• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ডেঙ্গু নিয়ে খোলা চিঠি ‘জীবন জীবনের জন্য’

  অধিকার ডেস্ক

০৪ আগস্ট ২০১৯, ০৪:২৪
ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সেবা করছেন এক নারী
ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সেবা করছেন এক নারী (ছবি : সংগৃহীত)

‘জীবন জীবনের জন্য’- জীবের বেঁচে থাকা, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা এবং অন্য জীবের উপকারার্থে যে ভূমিকা পালন করা হয়, সাধারণ অর্থে এই দর্শনটি দিয়ে তা-ই বোঝানো হয়ে থাকে। কিন্তু ভাইরাস এক প্রকার অকোষীয় অণুজীব, যার বংশবিস্তার ঘটে তার পছন্দের জীবিত কোষের অভ্যন্তরে। কোনো কোনো ভাইরাস আবার তার বংশ বিস্তারের জন্য একাধিক জীবের কোষ ব্যবহার করে একটি জটিল জীবনচক্র গড়ে তোলে।

যেমন- এ সময়ের ত্রাস হিসেবে আবির্ভূত ডেঙ্গু ভাইরাস। তার জীবনচক্রে দুটি পুষক প্রয়োজন। যথা- স্ত্রী জাতীয় এডিস মশা এবং মানবকুল। এডিস মশা বংশ বিস্তারের জন্য মানুষের রক্ত চুষে, যা দিয়ে তার ভেতর ডিম্ব উৎপন্ন ও পরিপক্ব হয়। রক্ত চুষাকালে স্ত্রী এডিস মশা তার লালা রসের মাধ্যমে তার অন্ত্রীয় কোষে জন্ম নেয়া ও বৃদ্ধি পাওয়া ডেঙ্গু ভাইরাস ঢুকিয়ে দেয় মানুষের দেহে।

তারপরই যে উপাখ্যান শুরু হয়, তা হল- ডেঙ্গুজ্বর প্রকাশ পাওয়া এবং বিভিন্ন জটিলতা দেখা দেয়া; যাতে মানুষের অবর্ণনীয় ভোগান্তি ঘটে, এমনকি মৃত্যুও হয়ে যেতে পারে। তাহলে ‘জীবন জীবনের জন্য’ এই উক্তির মানে দাঁড়ায়, মানুষের জীবন ওই ডেঙ্গু ভাইরাস এবং এডিস মশার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য উৎসর্গীকৃত।

এডিস মশার দুটি প্রজাতি; যথা- এডিস ইজিপ্টি এবং এডিস এলবোপিকটাস ডেঙ্গু ভাইরাসের জৈবিক বাহক। পূর্ণবয়স্ক এডিস মশার আয়ুষ্কাল সাধারণত ১০ থেকে ২১ দিন। স্ত্রী এডিস মশা এই জীবনকালে সর্বোচ্চ পাঁচবার ডিম দিয়ে থাকে। প্রতিবার একটি স্ত্রী এডিস মশা ১০০ থেকে ২০০টি পর্যন্ত ডিম দিয়ে থাকে। সেই হিসাবে একটি স্ত্রী মশা থেকে ন্যূনপক্ষে ৫০০টি নতুন সন্তান জন্ম নেয়।

ডিমগুলো নিষিক্ত হওয়ার জন্য স্ত্রী মশা পুরুষ মশার সঙ্গে জীবনে একবার যৌন সঙ্গমে মিলিত হয় এবং যে শুক্রাণু নির্গত হয়, তা বিশেষ ধরনের থলির মধ্যে সঞ্চিত থাকে। সেখান থেকেই শুক্রাণু বের হয়ে এসে পরিপক্ব ডিমগুলোকে নিষিক্ত করার পর তা স্ত্রী মশা পেড়ে থাকে। তাহলে ৫০০ সন্তানের মধ্যে অর্ধেক হবে স্ত্রী এবং বাকি অর্ধেক পুরুষ। ডিম পর্যায় থেকে পরিপক্ব হয়ে পূর্ণাঙ্গ প্রজননক্ষম মশা হতে গড়ে সময় লাগে ১৪ দিন। তারপর চক্রবৃদ্ধি হারে প্রজন্ম বাড়াতে থাকে। সেজন্য স্ত্রী মশা তার বংশবিস্তার চালু রাখার জন্য মানুষের রক্ত চুষে অত্যন্ত সক্ষম ও সক্রিয়ভাবে।

মানুষের রক্তই এডিস মশার বেশি পছন্দ। তাই সুযোগ পেলে একটি এডিস স্ত্রী মশা একবার একটা সুযোগেই ১৫-২০ জন মানুষকে কামড় দিয়ে দিতে পারে অথবা একই মানুষকে একাধিকবার কামড়াতে পারে। যত বেশি রক্ত শোষিত হবে, ততো বেশিসংখ্যক ডিম উৎপন্ন ও পরিপক্ব হবে। তাই বেশি বেশি কামড়ে বেশি বেশি রক্তের সহায়তায় বেশি বেশি নবপ্রজন্মের সদস্য উৎপন্ন হয়; যারা তাদের জীবনকালে ডেঙ্গু রোগের বাহক হিসেবে কাজ করে থাকে।

কোনো মানুষের রক্তে যখন ডেঙ্গু ভাইরাস উপস্থিত থাকে, তখন মশার কামড়ের সময় কিছু ভাইরাস মশার অন্ত্রনালিতে ঢুকে যায় এবং অন্ত্রের আবরণী কোষগুলোর ভেতর প্রবেশ করে সেখানে জৈবিক রেপ্লিকেশন পদ্ধতির মাধ্যমে বংশ বৃদ্ধি করতে থাকে। সেখান থেকে প্রচুর ভাইরাস সঞ্চালিত হয়ে স্ত্রী মশার লালাগ্রন্থিতে এসে আশ্রয় নেয়; আবার কিছু ভাইরাস স্ত্রী মশার ডিম্বকোষের ভেতর আশ্রয় নিয়ে তার প্রজন্ম বৃদ্ধি করে। পরে ওই মশাটি নিজে ডেঙ্গু ভাইরাসের উৎস হিসেবে কাজ করে এবং তার থেকে যত স্ত্রী মশা জন্ম নেবে, তারা সবাই প্রকৃতিগতভাবেই জন্মসূত্রে ডেঙ্গু ভাইরাসের উৎস হিসেবে কাজ করবে।

স্ত্রী মশা যখন মানুষের দেহ থেকে রক্ত চুষার জন্য তার তরতরে শুঁড় লোমকূপের ফাঁক দিয়ে প্রবেশ করায়, তা কিন্তু মানুষের ত্বকের স্তরে যে সমস্ত ক্ষুদ্রতম রক্তনালিকা থাকে; সেগুলোর ফাঁপা অভ্যন্তর ভাগ পর্যন্ত ঢুকে যায়। এবারে মশা পশ্চাৎচাপে তার লালারস নিঃসৃত করে রক্ত জমাট বাঁধায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। সম্মুখ চাপে নিষ্কাশন পদ্ধতিতে রক্ত চুষতে থাকে উদরপূর্তি না হওয়া পর্যন্ত।

‘নিল রক্ত তরতাজা, দিল ডেঙ্গু কঠিন সাজা’- স্ত্রী এডিস মশার একবারের কামড়ে যদি ১০ বা তদুর্ধ্ব ভাইরাস (প্ল্যাক ফরমিং ইউনিট PFU) কণা প্রতি এক মিলিলিটার লালারসে থাকে এবং তা মানুষের রক্তে প্রবেশ করে, তাহলেই কামড় খাওয়া লোকটি ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হতে পারেন। সেই বিবেচনায় একটি স্ত্রী এডিস মশা একবার কামড় দিলেই ডেঙ্গু হওয়ার আশঙ্কা আছে বলে মন্তব্য করা হয়। কিন্তু প্রতিবেশে মশার গণনা বা হিসাব যেহেতু বহুসংখ্যক, তাই কামড়ের সংখ্যাও বহুবার এবং আনুপাতিক হারে শরীরে প্রবেশকৃত ভাইরাসের সংখ্যাও অগণিত।

এডিস মশা মানুষের কাছাকাছি বাস করতে পছন্দ করে প্রাকৃতিক কারণেই। তাই গৃহস্থালির বিভিন্ন প্রকার তৈজসপত্র, পানির পাত্র, ফুলের টব, খালি কৌটা, টিন, বৈয়াম, নির্মাণাধীন ভবনের উন্মুক্ত পানির চৌবাচ্চা, খালি বোতল, ডাব-নারিকেলের কাটা খোল, ভাঙা বোতল, পরিত্যক্ত গাড়ির টায়ার, বাঁশের খোল, গাছের খুড়ল, ছাদের কোনাকোনি ইত্যাদি জায়গা, যেখানে সংরক্ষিত পানি বা বৃষ্টির পরিষ্কার পানি স্থিত অবস্থায় থাকে; সেখানে ডিম পাড়ে। ডিম থেকে লার্ভা (শুককীট) জন্ম নেয়ার জন্য জলভেজা পরিবেশ দরকার হয় নিদেনপক্ষে টানা দু’দিন।

যদি এরই মধ্যে পানি শুকিয়ে যায় বা ফেলে দেয়া হয় তবে কিছু ডিম অপসারিত হয়, আবার কিছু ডিম না ফুটে নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থেকে যেতে পারে ক্ষেত্র বিশেষে এক বছরের অধিক সময় পর্যন্ত। যখনই আবার পানির সংস্পর্শে আসে, তখনই সক্রিয় হয়ে পরিপক্ব হয় এবং লার্ভা উৎপাদন করতে পারে। সুতরাং, বৃষ্টি হলেই প্রজননের তৈজসে আবার পানি জমবে, সেটা যেমন ঘটে ফুল বা গাছ পরিচর্যার জন্য বিশেষ করে টবগুলোতে মাঝে মধ্যেই পানি দেয়া হয়।

তাতেও কিন্তু সুপ্ত নিষ্ক্রিয় ডিম থেকে লার্ভা উৎপন্ন হয়ে থাকে। পরিপক্ব লার্ভা থেকে পরবর্তী পর্যায় হল পিউপা বা কোকুন বা মুককীট। তা থেকেই খোলস পরিবর্তনের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ মশা বের হয়ে আসে। পিউপাগুলোও পানিবিহীন শুষ্ক অবস্থায় কয়েক মাস জীবন্ত থাকতে পারে।

স্ত্রী এডিস মশা দিবাভাগে কামড় দিতে লুকিয়ে থাকা স্থান থেকে বের হয়ে আসে এবং কাছাকাছি যাকে পায় তাকেই পটাপট কামড় বসিয়ে দেয়। সাধারণত সূর্য ওঠার পর দুই ঘণ্টা এবং সূর্য অস্ত যাওয়ার আগে ২-৩ ঘণ্টা এই মশা চলাচলের উপযুক্ত সময়। মানুষের নিুাঙ্গের অর্ধেক অর্থাৎ হাঁটু থেকে নিচের অংশে এবং ঊর্ধ্বাঙ্গের অর্ধেক অর্থাৎ কনুই থেকে নিচের অংশে স্ত্রী এডিস মশার পছন্দসই কামড় দেয়ার স্থান। আক্রমণের কায়দাটাও বিচিত্র।

সামনে থেকে নয়, এরা উড়ে আসে পেছন দিক থেকে নিঃশব্দে। তাই মানুষের দেখতে পাওয়ার আগেই দ্রুততার সঙ্গে কামড় বসিয়ে দেয়। এক্ষেত্রে মানুষ কামড় খাওয়া থেকে সতর্ক হওয়ার সুযোগ কম পায়। অল্প সময়ে ঘরের অনেক মানুষকে যেমন কামড়াতে পারে, আবার একই লোককে এক সুযোগেই অনেকবার কামড় দিয়ে দেয়।

এবার ডেঙ্গু ভাইরাস কতটা ক্ষমতাধর, সে বিষয়ে আলোকপাত করা যাক। ডেঙ্গু ভাইরাস গঠনশৈলীতে খুব সুনিপুণ দেহের কেন্দ্রে ‘আরএনএ’ নামক এক ধরনের নিউক্লেয়িক এসিড থাকে, যা চারপাশ দিয়ে ক্যাপসিড আবরণী এবং আরও বাইরে এনভেলাপ ঝিল্লি বেষ্টিত থাকে। ক্যাপসিড এবং এনভেলাপ সুবিন্যস্ত ও সুগঠিত রাসায়নিক অণু দ্বারা সংগঠিত। এই জাতীয় অণুগুলো প্রোটিন ধর্মী হয়ে থাকে।

এনভেলাপে ‘ই’ প্রোটিন নামে অণু, যার মাধ্যমে ডেঙ্গু ভাইরাস তার পছন্দের মানবকোষগুলোর গায়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বন্ধন তৈরি করে এবং এন্ডোসাইটোসিস পদ্ধতির মাধ্যমে কোষের ভেতরস্থ সাইটোপ্লাজমে ঢুকে যায়। ফলে কোষটি হয়ে পড়ে রোগাক্রান্ত এবং ভাইরাস ওই কোষের নিজস্ব শক্তি অণুগুলো ব্যবহার করে নিজের বংশবিস্তার চালাতে থাকে বেশুমার। সৃষ্টির সেরা মানুষের দেহেও তো শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়ার মাধ্যমে ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ কর্মকাণ্ড দেখা দেয়।

কিছু কিছু বিশেষ মানবকোষ ওই ভাইরাস আক্রান্ত কোষগুলোকে শনাক্ত করে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ওই অসুস্থ কোষগুলোকে ভাইরাসসহ ধ্বংস করে ফেলে। আর এক ধরনের কোষ ওইসব ভাইরাস কণা থেকে সৃষ্ট বিশেষ এন্টিজেন শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে এন্টিবডি নামে শক্তিশালী অণু তৈরি করতে থাকে। ওই অণুগুলোই ইম্যুনোগ্লোবিওলিন সংক্ষেপে IgG, IgM ইত্যাদি নামে পরিচিত।

এই দুই পদ্ধতির ধারাবাহিকতায় নবপ্রজন্মের ভাইরাসগুলো সম্পূর্ণরূপে নিষ্ক্রিয় না হওয়া পর্যন্ত কিলার কোষ ও এন্টিবডির অস্ত্রে যুদ্ধ চলতে থাকে এবং মানুষ বিজয়ী হয়ে রোগমুক্ত যেমন হয়, তেমনি ভবিষ্যতে একই বহিঃশত্রু আবার প্রবেশ করলে তাকে শনাক্ত ও কাবু করার জন্য প্রতিরোধ অণু ও কোষ পর্যাপ্ত পরিমাণে উৎপন্ন করে সুপ্রস্তুত থাকে।

গঠনগত সামান্য ভিন্নতার কারণে ডেঙ্গু ভাইরাস চারটি সেরোটাইপের হয়ে থাকে। যথা- ডেনভি১, ডেনভি২, ডেনভি৩ এবং ডেনভি৪। যে কোনো এক সেরোটাইপ দিয়ে সংক্রমণ ঘটে গেলে ওই যাত্রায় আর অন্য কোনো সেরোটাইপ দিয়ে সংক্রমণ হয় না। একই সঙ্গে চারটি সেরোটাইপ দিয়ে সংক্রমণ হয় না। কিন্তু প্রাথমিক সংক্রমণ যে সেরোটাইপ দিয়ে হয়, পরে অন্য তিনটি সেরোটাইপ দিয়ে পৃথকভাবে আরও তিনবার ডেঙ্গুজ্বর হতে পারে। কারণ কোনো সেরোটাইপ একবার সংক্রমণ ঘটালে মানবদেহে তার বিরুদ্ধে চিরস্থায়ী প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়ে যায়।

কেননা, ওই সংক্রমণে সেরোটাইপের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট এন্টিবডি উৎপন্ন হয়, যারা ভাইরাসগুলোকে সম্পূর্ণরূপে নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম। আবার কিছু এন্টিবডি তৈরি হয়, যেগুলো ভাইরাসের এন্টিজেনের সঙ্গে বন্ধনে যুক্ত হয়; কিন্তু ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করতে পারে না। সেরোটাইপ ভিন্ন হলেও ডেঙ্গু ভাইরাসের আসল জাত (জেনাস) একটি। তাই কোনো একটি সেরোটাইপের সংক্রমণে যে এন্টিবডি উৎপন্ন হয়, তাদের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ এর অন্য সেরোটাইপ এন্টিজেনের সঙ্গে গাঠনিক সাম্যতার সম্পর্ক থাকে।

তাই বিশেষ সেরোটাইপের চলমান সংক্রমণে অন্য সেরোটাইপ মশার কামড়ে শরীরে ঢুকলেও তারা এন্টিবডির ক্রিয়ায় নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। রোগীর দেহে এই প্রতিরোধ ক্ষমতা ৬-৭ মাস পর্যন্ত কার্যকরী থাকতে পারে। তাই সাধারণত কোনো মৌসুমে যে কোনো একটি ডেঙ্গু সেরোটাইপ ভাইরাস দ্বারা ডেঙ্গুজ্বর হলে ওই মৌসুম বা বছরে অন্য সেরোটাইপ ডেঙ্গু ভাইরাস দ্বারা পুনঃসংক্রমণের আশঙ্কা খুবই কম।

২০০০-২০১৭ সালের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে ডেনভি-১ এবং ডেনভি-২ টাইপ ভাইরাস দিয়ে সংক্রমণ চলছিল। এরপর ডেনভি-৩ ডেঙ্গু ভাইরাস বাংলাদেশে প্রবেশ করে। সঙ্গে সঙ্গে ডেনভি-৩ ভাইরাস দিয়ে প্রাথমিক সংক্রমণ এবং পুনঃসংক্রমণ দুটোই বাড়তে থাকে। ২০১৯ সালের ডেঙ্গু রোগীর শরীর থেকে অধিকহারে ডেনভি-৩ এবং কিছু কিছু রোগী থেকে ডেনভি-৪ ভাইরাসও শনাক্ত হয়েছে। যার ফলে ডেনভি-৩ ও ডেনভি-৪ দিয়ে নতুন সংক্রমণ যেমন হচ্ছে, তেমনি পুনঃসংক্রমণও ঘটছে। ফলে শক সিনড্রোম, হেমোরেজিক ডেঙ্গু দুটোই বেশি হচ্ছে।

অস্বাভাবিক লক্ষণ হিসেবে এবার রক্তের তরল অংশ বেরিয়ে যাওয়ার ফলে শরীরে দানা দেখা না দিয়েই রোগীরা শকে চলে যাচ্ছে এবং অতি প্রয়োজনীয় অঙ্গগুলো আক্রান্ত হয়ে তাদের কর্মক্ষমতা নষ্ট করে দিচ্ছে। ডেঙ্গুর রোগী পরিপাকতন্ত্র আক্রান্তের জন্য পাতলা পায়খানা ও বমি নিয়ে আসছে, মতিষ্কে প্রদাহ হওয়ার জন্য জ্ঞানহারা অবস্থায় খিঁচুনিসহ আসছে, কিডনি অকেজো হওয়ায় প্রস্রাব না হওয়ার অভিযোগ নিয়ে আসছে। ক্ষতিগ্রস্ত লিভার নিয়ে আসছে, অগ্নাশয়ে প্রদাহের কারণে মারাত্মক পেটব্যথা নিয়ে আসছে।

তদুপরি ফুসফুসের ভেতর ও ফুসফুসের গহ্বরে তরল জমার জন্য শ্বাসকষ্ট নিয়ে আসছে, উদরগহ্বরে তরল পদার্থ জমা হওয়ার জন্য পেট ফোলা নিয়ে আসছে, হৃৎপিণ্ডের ঝিল্লি ও মাংসপেশিতে প্রদাহ হওয়ার জন্য তীব্র বুকব্যথা, শ্বাসকষ্ট ও অনিয়মিত হৃৎস্পন্দনের লক্ষণ নিয়ে আসছে। এমনকি হৃৎপিণ্ডের চারদিকে যে পেরিকার্ডিয়াল গহ্বর আছে, তাতেও তরল জমা হয়ে বুক ব্যথাসহ মারাত্মক উপসর্গ নিয়ে আসছে।

এ জাতীয় মরণাপন্ন ও সংকটাপন্ন রোগীদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রেখে ঘন ঘন পর্যবেক্ষণসহ বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবা প্রদান করতে হচ্ছে, যা সঙ্গত কারণেই কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল। তদুপরি নিবিড় পরিচর্যা চিকিৎসা ইউনিটের অপ্রতুলতা আমাদের সবারই একটি স্বীকার্য বিষয়। এসব কেন্দ্রে রোগীদের চিকিৎসা চলায় রোগীসহ তার পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজন সবারই দৈহিক ও মানসিক ভোগান্তি চরমে পৌঁছে যায়। তারপরেও অনেকেরই মৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।

পরিবারের বিশেষ কোনো সদস্যের মৃত্যু ঘটলে গোটা পরিবার এবং সংশ্লিষ্ট আত্মীয়স্বজনদের দৈনন্দিন জীবন পরিচালনায় নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়। এতে করে সামাজিক অস্থিরতা দেখা দেয়ার আশঙ্কা থাকে। স্বল্প পরিসরে ডেঙ্গু সম্পর্কিত যে বিবরণ দেয়া হল, তা পর্যালোচনা করে আমরা কতগুলো নতুন তথ্য, তত্ত্ব ও সুপারিশ উপস্থাপন করতে পারি-

১. আক্রান্ত রোগীর পরিবারের সদস্যদের ঝুঁকি বেশি, যদি বাসস্থানে এডিস মশার সংখ্যা ও প্রজনন কমানো না যায়।

২. ইতিপূর্বে যারা ডেনভি-১ বা ডেনভি-২ দিয়ে সংক্রমিত হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে ডেনভি-৩ বা ডেনভি-৪ সংক্রমণ হলেই বুঝতে হবে, রোগী রক্তক্ষরণ বা শক সিনড্রোমে ভুগছে।

৩. ডেনভি-৩ বা ডেনভি-৪ এর প্রাথমিক সংক্রমণের আশঙ্কা সব বয়সের মানুষের রয়েছে। কেননা বাংলাদেশের জনগণের জন্য এই দুটি সেরোটাইপ ডেঙ্গু ভাইরাস নবাগত বা নবউদ্ভূত। এই দুই সেরোটাইপের সংক্রমণের ফলে অস্বাভাবিক জটিলতাগুলো অধিকহারে এবং বেশ আগেভাগে দেখা দিচ্ছে বলেই রোগীদের হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন বেশি হচ্ছে।

৪. ডেনভি-১ ও ডেনভি-২ ডেঙ্গু ভাইরাস যেসব গ্রাহক অণু বা (রিসেপ্টর)-এর মাধ্যমে কোষে প্রবেশ করত, হয়তো ডেনভি-৩ ও ডেনভি-৪ ভাইরাস ওসবের বাইরেও আগের বিভিন্ন কোষকে নতুন কোনো রিসেপ্টর অণুর মাধ্যমে সংক্রমিত করছে। এই প্রস্তাবটির ওপর মানসম্পন্ন ও উচ্চতর পর্যায়ের গবেষণা কার্যক্রম হাতে নেয়া প্রয়োজন।

৫. দুই বছর আগে ঢাকা শহরে এডিসবাহিত চিকুনগুনিয়া ভাইরাসে বিপুলসংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাদের শরীরে এন্টি চিকুনগুনিয়া এন্টিবডি তৈরি হয়ে আছে, যার সঙ্গে ডেনভি-৩ বা ডেনভি-৪ এর গাঠনিক ও বিক্রিয়াগত সম্বন্ধ আছে কিনা, এ ব্যাপারে পর্যবেক্ষণের জন্য উচ্চতর গবেষণা করা আবশ্যক। কেননা আফ্রিকা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জনগণের ওপর পরিচালিত বেশ কয়েকটি গবেষণায় ডেনভি-১ ও ডেনভি-২ এর সঙ্গে চিকুনগুনিয়া ভাইরাসের একটি এন্টিজেনের বিরুদ্ধে উৎপন্ন হওয়া এন্টিবডিগুলোর মধ্যে ৬-৭ শতাংশের ডেনভি-১ ও ডেনভি-২ এর এন্টিবডির সঙ্গে গাঠনিক সামঞ্জস্য পাওয়া গেছে।

৬. ডেনভি-১ বা ডেনভি-২ এর কিছু কিছু এন্টিবডি ইতিপূর্বে উদঘাটিত ২-৫ শতাংশ পুনঃসংক্রমণের রোগীর চেয়ে ডেনভি-৩ বা ডেনভি-৪ এর নতুন সংক্রমিত রোগীতে আরও অধিক হারে মারাত্মক উপসর্গ ঘটছে কিনা, তাও গবেষণা করে দেখা সময়ের দাবি।

৭. তিন দিন পরপর এডিস মশা প্রজনন করতে পারে- এমন পাত্রের জমা পানি ফেলে দিলেই এডিস মশার সব ডিম অপসারিত নাও হতে পারে। পুনরায় ওই পাত্রে পানি দিলে বা জমলে রয়ে যাওয়া ডিমগুলো থেকে পূর্ণাঙ্গ এডিস মশা জন্ম নেয়ার আশঙ্কা আছে। তাই পারতপক্ষে পানি ফেলার সঙ্গে সঙ্গে পাত্রটি ব্রাশ বা শক্ত কাপড় দিয়ে ঘষে পরিষ্কার করাই উত্তম।

৮. ঘরের বাইরে যেসব উপকরণে এডিস মশা প্রজনন করতে পারে, সেগুলোকে শুধু অপসারণ করলেই চলবে না; ওইগুলোকে প্রকৃতভাবেই ধ্বংস করে ফেলতে হবে।

৯. পানি রাখার যেসব পাত্রে এডিস মশা ডিম পাড়তে পারে, প্রকৃত অর্থেই সার্বক্ষণিকভাবে সারাবছর ধরেই ওইগুলো ঢেকে রাখতে হবে।

১০. সকালের কর্মঘণ্টা পিছিয়ে এবং বিকালের কর্মঘণ্টা এগিয়ে নিয়ে এলেও এডিস মশা দ্বারা কামড় খাওয়ার আশঙ্কা সীমিত হবে।

১১. যেহেতু একটি সংক্রমিক মশা একবার কামড় দিলেই ডেঙ্গুজ্বর হতে পারে, সেহেতু একটি মশার কামড় দেয়ার ঘটনাও যেন না ঘটে; এরকম সতর্কতা ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিতে হবে।

১২. যার যার অবস্থান থেকেই মশা নিধন ও প্রজনন বন্ধের জন্য সচেতনতার সঙ্গে সুরক্ষিত হয়ে কাজ করতে হবে। শুনতে অন্যরকম মনে হলেও আপনি যদি একটি এডিস মশা আজকে মারতে পারেন, তাহলে ১৪ দিন পর ওই মশা থেকে জন্ম নেয়া ২৫০-৫০০টি নতুন মশার জন্ম বন্ধ করতে সক্ষম হবেন। সামগ্রিক চিন্তায় ব্যাপারটি মশার সংখ্যা সীমিত করার ক্ষেত্রে তাৎপর্য বহন করে।

১৩. সমন্বিত কর্মকাণ্ড দ্রুত ও মানসম্পন্নভাবে পরিচালনা, তদারকি ও পরিবীক্ষণের জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের জনবল নিয়ে একটি জাতীয় টাস্কফোর্স গঠন করা যেতে পারে। একইভাবে বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কার্যকর সমন্বয় কমিটি গঠন করার চিন্তা করা যেতে পারে।

১৪. চারটি সেরোটাইপ ডেঙ্গু ভাইরাসের বিরুদ্ধেই প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করতে পারে বা ডেঙ্গুর মারাত্মক লক্ষণ কমিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে না- এমন নিরাপদ ও কার্যকর টিকা পরীক্ষামূলকভাবে চালু করার সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে; যাতে ভবিষ্যতে সংকটাপন্ন অবস্থা মোকাবেলা করা কঠিন না হয়ে পড়ে।

ডেঙ্গু মহামারী আকারে যখন ছড়ায়, তখন দেখা যায়- চারটি সেরোটাইপের নতুন কোনো ডেঙ্গু ভাইরাস নতুন কোনো অঞ্চলে উদ্ভূত হয়ে সক্রিয়ভাবে সঞ্চালিত হতে থাকে। যেহেতু ইতিপূর্বে সেরোটাইপের সংক্রমণ ঘটেনি, সেজন্য সাধারণ জনগণের মধ্যে অন্যান্য সেরোটাইপের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকলেও নবউদ্ভূত সেরোটাইপের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে না। তাই সব বয়সের মানুষই নতুন ভাইরাস সেরোটাইপে আক্রান্ত হতে পারে। তবে প্রচুরসংখ্যক শিশু-কিশোর ও মাঝবয়সী মানুষ আক্রান্ত হয়।

নতুন সেরোটাইপ দ্বারা জনসংখ্যার ২৫-৫০ শতাংশ পর্যন্ত আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। যেহেতু ডেনভি-৩ ও ডেনভি-৪ এ অঞ্চলে নবোদ্ভূত ভাইরাস, তাই বর্তমান সংক্রমণের হার ও রোগ ছড়ানোর গতি বিবেচনায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি মহামারী না হলেও মহামারীর দ্বারপ্রান্তে। অন্যদিকে, যেসব অঞ্চলে ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি সেরোটাইপ দিয়ে সারাবছর ধরেই সীমিতহারে মানুষ সংক্রমিত হয় এবং এডিস মশার উপযোগী প্রজনন মৌসুমে ডেঙ্গুর সংক্রমণ হার ও জটিলতা বেশি দেখা দেয়- সে প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ২০১৭ সাল থেকে যেহেতু ডেনভি-৩ এবং সম্ভবত ডেনভি-৪ অল্পহারে বাংলাদেশে সংক্রমণ ঘটিয়ে আসছিল; যার চরম প্রকাশ ঘটেছে ২০১৯ সালের মধ্যবর্তী সময়ে এসে।

কাজেই এবারের ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবকে ‘হাইপার এন্ডেমিক বা মাত্রাতিরিক্ত হারে স্থানীয় সঞ্চালন’ ক্যাটাগরি হিসেবে দেখাই ভালো। তাই মহামারী মোকাবেলার জন্য বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা মতোই সামগ্রিক প্রস্তুতি ও কার্যক্রম গ্রহণ করা সমীচীন হবে।

ডা. আবুল খায়ের মো. শামসুজ্জামান : মাইক্রোবায়োলজির অধ্যাপক, মুগদা মেডিকেল কলেজে কর্মরত

ওডি/এসএস

চলমান আলোচিত ঘটনা বা দৃষ্টি আকর্ষণযোগ্য সমসাময়িক বিষয়ে আপনার মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাই, সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইলকরুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড