনের ছাত্র হিসেবে বলব, ভারতের এই কাজটা আন্তর্জাতিক আইন ও সাংবিধানিক আইনের পরিপন্থী। পাশাপাশি কাশ্মীরের এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্যও গভীর চিন্তার বিষয়। বর্তমানে আমরা মায়ানমার থেকে বিতাড়িত জনগোষ্টীদের আশ্রয় প্রদান করছি যেটা আমাদের জন্য বোঝা। বিজেপি সরকার যদি তাদের রাজনৈতিক ইশতেহার বাস্তবায়নের দোহাই দিয়ে কাশ্মীরে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে সেক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ বা আসাম এর বাংলা ভাষাভাষী জনগণকে বাংলাদেশের নাগরিক আখ্যা দিয়ে তাদের রাজনৈতিক ইশতেহারে থাকা এনআরসি বা নাগরিকপুঞ্জি নিবন্ধনও করতে পারবে। যেটা বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় সমস্যা হবে। এছাড়া কাশ্মীর ও উপমহাদেশের এই অঞ্চলে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ থেকে রক্ষা পাবে না।
প্রসঙ্গত, ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা অনুযায়ী জম্মু ও কাশ্মীর একটি ব্যতিক্রমী রাজ্য, কারণ প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র বা যোগাযোগের মতো কয়েকটি বিষয় ছাড়া বাকি সব ক্ষেত্রে সেখানে ভারতের কোনো আইন প্রয়োগ করতে গেলে রাজ্য সরকারের সম্মতিও জরুরি ছিল। নাগরিকত্ব, সম্পত্তির মালিকানা বা মৌলিক অধিকারের প্রশ্নেও এই রাজ্যের বাসিন্দারা দেশের বাকি রাজ্যের তুলনায় বাড়তি কিছু সুবিধা ভোগ করে থাকত, আর ৩৭০ ধারার অধীনেই তাদের সে অধিকার দেওয়া হয়েছিল। এই ৩৭০ ধারার ভিত্তিতেই নিহিত ভারতের সঙ্গে কাশ্মীরের সংযুক্তিকরণের ইতিহাস।
৩৭০ বাতিলের মাধ্যমে কেন্দ্র শাসিত রাজ্য হওয়ায় এখন থেকে কাশ্মীরে প্রতি পাঁচ বছর পর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, কেন্দ্রের মতো। কেন্দ্র ঠিক করবে সেখানে পুলিশের কী ক্ষমতা হবে। কেন্দ্র সেখানে অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা জারি করার ক্ষমতা পাবে। জম্মু-কাশ্মীরের দ্বৈত পতাকা ব্যবস্থা বাতিল হতে যাচ্ছে। স্বতন্ত্র আইন বাতিল হতে যাচ্ছে। বিজেপির মূল শক্তি হিন্দুত্ববাদ, ভারতের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যটিতে ৩৭০ ধারা বিলুপ্তির মাধ্যমে হিন্দুত্ববাদের বীজ বপন হয়ে যাবে। জম্মু-কাশ্মীরের সঙ্গে লাদাখকেও কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে রূপান্তরের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে, তবে সেখান থেকে কোনো সাংসদ থাকবে না কেন্দ্রে। সংবিধানের ৩৫এ ধারাকে বাতিলের মাধ্যমে এই ঘোষণা আসে, যার ফলে এখন থেকে বিধান অনুযায়ী এই অঞ্চলের বাইরের অর্থাৎ অন্যান্য রাজ্যের ভারতীয়রা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জম্মু-কাশ্মীরে জমি কেনা বা স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করতে পারবে। আর এটাই কাশ্মীরিদের উদ্বেগের বিষয়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরে হিন্দু বাসিন্দাদের নতুন এক জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ, মুসলিমদের কাশ্মীরকে হিন্দুত্ববাদী রাজ্যে পরিণত করার বিজেপির জনমিতিক লক্ষ্যের অংশই হচ্ছে এমন পদক্ষেপ বলে জানায় পাকিস্তানের পত্রিকা ‘ডন’।
এছাড়া আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোকাবিলার নামে এই অঞ্চলটিতে যেকোনো জনসমাবেশেকে নিষিদ্ধ করার আদেশ দিয়েছে। রাজ্যজুড়ে বাড়ানো হয়েছে সুরক্ষা ব্যবস্থা, নতুন করে মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত প্রায় ৪৩ হাজার সেনা। রবিবার গভীর রাতেই ভারত সরকার আইওকে-এর প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ এবং মেহবুবা মুফতিকে গ্রেপ্তার করে। ইন্টারনেট ও ফোন পরিষেবাদি বিচ্ছিন্ন করে এই অঞ্চলে কারফিউ জারি করা হয়েছে।
ওডি/আরএআর
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড