রহমান মৃধা
সুইডিশ এক বন্ধু হঠাৎ ফোন করে বলল- লাঞ্চ করবে আমার সাথে। বললাম ঠিক আছে। ১১টা বাজতেই সে হাজির। লেকের ধার দিয়ে কিছুক্ষণ দুজনে হেঁটে পরে লাঞ্চে গেলাম। লাঞ্চ সেরে বাসায় এসে কফি খেলাম। কফির আড্ডা যখন চলছে তখন সুইডেনের বর্তমান রাজনীতি নিয়ে কথা শুরু হলো। সুইডেনে প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে বেশ আলোচনা হলো।
আমি কোনো এক পর্বে বললাম বেশ দেরি করে এমনটি হবার কারণ কী? টমি উত্তরে বলল- ভাইকিং জাতি সহজে কি নারীদের উপর ক্ষমতা হস্তান্তর করে? আমি বললাম- কী এমন হলো যে হঠাৎ মহিলা প্রধানমন্ত্রী? টমি উল্টো আমাকে বলল- তোমাদের বাংলাদেশে তো এ ঘটনা বহু আগেই ঘটেছে। আমি বললাম- তার পিছনে কারণ রয়েছে যেমন শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসেছেন মূলত তার বাবার কারণে অন্য দিকে খালেদা জিয়া এসেছেন তার স্বামীর কারণে এবং ক্ষমতায় আসার পর তারা কিন্তু পুরুষের চেয়ে ভালোই করছেন। যাইহোক এ কথা সে কথার পর লাঞ্চ শেষে টমি চলে গেল, আমিও নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলাম।
ভাবনার মধ্যে ঢুকেছি তার একটি সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আমার আবার অস্বস্তি লাগে। ভাবনাটা কী নিশ্চয় অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন। আমার ভাবনা আমরা জেনে না জেনে ভাব দেখাই যে আমরা পুরুষেরাই সব বিষয়ে পণ্ডিত, আমরা শক্তিশালী, আমাদের কর্তৃত্বে নারীর চলাফেরা, নারীর অস্তিত্ব ইত্যাদি। অথচ সত্যিকারার্থে দেখা যাচ্ছে বিষয়টি উল্টো, যেমন আমরা যা পারি নারীরাও ঠিক তাই পারে বিভিন্নভাবে বরং নারীরা যা পারে আমরা তার সবকিছু পারি না। যেমন ধরণ, বরণ, গ্রহণ। এই তিনটি দায়িত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখার চেষ্টা পুরুষেরা করেছে।
সময়ের পরিবর্তন সাথে সচেতনতার কারণে নারী পুরুষের মধ্যেকার যে ব্যবধান ছিল সেগুলো বিলুপ্তির পথে যার ফলে পুরুষ জাতির ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ শুরু হয়েছে। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সব কিছুরই পরিবর্তন শুরু হয়েছে। অতীতে নারীর উপর চাপিয়ে দেওয়া দায়িত্বগুলো শুধু নারীর উপর না থাকার কারণে তারা পুরুষের কাজের উপর নজরদারি শুরু করেছে এবং কৃতিত্বের সঙ্গে সেগুলো পালন করছে।
আরও একটি মজার জিনিষ (পুরুষ নারীর লিঙ্গ) আমাদের মধ্যে ঢুকেছে। এখন যদিও লিঙ্গ কয়েক প্রকার সেটা আমরা জানি তবে বিষয়টি বড় আকারে আমাদের এই পুরুষ ডোমিনেট সমাজে প্রভাব ফেলতে পারেনি কিন্তু সে প্রভাবটি এখন শুরু হয়েছে। যেমন হিজড়া বাংলাদেশের ইউনিয়নের চেয়ারম্যান যেখানে অতীতে তাদের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন ছিল এখনো আছে।
আরও পড়ুন : বিজয় দিবসে জানতে ইচ্ছে করে
হয়তোবা অনেকেই প্রশ্ন করবেন বা ভাববেন এতদিন পরে হঠাৎ হিজড়া জাতি নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টির কারণ কী? কারণ একটাই সেটা হলো যুগোপযোগিতা। এখনই চমৎকার সময় বিষয়টি নিয়ে ভাবা, আলোচনা করা এবং সংবিধান তৈরি করা যেখানে সবার সমান অধিকার থাকতে হবে। এতো যুগ কেটে গেল অথচ হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এরই সমাধান হলো না এর মধ্যে শুরু হলো হিজড়া সমস্যা।
আসলে কী জানেন এগুলো সমস্যা নয়, সমস্যা হলে সমাধান অনেক আগেই হয়ে যেতো। একে বলা হয় জোর যার মুল্লুক তার। কারো অস্তিত্ব হরণ করার বিষয়টি সমাজের এলিট নামের যে দানবগুলো রয়েছে তাদের কারসাজি। এটা তাদের ক্ষমতা বলেই এই কারসাজি। এরা নানা ধরনের টালবাহানা বা ধর্মকে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে অথবা প্রভাব খাটিয়ে সমাজের সংখ্যালঘুদের বিতাড়িত করে নিজেদের দিনের পর দিন মাসের পর মাস বছরের পর বছর প্রভাবশালী করে গড়ে তুলেছে। সময় এসেছে এখন এদেরকে চিহ্নিত করে বের করার। যারা অন্যের অস্তিত্বের উপর প্রভাব ফেলে তারাই সত্যিকারার্থে সমাজ তথা পৃথিবীর অরাজকতা সৃষ্টির পিছনে জড়িত।
প্রকৃতির উপর নজরদারি করার অধিকার আমাদের দেওয়া হয়নি বা সে ক্ষমতা আমাদের নেই। থাকলে এই মুহূর্তে যেমন- সুইডেনে প্রচণ্ড আকারে তুষারপাত হচ্ছে, কই এমনকি এখানকার রাজাও সেটা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছেন না বা চেষ্টা করছেন না। বরং পুরো জাতি সেটাকে মেনে নিয়ে অ্যাডজাস্ট করে চলছে আজীবন ধরে। অথচ মানুষ হয়ে অন্য গোত্র, ধর্ম, বর্ণ বা লিঙ্গের মানুষের সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করে বসবাস করতে আমরা আজও শিখতে পারিনি। আমরা স্রষ্টার সৃষ্ট জীব হিসেবে নিজেদের দাবি করি!
পৃথিবী সৃষ্টির পর অন্যান্য জীবজন্তুর চেয়ে মানুষ জাতির নৈতিকতার অধঃপতন হয়েছে বেশি। যার ফলে আমরা এখনো অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা এবং চিকিৎসার সুব্যবস্থা করতে সক্ষম হইনি। এই সমস্যার সমাধান আমাদের করার কথা, কে হিন্দু, কে মুসলমান, কে বৌদ্ধ, কে খ্রিস্টান বা কে হিজড়া এটা আমাদের চয়েজ নয়। যেমন বাবা-মা সন্তানের চয়েজ নয় তবে শ্বশুর-শাশুড়ি চয়েজ। আমার জন্মে যদি ভিন্নতা থাকে এবং যদি তার পরিবর্তন করা সম্ভব না হয় (যেমন দেখতে পুরুষ অথচ ভেতরে মেয়েলি ভাব) সেটা আমার দোষ নয়।
তবে আমার চরিত্রে যদি সমস্যা থাকে এবং সে সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হয় সত্ত্বেও যদি সেটা না করি সেটা আমার দোষ। এই ধরণের দোষগুলোর সমাধান না করে আমরা সমাধান করতে ব্যস্ত যা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এটাই আমাদের চরম ব্যর্থতা। যদি প্রশ্ন করি হিজড়ার অস্তিত্ব অস্বীকার করে হিজড়ার রাজ্যে কিভাবে বসবাস করা সম্ভব হবে?
আরও পড়ুন : লটারির মাধ্যমে শিক্ষার উন্নয়নের আইডিয়া উদ্ভট-হাস্যকর
সুইডেনে শুধু ইউনিয়ন পর্যায়ে নয় এখানের সংসদেও হিজড়ার নেতৃত্ব রয়েছে। কই এত বছর ধরে এখানে আছি কখনো তো সমস্যা দেখা দেয়নি। এখানে বাস, ট্যাক্সি, জাহাজ, ট্রেন চালক যখন এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে সময় মতো পৌঁছে দিচ্ছে কখনো তো ভাবিনি যে ভিন্নধর্মী বা হিজড়ার অধীনে চালিত যানবাহন যাবো না? তাহলে সমস্যাটা কোথায়? সমস্যা হচ্ছে আমাদের নিজ নিজ বিশ্বাস এবং বিবেকে। নিজের এই সমস্যা অন্যের উপর আর কতদিন চালিয়ে আমরা চলব?
সময় বলে দিচ্ছে এখন আর নয় খুব হয়েছে এবার পরিবর্তনের পালা। বিষয়টি এমন করেও ভাবা যেতে পারে, করোনা মহামারি এটা একটা সমস্যা এর সমাধান আমরা ঠিকই করছি কিন্তু ধর্ম, জাত এগুলো যদি সমস্যা হতো তবে বহু বছর আগেই এরও সমাধান হয়ে যেতো। শুধু শুধু যা সমস্যা না তার পিছে সময় দিয়ে তাকে জটিল থেকে জটিলতায় না নিয়ে বরং যেটা সমস্যা সেটার উপর গুরুত্ব দেয়ার এখনই উপযুক্ত সময়। যেমনটি সময় দিয়েছিলেন কোনো এক সময় আর্কিমিডিস। একবার সাইরাকিউসের সম্রাট হিয়োরো এক স্বর্ণকারকে দিয়ে একটি সোনার মুকুট তৈরি করেছিলেন।
মুকুটটি হাতে পাওয়ার পর সম্রাটের মনে হয়েছিল এর মধ্যে খাদ মিশানো হয়েছে। স্বর্ণকার খাদের কথা স্বীকার করেনি, ফলে সম্রাটের মনের সন্দেহ দূর হলো না। তিনি প্রকৃত সত্য নিরূপণের ভার দিলেন তৎকালীন রাজদরবারের বিজ্ঞানী আর্কিমিডিসের উপর। মহা ভাবনায় পড়ে গেলেন আর্কিমিডিস। কারণ সম্রাটের আদেশ মুকুটের কোনো ক্ষতি না করে সঠিক তথ্য বের করতে হবে। আর্কিমিডিস তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়, মুকুট না ভেঙে কেমন করে খাদ নির্ণয় করবেন! অস্থির অবস্থায় থাকাকালীন আর্কিমিডিস
একদিন চৌবাচ্চায় গোসল করতে নেমেছেন। পানিতে শরীর ডুবাতেই লক্ষ্য করলেন কিছুটা পানি চৌবাচ্চা থেকে উপচে পড়ছে। মুহূর্তে তার মাথায় এক নতুন চিন্তার উন্মেষ হয়। সমস্যা সমাধানের আনন্দে ছুটে গেলেন রাজ দরবারে। প্রথমে মুকুটটিকে পানিতে ডোবালেন। দেখা গেল খানিকটা পানি উপচে পড়লো। পরে মুকুটের ওজনের সমান সোনা জলপূর্ণ পাত্রে ডোবালেন। দেখা গেল, যে পরিমাণ পানি উপচে পড়েছিল তার ওজন আগের উপচে পড়া পানির ওজন থেকে আলাদা।
আরও পড়ুন : দেখা হয়েছিল পূর্ণিমা রাতে
আর্কিমিডিস বললেন, মুকুটে খাদ মেশানো আছে। কারণ যদি মুকুট সম্পূর্ণ সোনার হতো তবে দুটি ক্ষেত্রেই উপচে পড়া পানির ওজন সমান হতো। এই আবিষ্কারের মধ্যে দিয়ে প্রমাণিত হয়েছিল বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব এবং বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব আর্কিমিডিসের সূত্র নামে বিখ্যাত। বিশ্বে সমস্যা ছিল থাকবে এবং তার সমাধান হয়েছে, হবে। সচেতন জাতি সত্যিকার সমস্যার সমাধান এ ভাবেই খুঁজে বের করে।
লেখক : সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন।
ওডি/কেএইচআর
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড