• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৪ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

আমার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা

  শফিয়েল আলম সুমন

০৪ মার্চ ২০২৩, ২০:৩৭
আমার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ বাঙালিকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখাল। উত্তাল জনসমুদ্রে ঘোষণা করলো, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে? ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দিব এ দেশকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।

পাক হানাদার বাহিনী হায়েনার মতো হামলা করে একের পর এক বাঙালি নিধন যজ্ঞ শুরু করেছিল। বাঙালি দামাল ছেলেরা এর প্রতিবাদ করেছিল কঠোর ভাবে। ৭১ মুক্তিযুদ্ধে আমার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা এস এ কালাম মুক্তিযুদ্ধ করেছিল। রুখে দাঁড়িয়েছিল শত্রুর বিরুদ্ধে। অস্ত্র নেই, গোলা বারুদ নেই শুধু আছে সাহস।

৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর উদ্ধাক্ত আহবান- তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়েই শত্রুর মোকাবিলা কর।

বাবা বেশ কয়েকটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। ভাওয়ালাবাঝু যুদ্ধ, মল্লিক বাড়ি ভালুকা মুক্ত, চান পুরের যুদ্ধ, পাথাইরাবাদের যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য।

এর মধ্যে বাবা মুক্তিযুদ্ধেও মুখপাত্র জাগ্রত বাংলা পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। প্রথমে হাতে লিখে পরে সাইক্লোস্টাইলমেশিনে ছেপে। পত্রিকার কার্টুন, খবর খুবই জনপ্রিয়তা পায়।

১লা মার্চ থেকে মূলত সবকিছু চলছিল বঙ্গবন্ধুর আহবানে। স্কুলকলেজ শিল্প কারখানা বন্ধ। ৭ মার্চের ভাষণ এ আহবানে ঘি ঢেলে দিল জ্বলে উঠলো বাংলাদেশ।

দৌলার বাজারের বটতলায় বৈঠক বসলো। আজাদ সংঘের মাঠে ক্রলিংকরা বন্দুক হাতে সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার ট্রেনিং চলছিল। বাবাসহ সকল মুক্তিযোদ্ধা একত্রিত হল। ঢাকার ধ্বংস যজ্ঞ রেডিও ইন্ডিয়া ও বি, বি, সির মাধ্যমে প্রচার হয়ে গেছে। এখন প্রতিশোধ নিতে হবে। সবাই শপথ নিলো হয় মরবে নয় হানাদারদের উপযুক্ত জবাব দিবে। অস্ত্র চাই অস্ত্র। শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। বিস্ত্রি রকম মিথ্যা প্রচারণা চালাল রেডিও পাকিস্তান।

প্রচারণার জবাব দিতে হবে। তাই বুলেটিন চাই। কিছু নেই কাগজ কলম আছে তো। বাবাকে সম্পাদনায় দায়িত্ব দেয়া হলো। বের করা হলো জাগ্রত বাংলা পত্রিকা।

১ম সংখ্যায় বাংলাদেশের সবুজ জমিনে লাল রক্তের গোলকের হলুদ মানচিত্র। শতশত সংখ্যা প্রচার হতে থাকে বাংলাদেশের মানচিত্র। ই, পি, আরের ফেলে যাওয়া রাইফেল নিয়ে দল গঠন করলো আফসার বাহিনী।

বাবাও যোগদান করলো । প্রথমে ভালুকা থানা আক্রমণ করে অস্ত্র ও গোলা বারুদ সংগ্রহ করা হলো। ৩ বার আক্রমণ করে অস্ত্র গোলাবারুদের মজুদ বাড়ল। ২য় সংখ্যা জাগ্রত বাংলা বের হলো সাইক্লোস্টাইল মেশিনে। নিকসন সরকার বসে আছে অর্থ, অস্ত্র ও খাদ্য নিয়ে- কুকুরের মতো জিব্বা বের করে ইয়াহিয়া ভিক্ষা চাচ্ছে বাবা বাবা গো বাচাও। নিকসন ধমক দিয়ে বলছে থাম ব্যাটা অস্থির হস ক্যান।

খুবই জনপ্রিয় হলো। ভাওয়ালাবাজু যুদ্ধ ভাওয়ালাবাজু একটি গ্রাম। ভালুকা ও গফরগাঁও থানার মাঝামাঝি এর অবস্থান। ভালুকা থেকে ১৫ কিমি পূর্বে। ব্রক্ষপুত্র নদের একটি শাখা সুতিয়া নদী চেন্নাই খালে বয়ে গেছে। নদী পার হওয়া ছাড়া ভালুকা যাওয়ার আর কোনো রাস্তা নেই কয়েক দিন ধরেই খবর পাওয়া সশস্ত্র পাক সেনারা তাদের দল বৃদ্ধি করছে গফরগাঁও থানায়। উদ্দেশ্য ভালুকা থানা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য।

যুদ্ধে যাওয়ার মতো আফসার বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৬০ জন। এর মধ্যে ৩০ জনকে বাছাই করা হলো। ২৬ টি থ্রিনট থ্রি রাইফেল, ২টি মর্টার ২ টি এম জি ও একটি চাইনিজ রাইফেল। ২৪ জুন ভাওয়ালাবাজুতে প্রবাহিত ব্রক্ষপুত্রের শাখা নদীটি সুতিয়ার পশ্চিম পারে ব্যাংকার খনন করে মুক্তিযোদ্ধারা পজিশন গ্রহণ করে।

২৫ জুন ভোর ৮টায় সূর্য উঠি উঠির সময় পাক বাহিনীর বড়ো সড়ো একটি বহর নদী পারে এসে হাজির হয়। ১৪/১৫টি গাড়ি গরু ও মহিষের রসদ বোঝাই করে ফেরী ঘাটে এসে পৌঁছে। পারিপার্শ্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণের পর পাক বাহিনী ফেরীর মাধ্যমে নদী পার হবার উদ্যোগ গ্রহণ করে। বাকীরা নদীর পারে পার হবার অপেক্ষা করতে থাকে। পাক সেনা বহন কারী ফেরীটি নদীর মাঝ পথে যাওয়ার সাথে সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের এল, এম, জি গর্জে ওঠে। সাথে রাইফেলের গুলি। ফেরী তে অবস্থান নেয়া ৫০/৬০ জনের পাক সেনা সেখানেই সমাধি ঘটে। বাকী যারা ছিল নদীতে ভেসে যায়। পারে যারা ছিল দাড়িয়ে কিছু বুজবার আগেই তারা নিহত বা আহত হয়। এ যুদ্ধ ৪৮ ঘণ্টা চলে। পাক বাহিনী ২৬ জুন দুপুরের পর থেকে হেলিকপ্টার দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পেছনে ধলা স্কুলে সৈন্য নামাতে থাকে।

গোলা বারুদ না থাকায় বাবা সহ পজিশন থেকে সন্ধ্যায় এলাকায় চলে আসেন। নৌকা মান্দাইর বাড়ীতে থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এই অসম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে মাত্র ১ জন মুক্তিযোদ্ধা আঃ মান্নান শহীদ হোন।

আহত হোন ৪ জন। ১. আফাজ উদ্দিন ভুঁইয়া, ২. মোন্তফা কামাল, ৩. মজিবুর রহমান, ৪. মনির উদ্দিন।

ভাওয়ালাবাজুর সংঘর্ষে কত জন পাক সেনা নিহত ও আহত হয় তার সঠিক হিসেব পাওয়া যায়নি । তবে মহিষের গাড়ি করে লাশ বা আহতদের হেলিকপ্টার দিয়ে নিয়ে গিয়ে ছিল তাদের জবান বন্দি অনুযায়ী প্রায় শতাধিক।

৪৮ ঘণ্টা সংঘর্ষে আফসার বাহিনীর লোক বল অস্ত্র বল সবই ছিল সীমিত। ৩য় সংখ্যায় জাগ্রত বাংলা পত্রিকা বের করা হলো। ১ম বর্ষ ৩য় সংখ্যা ১৩ আশ্বিন বৃহস্পতি বার ১৩৭৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১, মূল্য ৩০ পয়সা। মুক্তিযোদ্ধাদের রণাঙ্গনের খবর ফিচার কার্টুন। পত্রিকা জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। ৪র্থ সংখ্যা ১ লা অক্টোবর। বৃহস্পতিবার ১৯৭১ বজ্রকন্ঠ ছাপা হল। বাংলাদেশের টাকার নোট দিয়ে খবরটি ছাপা হলো।

বেঙ্গল রেজিমেন্ট জয়দেবপুর থেকে ১০/১২ মহিষ ও গরুর গাড়িতে অস্ত্র নিয়ে ২৩ মার্চ বাবাদের এলাকায় আঙ্গার গাড়া স্কুল মাঠে নিয়ে আসে। অস্ত্র গুলো পাশেই পরশুরাম মেম্বারের বাড়ির আশেপাশে মাটিচাপা দিয়ে রাখা হয়।

এ খবর পাক বাহিনীর কাছে ছিল। ১ লা অগাস্ট পাকবাহিনীর বহর আঙ্গারগাড়া বাজারে এসে আগুন দেয়, অস্ত্র বাবাসহ মুক্তিযোদ্ধারা চান পুর নামক স্থানে অতর্কিত আক্রমণ করেন। পাক সেনারা বিকট চিৎকারে কিয়া মুছিবত হ্যায় কিয়া মুছিবত হ্যায় চিৎকার করে এলোপাতাড়ি দৌড়ায়। পাকবাহিনীর ১৪ জন নিহত হয়। মুক্তিযুদ্ধের দু জন শহীদ হোন।

৪র্থ সংখ্যায় ছাপা হয় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের ভাষণ। ৫ম সংখ্যায় ছাপা হয় মুক্ত এলাকায় প্রশাসন। মুক্তিযোদ্ধারা মল্লিকবাড়ি মুক্ত করেন। ৮ ঘণ্টা প্রচণ্ড গুলি বিনিময়, পাক দস্যুদের পলায়ন রাত ৮টায় মুক্তি বাহিনীর ঘাটি হয়। ৫ম সংখ্যায় ছাপা হয় কার্টুন মুক্তঞ্চলে জনসভা।

রাজাকারদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা। রাজাকারদের আত্ম সম্পন্ন করার জন্য নির্দেশাবলী। মায়ের চিঠি। ৭ম সংখ্যায় মুক্ত এলাকার মানচিত্র ছাপা হয়। ন্যাপ নিষিদ্ধ ঘোষণা। ৭৬৫ বর্গ মাইল এলাকা শত্রু কবল থেকে মুক্ত। ৮ম সংখ্যায় প্রধান শিরোনাম ভালুকা গফরগাঁও মুক্ত। পাথাইরা বাইত যুদ্ধ। শতাধিক পাক সেনা একটি বহর পাহাড়ি এলাকায় হানা দেয়। মুক্তিযোদ্ধারা প্রস্তুত ছিল। এ যুদ্ধে পাকবাহিনীর ১০ জন নিহত হয়।

৪টি লাশ ও ৬ জীবিত সৈন্য নিয়ে বাবা তাদের অফিসে আসেন। দৌলার পারে পচা পুকুরে লাশ গুলো মাটি চাপা দেয়া হয়। জীবিত ৪ জনকে হত্যা না করে বাঁচিয়ে রাখা হয়। মুক্তিযোদ্ধা ৪ জন আহত হয়। নাজিমের গলায় চাইনিজ রাইফেলের গুলি লাগে। পরে সে শহীদ হয় । ৯ম সংখ্যায় বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি স্কেচ দিয়ে প্রচ্ছদ করা হয়। ১০ম সংখ্যায় ইয়াহিয়ার কুপোকাত হওয়ার কাটুন ছাপা হয়। ১১ সংখ্যায় বিস্তীর্ণ এলাকা মুক্ত যা খুবই জনপ্রিয় পায়।

স্বাধীনতা অর্জন হয়। এর পূর্বে ১২ তারিখ থেকে জয়দেবপুর অর্ডিন্যান্সে ফ্যাক্টরিতে অবস্থান করেন। ১৬ তারিখ জাগ্রত বাংলার কাগজ পত্র মেশিন নিয়ে ময়মনসিংহ আর্মির গাড়িতে করে নিয়ে আসা হয়। রাবেয়া মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলে জায়গা নেয়। পরে কাজের সুবিধার জন্য ওল্ড পুলিশক্লাব রোডে একটি বাসায় চলে যান এবং পত্রিকা প্রকাশ করেন।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাবা বেশ কয়েকটি বই প্রকাশ করে। ৭১‘ জাগ্রত বাংলা , মুক্তিযুদ্ধের জুতো, মুক্তিযুদ্ধের মুক্ত এলাকা, মুক্তিযুদ্ধের নৃশংস ঘটনা , মুক্তিযুদ্ধের নৃশংস ঘটনা ২য় খণ্ড এবং স্বাধীনতা স্বারক -২০০৫ ও স্বাধীনতার ঘোষণা ও বিতর্ক।

বাবা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং জাগ্রত বাংলা পত্রিকার সম্পাদনা করার জন্য বেশ কয়েকটি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট, বিজয় উৎসব ২০১১ উদযাপন পর্ষদ ময়মনসিংহ, ভালুকা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, ময়মনসিংহ পৌরসভা, ময়মনসিংহ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে সংবর্ধনা গ্রহণ করেন।

আজ আমার বাবা নেই আমার বাবার মতো সকল বীর মুক্তিযোদ্ধা একদিন হারিয়ে যাবেন কিন্তু আমরা হারাতে দিবো না তাঁদের রক্ত কে পুঁজি করে এ স্বাধীন দেশে চিরস্থায়ী করে রাখবো।

লেখক : শফিয়েল আলম সুমন, সাংবাদিক, দৈনিক অধিকার।

চলমান আলোচিত ঘটনা বা দৃষ্টি আকর্ষণযোগ্য সমসাময়িক বিষয়ে আপনার মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাই, সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইলকরুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড