• শুক্রবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৭ আশ্বিন ১৪৩০  |   ৩২ °সে
  • বেটা ভার্সন

সর্বশেষ :

sonargao

দুর্যোগে ঝুঁকিহ্রাসসহ জীবনমান উন্নয়নে মুজিব কিল্লার বহুমাত্রিক ব্যবহার  

  দেওয়ান সাবাব

২৬ অক্টোবর ২০২২, ১৬:০৯
দুর্যোগে ঝুঁকিহ্রাসসহ জীবনমান উন্নয়নে মুজিব কিল্লার বহুমাত্রিক ব্যবহার  

বনবিবির নাম নিয়ে সকাল-সন্ধ্যা চলা ফেরা কুলসুম বেগমের। শাড়ির ভাঁজের তাবিজ রেখে নীল ডুমুর বাজারে তার চলাফেরা দেখছিলাম।তার কাছে বনবিবির ঠিকানা জানতে চাইলে সে আঙুল তুলে সুন্দরবনের দিকে।

জানা যায়- কালীর চরে তার অবস্থান। সেই বৃদ্ধার কাছে দুর্যোগকালীন সময়ে তার এবং সুন্দরবনের আশপাশের মানুষের জনজীবনের কথা জানতে চাইলে সে জানায় বন্যায় তার বাড়ি ভাসিয়ে নিয়ে গেছে আরও বহুদিন আগে। এখন শেখ হাসিনা সরকারের ‘মুজিব শতবর্ষে গৃহায়ন প্রকল্প"তে তার একটি ঠিকানা হয়েছে। এভাবেই ঘূর্ণিঝড়-বন্যায় প্রতি বছর এখানকার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মুজিব কিল্লা নিয়ে তার ভাবনা জানতে চাইলে সে জানায় তাহলে তাদের জীবনটাই বেঁচে যায়।

মুজিব কিল্লা একটি স্থাপনা যার ধারণা পাওয়া গেছে বিগত সময়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।তখন এই কিল্লার নাম ছিল মাটির কিল্লা। উপকূলীয় ঘূর্ণিঝড় ও বন্যাপ্রবণ এলাকায় মাটির উঁচু ভিত করে দুর্যোগকালীন সময় মানুষের নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য কিল্লাটি ব্যবহার করা হতো। জরুরি মুহূর্তে আশ্রয়ের ক্ষেত্রে কিল্লার ধারণাটি কার্যকরী জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় তৎকালীন সময়ে মানুষসহ গবাদিপশুর নিরাপদ আশ্রয়ের ঠিকানা হয় এই কিল্লা। মুজিব সরকার দেশীয় ভাবধারায় এই স্থাপনা তৈরি করার কারণে দ্রুতই এটি মুজিব কিল্লা নামে অভিহিত হতে থাকে।

বাংলাদেশ তার ভৌগলিক অবস্থানের জন্য একটি দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। পাশাপাশি জনসংখ্যার ঘনত্বের আধিক্য থাকায় দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনার মাত্রা উপরের দিকে।দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও দুর্যোগ ঝুঁকিহ্রাসের কথা মাথায় রেখে বর্তমান শেখ হাসিনার সরকার বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের কাজ হাতে নিয়েছে তারমধ্যে মুজিব কিল্লা অন্যতম।

তার ধারাবাহিকতায় শেখ হাসিনার সরকার ২০১৮ সালে মুজিব কিল্লার সংস্কার, সংরক্ষণ ও নতুন কিল্লা নির্মাণের উদ্যোগী হয়।মুজিব কিল্লা নির্মাণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ প্রকল্পের উদ্যোগ নেয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং তার কাঠামো বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর।

তাছাড়াও কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লী উন্নয়ন বিভাগ এ প্রকল্পের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট থাকবে। বিদ্যমান ১৭২টি মুজিব কিল্লা সংস্কার,উন্নয়নের সাথে সাথে নতুন করে নির্মাণ করা হবে ৩৭৮টি কিল্লা। এতে করে মোট মুজিব কিল্লার সংখ্যা দাঁড়াবে ৫৫০টি। দেশের ঘূর্ণিঝড়প্রবণ ১৬টি জেলার ৬৪টি উপজেলা এবং বন্যা ও নদীভাঙন প্রবণ ২৪টি জেলার ৮৮টি উপজেলায় কিল্লা নির্মাণ ও সংস্কার হবে। সরকারি অর্থায়নে মুজিব কিল্লা প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ৯৫৭ কোটি ৪৯ লাখ টাকা।

সম্প্রতি সিলেট-সুনামগঞ্জ-নেত্রকোনা বন্যাকালীন সময়ে এক গোল টেবিল বৈঠকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বন্যার প্রকোপ এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিস্থিতির উন্নতি এবং জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে সরকার নদীর তলদেশ খননের মাধ্যমে গভীরতা বৃদ্ধিতে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এছাড়াও আরও এক হাজার মুজিব কিল্লা ও এক হাজার বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করবে সরকার।

এ প্রকল্পের আওতায় উপজেলাগুলো হলো- রংপুর বিভাগের গাইবান্ধা, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট, রাজশাহী বিভাগের বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, নাটোর ও রাজশাহী, ঢাকা বিভাগের টাঙ্গাইল, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, মাদারীপুর, মানিকগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ; ময়মনসিংহ বিভাগের নেত্রকোনা, জামালপুর ও শেরপুর; চট্টগ্রাম বিভাগের ফেনী, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চাঁদপুর; বরিশাল বিভাগের পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা, পিরোজপুর, বরিশাল ও ঝালকাঠি; খুলনা বিভাগের বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, খুলনা, যশোর ও নড়াইল এবং সিলেট বিভাগের সিলেট ও সুনামগঞ্জ।

যদিও পরিতাপের বিষয় হচ্ছে বিগত সময়ে যারা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্বে এসেছেন তারা প্রশাসনিকভাবে মুজিব কিল্লা প্রকল্পের কোন ধরনের সংরক্ষণ সংস্কার কিংবা উন্নয়নে উদ্যোগী হতে দেখা যায়নি।

অন্য দিকে মুজিব কিল্লা স্থাপনার সম্পত্তি বেদখল ও পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকতে দেখা গেছে।যার মাধ্যমে বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় ঝুঁকিহ্রাস সংকটে মুজিব কেল্লা তথা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যুগান্তকারী ঐতিহাসিক অবদান মুছে ফেলার চেষ্টা চলেছে।

২০২২ সালের জানুয়ারিতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও নাযুকতা শিক্ষা ইনস্টিটিউটের সহযোগিতায় সাতক্ষীরা জেলায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সরেজমিন অবস্থা তুলে আনতে গিয়ে সাতক্ষীরায় মুজিব কিল্লার প্রতি অসহায় মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার কথা শুনেছি। বছরে কখনো কখনো দুই বার ঘূর্ণিঝড়, বন্যার কবলে পড়ে বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণ-পশ্চিমের নাযুক জনগোষ্ঠী। চিংড়ি ও কাঁকড়া চাষে জনপ্রিয়তা বাড়ায় সমুদ্রের লবণাক্ত পানি খাল করে চাষের জন্য নিয়ে আসা হয়।

সে কারণে বিশুদ্ধ খাবার পানির স্তর অনিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে নিচে নেমে গেছে।যার ফলে বন্যা হলেই বিশুদ্ধ খাবার পানির প্রাদুর্ভাবের দেখা মিলে। তবে আশার কথা হচ্ছে মুজিব কিল্লা নির্মাণ হলে সেখানে বিশুদ্ধ খাবার পানির বিশেষ সুবিধা থাকবে। পাশাপাশি এতে করে পানিবাহিত রোগের প্রকোপও কমে আসবে।

মুজিব কিল্লা প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে এর সুবিধা ভোগ করবে দুর্যোগ কবলিত জনসাধারণ। এই কিল্লায় প্রাথমিক চিকিৎসার কথা মাথায় রেখে ফাস্ট এইড বক্স রাখা হবে। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সদস্যদের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক পর্যায়ে এই সেবা দেওয়া হবে। তাছাড়াও গর্ভবতী নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও শারীরিকভাবে অসচ্ছল জনসাধারণের জন্য বিশেষ কামরার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সোলার প্যানেলের মাধ্যমেও সার্বক্ষণিক বিদ্যুতের ব্যবস্থা রাখা হবে।

বজ্র নিরোধক তারের মাধ্যমে স্থাপনার বজ্রপাতের ঝুঁকিহ্রাস নিশ্চিত করা হবে। পরিবেশ সংরক্ষণের কথা মাথায় রেখে কিল্লা চারপাশে পরিকল্পিত বনায়নের উদ্যোগও গৃহীত হয়েছে। স্থাপনাটিতে হেলিপ্যাড থাকাও গুরুত্বপূর্ণ। জরুরি মুহূর্তে হেলিকাপটারের মাধ্যমে দুর্যোগে সেবা প্রদান বর্তমান বিশ্বে যুগান্তকারী উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। দুর্যোগে জীবনরক্ষাসহ অতিপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে এই স্থাপনায়। গৃহপালিত প্রাণী বা লাইভষ্টকের কথা মাথায় রেখে দুর্যোগকালীন সময়ে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।

প্রকল্পটির বহুমাত্রিক ব্যবহারের কথা চিন্তা করে স্বাভাবিক সময়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনাসহ খেলার মাঠ হাট বাজার হিসেবে ব্যবহৃত হবে।দেশের প্রান্তিক গোষ্ঠী চোখে এ কিল্লার প্রভাব সুদূরপ্রসারী হবে। বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পরিকল্পিত আয়ের প্রধান উৎস গৃহপালিত প্রাণী। বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ে জানমালের ক্ষতিসহ অর্থনৈতিক যে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় তা কমে আসবে বলে আশা করা যায়। তাছাড়াও দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে মুজিব কিল্লা বহুমাত্রিক ব্যবহারও নিশ্চিত করা হবে। মূলত দুর্যোগ কেন্দ্রিক সময়ে মুজিব কিল্লা প্রকল্পের স্বতঃস্ফূর্ত ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে দুর্যোগ ঝুঁকিহ্রাস ও উন্নয়নের নতুন দ্বার উন্মোচন হবে বলে বিশ্বাস করি।

লেখক : সহ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ও শিক্ষার্থী, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও নাযুকতা শিক্ষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

(মতামত পাতায় প্রকাশিত লেখা একান্ত লেখকের মত। এর সঙ্গে পত্রিকার সম্পাদকীয় নীতিমালার কোনো সম্পর্ক নেই।)

চলমান আলোচিত ঘটনা বা দৃষ্টি আকর্ষণযোগ্য সমসাময়িক বিষয়ে আপনার মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাই, সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইলকরুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড