• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ভাষার রাজনীতি, রাজনীতির ভাষা

  মো. রাকিবুল ইসলাম

২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৮:০৬
প্রতীকী
ছবি : প্রতীকী

এই লেখাটি যখন লিখছি তখন একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহর। ভাষা আন্দোলনে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে মায়ের ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করার দিন। ১৯৫২ থেকে যে আন্দোলন সংগ্রামের বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিলো ১৯৭১ এ তা মহীরুহ হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে। ৫২ থেকে ৭১ এই সময়ের পট পরিবর্তনে আন্দোলন সংগ্রামের ভাষা ছিল গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক।

৫২ এর 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' থেকে ৭১ এর 'তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা' স্লোগান কিংবা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্তে আগুন লাগানো কালজয়ী ভাষণ 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম' সবই ভাষাগত উৎকর্ষতায় দেশ কাল অতিক্রম করেছে বহু আগে। এই ভাষা মানুষের ভাষা এই ভাষা সংগ্রামের ভাষা, সমকালীন রাজনীতির ভাষা।

স্লোগান হোক কিংবা ভাষণ হোক রাজনীতির এই ভাষা যেনও যুগে যুগে নিপীড়িত মানুষের ভাষা হয়ে উঠেছে। আন্দোলন রাজনীতির এই ভাষা গণ মানুষের মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করেছে। নিপীড়িত বঞ্চিত মানুষের ভাষা ধ্বনিত হয়েছে তৎকালীন রাজনৈতিক নেতা, ছাত্র নেতাদের কণ্ঠে। রাজনীতির এই ভাষা ছিল চাতুর্যপূর্ণ ও জনগণের জন্য দিক নির্দেশনামূলক। 'আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি… ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল' এই ভাষা একই সাথে দূরদর্শী ও দিকনির্দেশনামূলক।

দেশ স্বাধীন হয়েছে বহুদিন হলো, ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপিত হবে কিন্তু এই সময়ে রাজনীতির ভাষায় এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। ৭১ পরবর্তী সময়ে নব্বইয়ের দশকেও আন্দোলনের ভাষা রাজনীতির ভাষা ছিল জনগণের মনের ভাষা। ওই সময়ের রাজনৈতিক কর্মসূচি কিংবা রাজনৈতিক বক্তব্য সবকিছুই তার প্রতিফলন ঘটায়। যেনও জনগণ রাজনৈতিক দলের ভাষা পড়তে পারে আবার রাজনৈতিক দলগুলোও জনগণের ভাষা পড়তে পারে। এর পিছনের কারণ হচ্ছে সত্যিকার অর্থেই রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে জনগণের সম্পৃক্ততা। নব্বই পরবর্তী রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহে রাজনীতির ভাষা একই সাথে একঘেয়ে এবং দুর্বোধ্য হয়ে পড়ছে দিনে দিনে। গঠনমূলক সমালোচনা কিংবা চমক সৃষ্টিকারী কোন কর্মসূচি প্রদান না করে এক দোষারোপের রাজনীতি শুরু হয়েছে অনেক আগে। বিরোধী দল শুধু মাত্র সরকারী দলের বিরোধিতা করার জন্যই সমালোচনা করবে আর সরকার কেবল সব কিছুতে বিরোধীদলের যোগসাজশ খুঁজবে এ যেন এক অলিখিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বর্তমানে যে ধারা আমরা দেখতে পাই তাতে জনগণের মনের ভাষার প্রতিফলন নেই। যেকোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর বিরোধী দল বিবৃতি দিবে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। অপরদিকে সরকার নির্বাচন কমিশন ও জনগণকে ধন্যবাদ দিবে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য। সরকারের গৃহীত সকল কর্মসূচির একযোগে বিরোধিতা করার সংস্কৃতিও আমরা লক্ষ্য করছি। কোন কিছুই ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। সর্বক্ষেত্রে সমালোচনার ভাষা হওয়া উচিত গঠনমূলক এবং দিকনির্দেশনামূলক। রাজনীতির ভাষা এমন হওয়া উচিত যা জনগণের মনে আশা সঞ্চার করে। 'চুপ বেয়াদপ' কিংবা 'খামোশ' আর যাই হোক রাজনীতির ভাষা হতে পারে না। রাজনীতি হোক শুদ্ধ আর তার ভাষা হোক পরিশীলিত।

কেনো যেনও মানুষ এখন রাজনীতির ভাষার প্রতি আস্থাহীনতায় ভুগছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে জনগণের একটা অবিশ্বাস ও অনাস্থার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এটি উন্নয়নের জন্য অশনি সংকেত। কারণ রাজনৈতিক দলের মূল শক্তি তার সমর্থক জনগোষ্ঠী, এই বিশাল জনগোষ্ঠীর মনের ভাষা যদি রাজনৈতিক দল ও তার নেতাদের মুখে ধ্বনিত না হয় তবে যে অনাস্থা তৈরি হবে সেটি ধীরে ধীরে রাজনীতিকে জনগণের থেকে অনেক দূরে নিয়ে যাবে। রাজনীতি হয়ে যাবে গোষ্ঠী কেন্দ্রিক। রাজনীতির এই দুর্বৃত্তায়ন কাম্য নয়। এই ক্ষেত্রে আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হলে সবার আগে প্রয়োজন রাজনীতির ভাষার সংস্কার। ভাষাগত উৎকর্ষতা দিয়ে রাজনীতিতে নতুন ধারার সৃষ্টি করতে হবে। রাজনীতির ভাষা এমন হবে যা মানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার করবে।

ডিজিটাল বাংলাদেশ কিংবা ভিশন ২০২১ কিংবা রূপকল্প ২০৪১ এইসব ভাষা আমাদের নতুন করে বাংলাদেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখায়। ভিশন ২০২১ এবং ডিজিটাল বাংলাদেশের নতুন ভাষা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে বিপুল জনসমর্থন পেতে সাহায্য করেছিলো। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও ভাষা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বারাক ওবামার 'চেঞ্জ উই নিড' অথবা বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনি স্লোগান 'আমেরিকা ফার্স্ট' রাজনীতিতে ভাষার ব্যবহার কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা নির্দেশ করে। এই স্লোগানের ভাষাগুলো তাদের জনগণের ভাষাকে প্রতিনিধিত্ব করছে বলেই জনসমর্থন পেয়েছে। আমাদের দেশেও অর্থহীন ভাষার ব্যবহার এবং ফাঁকা বুলি সর্বস্ব রাজনীতি না হয়ে গঠনমূলক ভাষা ব্যবহার শুরু হওয়া এখন সময়ের দাবি।

রাজনীতির ভাষা হোক স্বপ্ন দেখার ও স্বপ্ন দেখানোর ভাষা। জাতির জনক তার রাজনীতির ভাষা দিয়েই জনগণকে বুঝাতে পেরেছিলেন একটি স্বাধীন দেশের স্বপ্ন। তার আদর্শকেই সামনে রেখে শুধু সমালোচনা করার জন্য নয়, রাজনীতির ভাষা হোক পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ মিশ্রিত পরিশীলিত ভাষা, জনগণের ভাষা। তবেই রাজনীতি হবে জন সম্পৃক্ত এবং রাজনৈতিক দল হবে দেশকে নিয়ে মানুষের স্বপ্ন দেখার ও বাস্তবায়নের মাধ্যম।

লেখক : শিক্ষক, স্থানীয় সরকার ও নগর উন্নয়ন বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

চলমান আলোচিত ঘটনা বা দৃষ্টি আকর্ষণযোগ্য সমসাময়িক বিষয়ে আপনার মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাই, সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইলকরুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড