• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

সমাধি পরে দীপ জ্বেলেছিল!

  রহমান মৃধা

১০ এপ্রিল ২০২৩, ১৪:৪৭
সমাধি পরে দীপ জ্বেলেছিল!
ফাইজারের প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্টের সাবেক পরিচালক রহমান মৃধা (ছবি : সংগৃহীত)

ছাত্রজীবনে ছুটিতে বৃদ্ধাশ্রমে কাজ করেছি। বৃদ্ধাশ্রমে যে কাজগুলো করতাম তা ছিল যেমন পার্ক বা লেকের ধারে বসে বসে গল্প শোনা এবং গল্প বলা। অর্থ রোজগার করা উদ্দেশ্য থাকা সত্ত্বেও আরও দুটো বিষয় শিখেছি। একটি ভাষা, অন্যটি সুইডিশ জাতির মেন্টালিটি সম্পর্কে অবগত হওয়া। একটি নতুন দেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে শেখা কিন্তু সহজ নয়, তবে আমার মনে হয় বৃদ্ধাশ্রমে কাজ করতে পারার সুবাদে আমি বেশ সহজে ছোট-বড় সবার সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করে বসবাস করতে শিখেছি।

গুনিলা আমার প্রতিবেশী, মাঝে মধ্যে চা-কফির আড্ডায় অনেক কথা বলে। আজ তার জীবনের কিছু সুখ-দুখের ঘটনা শেয়ার করল। তখন মনে হলো আমাদের দেশে যারা বয়স্ক তাদের জীবনেও তো ঘটে যাওয়া রোমান্টিক, বিরহ কত কী না জমা হয়ে আছে, যা আমরা জানতে পারি এবং জানার মাধ্যমে শিখতে পারি। তাছাড়া ঘটনাটি আমার হৃদয় ছুঁয়েছে এবং ভালোও লেগেছে, মূলত সেই উদ্দেশ্যে ঘটনাটি শেয়ার করলাম।

গুনিলার বয়স তখন ১৭ বছর। প্রেমে পড়েছে এক সমবয়সী ছেলের। অল্প বয়সে প্রেম, তারপর দরিদ্র পরিবারের ছেলে। লেখাপড়ার প্রতি তেমন মনোযোগী না, তবে ভালো চিত্রাঙ্কন করে। সে যুগে (১৯৩৬) কে ছবির মূল্যায়ন করে, তাছাড়া যদি নামকরা কেও না হয় তবে চিত্রাঙ্কন ভালো হলেও সমাজে সেটার মূল্য খুবই কম। ঘটনাটি আজ থেকে ৮৭ বছর আগের। গুনিলা তার বয়ফ্রেন্ড মাটসের সঙ্গে যাতে যোগাযোগ না করতে পারে সে জন্য তাকে জার্মানিতে বাবার কাছে পাঠানো হয়।

গুনিলার বাবা কর্নেল রুনে, তখন জার্মান মিলিটারি একাডেমিতে কর্মরত। গুনিলার মা ডাক্তার বিরগিত স্টকহোম সদর হাসপাতালে চাকরিরত। সময়ের সাথে জীবনের পরিবর্তন, পরিবর্তন মনেরও। ১৯৩৮ সালে গুনিলার বাবা জার্মান বংশোদ্ভূত এক আর্মি অফিসারের সঙ্গে গুনিলার বিয়ে দেয়। বিয়ের ছয় মাস পর গুনিলা দীর্ঘ প্রায় দুই বছর পর স্টকহোমে মার কাছে বেড়াতে আসে। মা-মেয়ের ছুটির সময়টি বেশ চলছে মন্দ না। গুনিলা স্টকহোম শহরের শপিং মলে কিছু কেনাকাটি করতে এসেছে, তাকে জার্মানিতে ফিরতে হবে। হঠাৎ গুনিলার সঙ্গে তার সেই পুরনো বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে দেখা। গুনিলা তার জীবনের প্রথম প্রেমিক মাটসকে দেখে বেশ আপ্লুত হয়ে পড়ে। নতুন করে পুরনো ইতিহাস একের পর এর ভাসতে থাকে হৃদয়ে। তাদের দুজনার মাঝে কথা বিনিময় হয়। গুনিলার জার্মান ফিরে যাবার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তারা একে অপরের সঙ্গে কয়েকবার দেখা করে। মাটস একজন চিত্রাঙ্কন শিল্পী, ছবি যখন আঁকে স্বাভাবিক ভাবেই গুনিলার হৃদয়ে তার ছবি সারা জীবনের মত এঁকে দিয়েছে, তা নাহলে বিবাহিত গুনিলা কেন বার বার মাটসের সঙ্গে দেখা করবে! মাটস তখনও বিয়ে করেনি, তারপর ছোটবেলার প্রেম খুবই স্বাভাবিক গুনিলাকে সে ভোলেনি। গুনিলার যাবার সময় হয়েছে সে মাটসের থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে যায় জার্মানিতে।

কিছুদিন যেতেই গুনিলার জার্মান স্বামী মাইকেলের বদলি হয় মিউনিক থেকে বার্লিনে। গুনিলা কলেজ শেষে চাকরি নিয়েছে ব্যাংকে। চলছে তাদের সংসার। এ দিকে শুরু হয়েছে বিশ্বযুদ্ধ কি করা? মাইকেল যুদ্ধে নেমেছে। এর মাঝে গুনিলা মা হতে চলেছে। সময়ের সাথে গুনিলা এবং মাইকেলের সংসারে কন্যা সন্তানের জন্ম নেয় এবং কন্যার নাম রাখে ক্লাওডিয়া। যুদ্ধের শেষের দিকে গুনিলার বাবা কর্নেল রুনে এবং স্বামী কাপ্টেন মাইকেলের জীবনের (১৯৪৫) বাতি নিভে যায়। গুনিলা একই সময় হারায় বাবা এবং স্বামীকে, আর তার সদ্য জন্ম নেওয়া মেয়ে ক্লাওডিয়া হারায় তার বাবাকে এটাই সবাই জানে।

এমন একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ে কি করবে গুনিলা ভেবে আকুল, শেষে সিদ্ধান্ত নেয় সুইডেনে তার মা বিরগিদের কাছে ফিরে আসার। বিরগিদও বেশ ভেঙ্গে পড়েছে যদিও বিরগিদের সঙ্গে রুনের ছাড়াছাড়ি গুনিলার জন্মের দশ বছর যেতেই, যার ফলে গুনিলার বাবা রুনে তার জন্মভূমি জার্মানিতে ফিরে যায় এবং আর্মিতে যোগদান করে।

গুনিলার মা বিরগিদ জীবনে আর দ্বিতীয়বার বিয়ে করেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ওয়েস্ট ইউরোপের ছেলে-মেয়েরা মেলা-মেশা থেকে শুরু করে বিয়ে-স্বাধী করা, এক দেশ থেকে অন্যদেশে বসত করা, চাকরি করা - এগুলোকে অনেকটা ‘অ্যাডভেঞ্চার’ হিসাবে দেখত। যাইহোক গুনিলা স্টকহোমে মুভ করে। জীবনের মেঘ ভাগ্য থেকে সরতে শুরু করে। নানি বিরগিদ, মা গুনিলা, মেয়ে ক্লাওডিয়ার নতুন জীবন শুরু হয় স্টকহোমে। ক্লাওডিয়া স্কুলে যেতে শুরু করে, গুনিলাও নতুন করে ব্যাংকে জয়েন করে। জীবন চলছে তার গতিতে। গুনিলার একাকীত্ব জীবনের শূন্যস্থান পূর্ণ্য হয়। দেখতে দেখতে কখন ক্লাওডিয়া ১৫ বছর পার করেছে তা কল্পনাও করতে পারেনি কেও। নানি বিরগিদের অবসর জীবন কাটছে গুনিলা এবং ক্লাওডিয়ার সঙ্গ, আর কি চায়!

গুনিলা বিয়ে করেনি তবে তার সেই পুরনো বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে সম্পর্ক সুইডেনে ফেরার পরপরই বেশ চেগাল দিয়ে উঠে। মা বিরগিদ তখন আর তাদের মেলামেশায় তেমন আপত্তি করে নি, মানে সম্পর্কটাকে মেনে নিয়েছে। এদিকে ক্লাওডিয়া খুব অল্প বয়সে বাবা হারিয়েছে বটে তবে তার কাছে গুনিলার বয়ফ্রেন্ড মাটসই তার বাবা, এমনটি সম্পর্ক তাদের মাঝে।

এ দিকে মাটস দিনের পর দিন চিত্রাঙ্কনে বেশ খ্যাতি অর্জন করতে শুরু করে এবং পরে কোন এক সময় মাটস প্যারিসে মুভ করে এবং সেখানে সে নতুন সম্পর্কে জড়িত হয়ে পড়ে। একদিন গুনিলা মাটসকে ছেড়ে যেমন চলে গিয়েছিল সেও এত বছর পর ঠিক তেমন একটি কাজ করল।

গুনিলা বিষয়টি মেনে নিয়েছে তবে ক্লাওডিয়া কিছুটা ভেঙ্গে পড়ে, কিছু দিন যেতে ক্লাওডিয়ার শরীর খারাপ হতে থাকে। কোন এক সময় ডাক্তারের কাছে ক্লাওডিয়াকে পাঠানো হয়। নানা ধরনের পরীক্ষা- নিরীক্ষা শেষে জানা যায় ক্লাওডিয়ার ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে। খবরটি শুনে গুনিলা ভেঙ্গে পড়ে। প্রচুর অর্থের প্রয়োজন ক্লাওডিয়ার চিকিৎসার জন্য। স্বামী, বাবা বহু বছর আগেই মারা গেছে।

গুনিলার সংসার দিনে আনা দিনে খাওয়ার মত অবস্থা। কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। এমন সময় দিশেহারা হয়ে শেষে গুনিলা প্যারিসে আসে এবং তার পুরনো বয়ফ্রেন্ড মাটসকে ক্লাওডিয়ার ক্যান্সারের কথা বলে। গুনিলা এও বলে মাটসের ব্লাডগ্রুপের সঙ্গে ক্লাওডিয়ার রক্তের মিল রয়েছে।

বিষয়টি মাটসকে বেশ ভাবিয়ে তোলে। পরে মাটসকে গুনিলা মনের গভীরের সেই অজানা সত্য ঘটনা তুলে ধরে। — মাটস, আমার বাবা-মা তোমাকে মেনে নেয়নি বলে তোমাকে ছেড়ে আমি ঠিকই জার্মানিতে চলে যাই, বিয়ে করি। তোমার ভালোবাসার মূল্যায়ন সেদিন দিতে পারিনি সত্যি কিন্তু বিয়ের দুই বছর পর হঠাৎ তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে স্টকহোমের শপিং মলে। তারপর তোমার সঙ্গে আমার দৈহিক সম্পর্ক হয়েছিল শুধুমাত্র দুটি কারণে। প্রথমত, আমার গভীর ভালেবাসা তোমার প্রতি তখনও ছিল তাই বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও তোমার সঙ্গে এক রাত কাটিয়েছিলাম। দ্বিতীয়ত, আমার মনে হয়েছিল যে অবিচার আমি এবং আমার বাবা-মা করেছি তোমার প্রতি, তার ঋণ কিছুটা হলেও শোধ হবে।

চিন্তা করিনি সেদিন কি হবে বা কি না হবে তবে তোমাকে ভালোবেসেছিলাম হৃদয় থেকে। পরে বুক ভরা ব্যথা নিয়ে জার্মানিতে ফিরে যাবার কিছুদিন পর জানতে পারি আমি প্রেগন্যান্ট। বিষয়টি আমি তখনই আমার স্বামী মাইকেলকে খুলে বলি। কারণ আমার দুই বছরের সংসারে মাইকেলের সঙ্গে আমার সন্তান না হবার কারণ মাইকেল কোন দিন বাবা হতে পারবে না সেটা মাইকেল জানতো।

আমার লুকানোর কোন সুযোগ ছিল না। আমি ইচ্ছে করলে বাচ্চা এবরশন করতে পারতাম, পারতাম মাইকেলকেও না জানাতে কিন্তু আমি তা করিনি। তোমাকে হারানোর বেদনা আমাকেও কাঁদিয়েছে অনেক। পরে যখন প্রেগন্যান্টের খবর পেলাম তখন মনে হয়েছিল তোমার সন্তানকে নিয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দেব আমার গোপন ভালোবাসার মধ্য দিয়ে। তারপর বিশ্ব যুদ্ধে মারা গেল মাইকেল। আমি ফিরে এলাম সুইডেনে, খুঁজে পেলাম তোমাকে। সুখেই তো ছিলাম তোমাকে নিয়ে। আজ এত বছর পর অর্থ ও সমাজের উঁচু এলিট সমাজে উঠে তুমিও তো ঠিক আমার বাবা-মার মত সব ভুলে আমাকে, ক্লাওডিয়াকে ফেলে আজ প্যারিসে নতুন আভিজাত্য পরিবারে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছো!

তাহলে কি পার্থক্য থাকলো তোমার আর আমার বাবা-মার সঙ্গে? আমি হয়ত তোমাকে কোন দিনই বলতাম না আমার গোপন প্রেমের কথা, ক্লাওডিয়ার কথা কিন্তু ক্লাওডিয়া আজ মৃত্যু শয্যায়, এক বার তার কাছে এসে তোমার ভালোবাসার দুটো হাত তার মুখের উপর স্পর্শ করে এসো প্লিজ।

কথাগুলো বলে গুনিলা প্যারিস ছেড়ে সুইডেনে ফিরে এসে জানতে পারে ক্নাওডিয়া হাসপাতালে। তাড়াহুড়ো করে হাসপাতালে আসলেও দেখা মেলেনি ক্লাওডিয়ার সাথে। ক্লাওডিয়াকে বাঁচাতে পারেনি ক্যান্সার থেকে। কিছুদিন যেতে মাটস ফিরে এসেছিল সুইডেনে, ফিরে এসেছিল গুনিলার শূন্য হৃদয়ে, কিন্তু ভালোবাসার হাত দুটো বোলাতে পারেনি ক্লাওডিয়ার মুখে এবং বলতে পারেনি সে তার রিয়েল বাবা।

ক্লাওডিয়ার জীবনে দীপ জ্বালাতে পারেনি মাটস তবে সমাধি পরে জ্বেলেছিল সে দীপ আর দিয়েছিল এক গুচ্ছ ফুলের মালা।

লেখক : রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন।

[email protected]

চলমান আলোচিত ঘটনা বা দৃষ্টি আকর্ষণযোগ্য সমসাময়িক বিষয়ে আপনার মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাই, সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইলকরুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড