মুহাম্মদ আমিনুল ইসলাম
৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ সালে চীন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে (ডব্লিউএইচও) অজানা কোনো কারণে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত রোগীর খবর জানায়। জানুয়ারিতে এ রোগের প্রাদুর্ভাবকে জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এরই রেশ ধরে বাংলাদেশে ২০২০ সালের ৮ মার্চ প্রথম কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়।
এরপর বন্ধ হয়ে যায় দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। স্থবির হয়ে পড়ে দেশের শিক্ষা কার্যক্রম। এরপর অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম কিছুটা শুরু হলেও পূর্বের অভিজ্ঞতা আর যথেষ্ট প্রযুক্তির অভাবে শিক্ষা ক্ষেত্রে ভালো কিছু বয়ে আনতে পারেনি। একের পর এক তারিখ দেওয়ার পর অবশেষে গত বছরের শেষে পুরোপুরি খুলে দেওয়া হয় দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
পরবর্তীকালে মহামারি কোভিডের প্রভাব পড়ে আমাদের শিক্ষা ক্ষেত্রে ও প্রত্যহ জীবন ধারায়। সেই প্রভাব এখনো তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। মনোবিজ্ঞানীরা মতামত দিয়েছেন- শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন শ্রেণি কার্যক্রম থেকে দূরে থাকার কারণে অনেকের মাঝেই আচরণগত পরিবর্তন আসাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কেননা শ্রেণিতে নিয়মিত থাকলে একটা রুটিন মাফিক পড়াশোনা চলমান থাকতো। শ্রেণির কাজ, বাড়ির কাজ, ক্লাস টেস্ট, সেমিস্টার পরীক্ষা যথানিয়মে চলতে থাকলে সিলেবাস সম্পূর্ণ হতো, তাহলে শিক্ষার স্বাভাবিকতা চলমান থাকতো। কিন্তু ক্লাস বন্ধ হওয়ায় সব কিছু থমকে গেছে।
কোমলমতী শিক্ষার্থীর মেধার বিকাশে প্রতিবন্ধকতার দেয়াল তৈরি হয়েছে। দীর্ঘদিন ক্লাসের বাহিরে থাকায় একাকীত্বের যন্ত্রণায় অবাধ্যতার আলামত প্রকটাকার ধারণ করেছে। কর্তৃপক্ষ শ্রেণি কার্যক্রম বন্ধ থাকার কারণে বিকল্প চিন্তায় অনলাইনে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
পরবর্তী সময়ে দেখা গেল যে অভিভাবক মহল সাইকোলজিস্টের দ্বারস্থ হয়ে অভিযোগের ভাষায় বলেন, অনলাইনে পাঠদান কর্মসূচিতে অংশ নিতে গিয়ে ছেলেমেয়েরা মোবাইল ইন্টারনেটের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছে। যাতে করে বাবা-মার সাথে সন্তানের সন্তানের সম্পর্ক ও হুমকির সম্মুখীন। অভিভাবকের চোখের আড়াল হয়ে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যুক্ত হয়ে চ্যাটিং, টিকটিক, গেমসসহ মোবাইল আসক্তিতে উতলা হয়ে পড়েছে। সীমিত আকারে শ্রেণি কার্যক্রম, এসাইনমেন্টের পদ্ধতি চালু করলে ও পরীক্ষা পদ্ধতি না থাকার কারণে অনেক শিক্ষার্থীর নিকট পড়ার গুরুত্ব হ্রাস পেয়েছে। সংক্ষিপ্ত সিলেবাস, অল্প কয়েক বিষয় পরীক্ষা অটোপাশ ফেরিয়ে যে সব শিক্ষার্থী প্রতিযোগিতা মূলক ভর্তি পরীক্ষা, চাকরির ইন্টারভিউতে উপনীত হতে যাচ্ছে, তাদের মাঝে কিছুটা ভিতি কাজ করছে।
অভিভাবক, শিক্ষক, মুরুব্বি শ্রেণির সাথে রূঢ় আচরণ করা যে মহা অন্যায় এ অনুভূতি শক্তি অনেক শিক্ষার্থীর হারিয়ে গেছে। যার প্রতিক্রিয়ায় বিভিন্ন স্থানে শিক্ষকের সাথে শিক্ষার্থীর অসদাচরণ যত্রতত্র ঘটেই চলছে। যার মাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন মহল কার্যকরী পদক্ষেপ না নিলে জাতি বিনির্মাণের কারিগর শিক্ষকদের উপর নিপীড়ন সমাজে ট্র্যাডিশনে রূপ নিতে পারে। যা সভ্যতার জন্য হুমকি স্বরূপ।
সমাজ বিজ্ঞানীরা বলেছেন, কোভিড-১৯ পরবর্তী পরিস্থিতিতে সন্তানের মানসিক এবং সামাজিক উন্নয়ন ও বিকাশে বাবা-মাকেই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করতে হবে। আমরা শিক্ষক মহল কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে কিছু সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি।শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীর উদাসীনতা, শ্রেণির মূল্যায়নে অংশগ্রহণ না করা, বাড়ির কাজ সঠিকভাবে উপস্থাপন না করা, প্রাতিষ্ঠানিক অনুশাসন না মানার মানসিকতা, এ রকম অনেক নতুন নতুন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় শিক্ষক কে।
একদিকে শারীরিক শাসনে নিষেধাজ্ঞা অন্যদিকে শিক্ষার্থীর উদাসীন ও অশালীন আচরণ বৃদ্ধি, সব মিলে শিক্ষক যেন শাঁখের করাত। শিক্ষক-ছাত্র-অভিভাবক এ তিনের সমন্বয় ছাড়া তো শিক্ষার উন্নতি কল্পনাই করা যায় না। এখন ভাবনার বিষয়, এমন ভারাক্রান্ত হৃদয়ে রক্তক্ষরণ নিয়ে শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে কতটা প্রাণবন্ত পাঠদান করতে পারবেন ? এ প্রশ্নটা জাতির নীতিনির্ধারক মহলের কাছে সবিনয়ে উপস্থাপন করছি। শিক্ষক ও জাতির তরুণ প্রজন্ম কে নিরাপত্তা কল্পে সম্মান অটুট রাখার জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ ও নীতিমালা প্রণয়ন করা অত্যাবশ্যকীয় বলে আমি মনে করি।
অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েদের বিবাহ বন্ধে সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বে¡ও বাল্যবিবাহের পরিমাণ বেড়েই চলছে। এতে করে শ্রেণিকক্ষের অনেক অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েই বিয়ের পিঁড়িতে বসেছে। যাদের অতি অল্প পরিমাণই শ্রেণিতে ফেরত আসে। কোভিড-১৯ পরবর্তী বিড়ম্বনার শিকার হয়ে এসব কিশোরীর দল বিয়ের পিঁড়িতে বসলে ও কিছু কিছু ক্ষেত্রে দাম্পত্য কলহের স্বীকার হয়। বিদ্যালয় নামক স্বর্গীয় স্থান থেকে অনেক মেয়েই ঝরে পড়েছে।
অন্য দিকে ছাত্ররা ও কর্মসংস্থানের দুশ্চিন্তায় অল্প বয়সেই শিক্ষাজীবন থেকে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। আমরা দেখি এ দুর্যোগ–মহামারির সাথে সাথেই অনেক ছেলেই পড়া-লেখা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এর একাধিক কারণ থাকতে পারে বলে আমার ধারণা। একটু বুঝার ক্ষমতা হলে যখন দেখতে পায়, আশেপাশের কেউ উচ্চশিক্ষিতা শিক্ষিত হয়ে ও সোনার হরিণ চাকরির পেছনে ছুটে হতাশার সাগরে নিমজ্জিত। শিক্ষার হার বৃদ্ধির পাশাপাশি সেভাবে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি হচ্ছে না।
বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্টের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বাংলাদেশের ৪৭% স্নাতকই বেকার। দিন দিন উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। এমন প্রেক্ষাপটে শিক্ষা নামক অমৃতের স্বাদ অনেকটা তেতো হয়ে যায়।লেখা-পড়া আর ভালো লাগে না। কিছু কিছু অভিভাবকের শক্ত ভূমিকায় কেউ পড়া চালিয়ে যায়।আবার কেউ পড়া বন্ধ করে শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। কোনো ছাত্র মোবাইল জ্বরে আক্রান্ত।
কোভিড-১৯ নামক এক অদৃশ্য ভাইরাসের আক্রমণে তছনছ হয়ে পড়েছে একবিংশ শতাব্দীর বিশ্ব ব্যবস্থাও। বাংলাদেশ ও এর প্রভাবে জ্বরাগ্রস্ত। কিন্তু করোনা ভাইরাস পরবর্তী বিশ্ব সম্পর্কে যে সব বিশেষজ্ঞ ও ফিউচারোলজিস্ট মতামত ব্যক্ত করেছেন তারা সবাই একটা বিষয়ে একমত, এ মহামারীর পর পাল্টে যাবে আমাদের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড, জীবনাচার, ভ্রমণ-বিনোদন, ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি রাষ্ট্র, সমাজ সব ধরনের পরিবেশ। আর শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশে তো আমূল পরিবর্তন।
নীতি-নির্ধারক মহলের নিকট নিবেদন, যথাযথ কর্তৃপক্ষ ও বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে কিভাবে শিক্ষাঙ্গনের স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা যায়, এ ব্যাপারে ভালো উদ্যোগ ও কার্যকরী পদক্ষেপ নিবেন এ প্রত্যাশা। আপামর জনগণ ও সচেতন হতে হবে।
কারণ মহামারি পরবর্তী ভঙ্গুর অর্থনীতি,সমাজ ব্যবস্থা, জীবনযাত্রা থেকে শুরু করে শিক্ষাক্ষেত্র পর্যন্ত যত জড়তা আছে তার সুন্দর সমাধান কল্পে সকলেরই সচেতনতা একান্ত জরুরি। নচেৎ এর বিষাতুর ফলাফল আমরাই বহন করতে হবে।
লেখক : শিক্ষক ও লেখক মুহাম্মদ আমিনুল ইসলাম।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড