• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

জাগো বাংলাদেশ জাগো, নতুন করে ভাবো

  রহমান মৃধা

০৬ এপ্রিল ২০২৩, ১২:৪৭
জাগো বাংলাদেশ জাগো, নতুন করে ভাবো
ফাইজারের প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্টের সাবেক পরিচালক রহমান মৃধার ‘আমার বাংলাদেশ’ ও ‘জাগো বাংলাদেশ’ বইয়ের প্রচ্ছদ (ছবি : সংগৃহীত)

দেশ এবং দেশের মানুষকে পরাধীন থেকে স্বাধীন করার পিছে যে ক্ষোভ, আক্ষেপ বা যুক্তিগুলো আমাদের ছিল যেমন ছয় দফা থেকে শুরু করে নানা ধরনের শর্তাবলি, তার মধ্যে কি পড়ে যে আমরা স্বাধীন হলে দুর্নীতি, ভোটচুরি, সরকারি কর্মচারীর কাছে জিম্মি, নিজ দেশে পরাধীন, হুন্ডি, মানি লন্ডারিং, গুম, ভেজাল- এর সব কিছু করব এবং বাঁক স্বাধীনতা হারাব?

না, কথা ছিল একটি বাংলাদেশ আমরা গড়ব যেখানে ধর্ম, বর্ণ, হিংসা-বিদ্বেষ, ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবাই এক সঙ্গে বসবাস করব, সুখ-শান্তিতে এবং আমাদের জাতিয় সঙ্গীত “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি” এই প্রতিজ্ঞায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে দেশকে সোনার বাংলা করব।

এতদিন দেশের অনেকে আমাকে অপছন্দ করে আসছে আমার সমালোচনা মূলক লেখার কারণে, এবার দেশের বাইরে যারা বসবাস করছে তাদের মধ্যে অনেকে আমার প্রতি মনঃক্ষুণ্ণ হবে এবং আমাকে অপছন্দ করবে। কারণ আজ যা তুলে ধরব সেটা সবাই জেনে যাবে এবং এই অপ্রিয় সত্যকে জানার পর অনেকে কিছুটা মনে কষ্ট পাবে। আমি রমজান মাসে বিষয়টি নিয়ে বেশ ভাবতে শুরু করেছি।

আমরা রুচি অরুচি নিয়ে ইদানীং বেশ আলোচনা সমালোচনা করছি। ভালো কথা, কিন্তু যারা আমরা দেশে এবং বিদেশে বসবাস করছি তাদের বেশির ভাগই বেশ শিক্ষিত, দেখতে নাদুস- নুদুস, ভালো পরিবারের সন্তান, মানে উচ্চ রুচি সম্পন্ন বা এলিট শ্রেণির নাগরিক। অথচ আমরা দেশের অর্থ বিদেশে দিব্বি পাচার করছি নানা অসৎ উপায়ে, এটা কি রুচির মধ্যেই পড়ে?

তাই যদি হয় তবে অরুচি বলতে আমরা কি বুঝাতে চাইছি! আমরা বলছি আমাদের পরিবর্তন হওয়া দরকার। পরিবর্তন হওয়া মানে ভালো থেকে খারাপ নয় বরং খারাপ থেকে ভালো হবার কথা বোঝানো হয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে দেশের একটি আলোচিত ইস্যু রিজার্ভ সঙ্কট। রিজার্ভ সঙ্কটের জন্য রফতানির থেকে আমদানি বেশি হওয়ার পাশাপাশি আলোচিত হচ্ছে দেশ থেকে টাকা পাচার ও বিদেশ থেকে অবৈধ পথে দেশে টাকা পাঠানোর বিষয়টি। আর এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে হুন্ডির নাম। বলা হচ্ছে, দেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচার এবং বিদেশ থেকে অবৈধভাবে দেশে রেমিট্যান্স ঢুকছে মূলত হুন্ডির মাধ্যমে। এর ফলে সরকার একদিকে বঞ্চিত হচ্ছে বিপুল অঙ্কের রাজস্ব থেকে। পাশাপাশি প্রবাসীরা তাদের আয় দেশে পাঠালেও হুন্ডির কারণে তা যোগ হচ্ছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডারে।

সরকারের কোনো পদক্ষেপেই থামছে না হুন্ডির দৌরাত্ম্য। বরং প্রযুক্তির সহায়তা এবং মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দিন দিন আরও বেড়ে উঠছে হুন্ডির কারবার।

হুন্ডি কী?

চোরা চালানি, সরকারকে ফাঁকি দিয়ে ব্যাংকিং পদ্ধতির বাইরের অর্থ লেনদেনের একটি উপায়। একে বাণিজ্যিক আদান প্রদান ও লেনদেনের অনানুষ্ঠানিক দলিলও বলা যেতে পারে। যার মাধ্যমে দুই পক্ষ বা ব্যক্তির মধ্যে টাকা লেনদেন হয়। বিশ্বের প্রচলিত ব্যাংকিং পদ্ধতির অনুসরণ হয় না বলে হুন্ডির লেনদেনে দেশের সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়।

মধ্য যুগে ভারতে সম্পদ লেনদেনের জন্য প্রথম এই পদ্ধতির সূচনা হয়। বর্তমানে বৈধ পদ্ধতি এড়িয়ে বিদেশে টাকা পাচার এবং বিদেশ থেকে দেশে টাকা আনার কাজে হুন্ডি পদ্ধতিকে ব্যবহার করা হচ্ছে।

তারপর চলছে মানি লন্ডারিং!

কোনো অবৈধ অর্থকে বৈধ করাকে মানি লন্ডারিং বলা হয় বা যে প্রক্রিয়ায় কালো টাকা অর্থ লেনদেনের একটি কাহিনী বৃত্তের মধ্যে প্রবেশ করানো হয় তথা বিশোধিত করা হয়, যাতে তা অন্য প্রান্ত দিয়ে বৈধ অর্থ তথা সাদা টাকা হিসেবে বেরিয়ে আসে, অন্যভাবে বললে, বেআইনিভাবে প্রাপ্ত অর্থের উৎস পর্যায়ক্রমে স্থানান্তর এবং লেনদেনের মাধ্যমে গোপন করা হয়, যাতে সেই একই অর্থ শেষ পর্যন্ত বৈধ আয় হিসেবে দেখানো যায়। এটাও নিশ্চিত কোনো ভালো রুচির পরিচয় না।

আমরা শুধু দেশের মানুষকে ছোট করে দেখি, তাদের দোষ ত্রুটি নিয়ে কথা বলি। অথচ আমরা যারা বিদেশে বসবাস করছি আমরা কেমন মানুষ?

হুন্ডির সঙ্গে দেশের কিছু মানুষ জড়িত এখন তাদের সঙ্গে যারা দেশের বাইরে একাজ করছে তারও নিশ্চিত বাংলাদেশের মানুষ, তাহলে দেশের বাইরে আমরা যারা বসবাস করছি তারাও যে এক্ষেত্রে ভালো মানুষ না বললে নিশ্চয়ই ভুল হবে না।

এখন কথা আছে, আমার সম্পদ আমি খরচ করব সেটা নিয়ে কেন কথা উঠবে? এখানে সমস্যা হচ্ছে সরকার আইন করেছে যেমন দশ হাজার ডলারের বেশি অর্থ বিদেশে বৈধ ভাবে নেওয়া যাবে না। এখন অনেকে বিদেশে তার নিজস্ব অর্থ নিতে চায়, হতে পারে তার বা তার পরিবারের দরকার, সত্ত্বেও সে তার অর্থ নিতে পারছে না।

সে ক্ষেত্রে আইনকে নিজের হাতে তুলে নিয়ে বেআইনি ভাবে টাকা দেশ থেকে বের করতে বাধ্য হচ্ছে। এখন এই সুযোগে কিছু অসৎ লোক দেশ থেকে দুর্নীতি করে তাদের সেই দুর্নীতির অর্থ বিদেশে পাচার করে দেশকে ‘বটম লেস বাস্কেট বানাচ্ছে’।

আমি নিজে বহু বছর দেশের বাইরে। আমি সুইডেন থেকে দেশে অর্থ পাঠাই কখনও সুইডিশ সরকার আমাকে বাধা দেয়নি। আমি আমার সমস্ত সম্পদও যদি বাংলাদেশে পাঠাই কোনো সমস্যা নেই। অথচ বাংলাদেশে যে আমি এ যাবত ইনভেস্ট করলাম এখন আমার বৃদ্ধ বয়সে যদি আমার দরকারে সেই অর্থ কাজে লাগাতে না পারলাম তাহলে কি লাভ হলো আমার এতকিছু করে?

এ ধরনের সমস্যা একটি গ্রুপ বিদেশি বাংলাদেশিদের বেশ বিরক্তিকর করে তুলেছে। এই গ্রুপের মানুষগুলো এখনও অবৈধ পথে চলতে শুরু করেনি কিন্তু দেশ যদি এর কোন সমাধান না করে তবে শেষে এরাও আইন লঙ্ঘন করতে শুরু করবে। আমি বলেছি স্বাধীনতা মানে স্বাধীনতা, যেখানে নিয়ম কানুনে কোন ফাঁক বা ঝামেলা থাকবে না। দুর্নীতির টাকা পাচার করা সহজ।

কারণ সেটা অবৈধ টাকা, সে টাকা হুন্ডি করে পাঠাতে যদি অর্ধেক ঘুষ দিতে হয় সমস্যা নেই, কিন্তু যারা আজীবন কষ্ট করে কিছু সঞ্চয় করেছে সেই টাকা যদি হুন্ডির মাধ্যমে আনতে হয়ে এবং তার অর্ধেক যদি দালাল বা বাটপারদের দিতে হয় তাহলে কি ন্যায্য বিচার হলো?

দেশের সব সেক্টরে অন্যায়ের বন্যা বয়ে চলেছে। এই বন্যাকে বাঁধ দিয়েও ঠেকানো যাচ্ছে না দেশের দুর্বল অবকাঠামোর কারণে।

একটা দেশে রয়েছে চমৎকার একটি সংসদ ভবন, যেখানে দাড়িয়ে শুধু সেলফি তোলা হয়, আর তার ভেতরে কে স্বাধীনতার পাঠক আর কে ঘোষক ছিল সেই আলোচনা হয় সাথে পরস্পর পরস্পরকে গালাগালি এবং মাঝে মধ্যে নাচ গানও হয় শুনেছি এবং দেখেছি। এভাবে চলতে থাকলে সত্যি কার গণতন্ত্রের বেস্ট প্রাকটিস হবে কি?

যদি সেখানে ৩৫০ জন পলিসি মেকার সঠিকভাবে পলিসি তৈরি করত এবং যদি সেই যোগ্যতা তাদের থাকত তাহলে আমাকে এসব কথা লিখতে হতো না। এখন আমার এই লিখার কারণে দেখা যাবে অনেক অপ্রিয় সত্য কথা বেরিয়ে আসবে। সরকার এ সত্যকে হজম করতে পারবে না।

তখন উপায় না পেয়ে স্বৈরাচারী হবে, স্বাধীনতা এবং বাঁক স্বাধীনতাকে হরণ করে আমার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করবে। এই ভাবেই পুরো দেশটি চলছে। এর জন্য দায়ী অযোগ্য, রুচিহীন, বিনাভোটে পাশ করা দায়িত্বহীন জনগণের প্রতিনিধিরা। দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা নয় বরং জনগণের নিরাপত্তার ‘অভাব’ আইনের মামলা হওয়া দরকার এবং সেই মামলার কাঠগড়ায় সমস্ত আমলা সহ সংসদ সদস্যদের দেখতে চাই।

তা না-হলে কোনো লাভ হবে না মাঝে মধ্যে কিছু সাংবাদিক এবং সাধারণ জনগণকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা ফাঁসায়ে। হয়ত সীমিত সময় ক্ষমতার দাপট দেখানো যাবে তবে বাংলাকে স্বাধীন সোনার বাংলা করা যাবে না।

এমতাবস্থায় আমিও জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার টুর্কের মত উদ্বিগ্ন যে বাংলাদেশজুড়ে সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীদের গ্রেফতার, হয়রানি ও ভীতি প্রদর্শন এবং অনলাইনে সমালোচকদের কণ্ঠরোধ করতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহার করা হচ্ছে।

আমিও কর্তৃপক্ষের প্রতি অবিলম্বে এর প্রয়োগ স্থগিত এবং এই আইনকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে এর বিধানাবলিতে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার অনুরোধ জানাচ্ছি। এ ধরনের মানবাধিকার আইন অমান্য করে দেশের ইমেজকে নষ্ট করার কোন যুক্তি আছে বলে আমি মনে করিনে।

লেখক : রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন।

[email protected]

(মতামত পাতায় প্রকাশিত লেখা একান্ত লেখকের মত। এর সঙ্গে পত্রিকার সম্পাদকীয় নীতিমালার কোনো সম্পর্ক নেই।)

চলমান আলোচিত ঘটনা বা দৃষ্টি আকর্ষণযোগ্য সমসাময়িক বিষয়ে আপনার মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাই, সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইলকরুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড