ওয়াহেদ সবুজ
একটি বানান নিয়ে গতকাল থেকে সারা দেশে বেশ আলোচনা হচ্ছে। মেট্রোরেল বা ইউপি নির্বাচনকে ছাপিয়ে দেশের প্রধান আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে বানানটি। ঘটনা যা-ই হোক, অন্তত এটা ভেবে ভালো লাগছে যে, দেশের মানুষ অন্তত এই একটি ক্ষেত্রে 'ভাষা নিজের গতিতে চলবে' যুক্তি দেখিয়ে বানান ভুলকে সমর্থন দেয়নি।
এতক্ষণে নিশ্চয় আপনারা বুঝে ফেলেছেন, আমি কোন বানানটি নিয়ে কথা বলছি। সারা দেশে এখন একটি প্রশ্নের ঝড়— 'মুজিবর্ষ' ভুল, না-কি ঠিক? চলুন, ব্যাকরণগত বিষয়গুলো আলোচনা করে দেখা যাক।
কেউ কেউ বলছেন, এখানে সন্ধির নিয়ম প্রয়োগ করা হয়েছে। তাদের মতে, মুজিব+বর্ষ= মুজিবর্ষ। যদি এমনটি হতে হয়, তাহলে নিয়মটি হতে হবে: অ+ব=ব। কিন্তু তাদেরকে হতাশ করে আমি জানাতে চাই, সন্ধিতে এ-রকম কোনো নিয়ম বা সূত্র নেই।
কারো কারো মতে, এখানে ধ্বনি পরিবর্তনের নিয়ম সাধিত হয়েছে। তারা বলতে চাচ্ছেন, এখানে দুটি 'ব'-এর একটি লোপ পেয়েছে 'অন্তর্হতি'র নিয়মে। যেমনভাবে 'ফাল্গুন' থেকে 'ফাগুন' শব্দটি এসেছে। তাদের উদ্দেশে বলতে চাই, আগে বুঝতে হবে ব্যাকরণিক দৃষ্টিকোণ থেকে ধ্বনির পরিবর্তন কীভাবে ঘটে। ধ্বনির পরিবর্তন এমন ইচ্ছে মতো যখন-তখন ঘটানো যায় না। ব্যাপারটা এমন নয় যে, আমার ইচ্ছে হলো আর আমি একটা শব্দের একটা বর্ণ লোপ করে দিয়ে বললাম, এটা ধ্বনির পরিবর্তন হলো।
তাহলে আপনি কি 'নববর্ষ'-কে 'নবর্ষ' বলতে পারবেন? কি 'শারীরিক'-কে 'শারীক' বলতে পারবেন? পারবেন না। কেননা শব্দের ধ্বনির পরিবর্তন হয় দীর্ঘদিন ধরে লোকমুখে শব্দটি পরিবর্তিত উচ্চারণে উচ্চারিত হতে হতে অথবা অঞ্চলভেদে আঞ্চলিকতার টানে।
সুতরাং এটি প্রথমত, একটি দীর্ঘ সময়ের দাবি রাখে; অথবা, দ্বিতীয়ত, আঞ্চলিক ভাষার প্রভাবের প্রয়োজন হবে। 'মুজিবর্ষ' শব্দটির ক্ষেত্রে এর কোনোটিই প্রযোজ্য নয়। সুতরাং, নিশ্চিতভাবেই 'মুজিবর্ষ' বানানটির ব্যাকরণগত কোনো ভিত্তি নেই।
এখন তাহলে যারা 'মুজিবর্ষ'-কে নানান যুক্তি দেখিয়ে শুদ্ধ প্রমাণ করতে চান, তাদের জন্য আর একটিই সমাধান হাতে থাকে। এটি একটিমাত্র উপায়েই 'মুজিবর্ষ' হতে পারে— জোড়কলম শব্দ। কেউ কেউ এ যুক্তিও দিচ্ছেন। তারা বলছেন, এটি 'জোড়কলম শব্দ'-এর নিয়মে তৈরি হয়েছে। 'জোড়কলম শব্দ' ব্যাকরণের কোনো নিয়মের ধার ধারে না। এ-রকম শব্দ ইংরেজিতে অনেক দেখা যায়; যেমন- Motor+Hotel = Motel। বাংলাতেও এমন শব্দ আছে; যেমন- মিন্নত+বিনতি = মিনতি। জোড়কলম শব্দ তৈরির প্রক্রিয়াটি হলো, প্রথম শব্দের প্রথমাংশ আর দ্বিতীয় শব্দের শেষাংশ যুক্ত করে শব্দটি তৈরি হয়। যেমন- ওপরের উদাহরণে 'মিন্নত'র 'মি' এবং 'বিনতি'র 'নতি' নেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে যুক্তি হলো, মুজিব+শতবর্ষ = মুজিবর্ষ।
অর্থাৎ এক্ষেত্রে 'মুজিব' শব্দের 'ব' এবং 'শতবর্ষ' শব্দের 'শতব' লোপ হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়— 'মুজিব' কি আর দশটা শব্দের মতোই কোনো সাধারণ বাংলা শব্দ, যাকে চাইলেই ভেঙেচুরে পরিবর্তন করে ফেলা যায়? কেউ কি মন চাইলেই এভাবে জাতির পিতার নাম বিকৃত করার ধৃষ্টতা দেখাতে পারে? এটা করতে দেওয়া যায়? উত্তরটা আমাদের সবারই জানা।
'মুজিব বর্ষ', না-কি 'মুজিববর্ষ'?
'মুজিবর্ষ' তো বাতিল হয়ে গেল। এখন প্রশ্ন— 'মুজিব বর্ষ', না-কি 'মুজিববর্ষ'? কোন বানানটি শুদ্ধ? কেননা সরকারের বিভিন্ন ওয়েবসাইটে আমরা 'মুজিব বর্ষ' শব্দগুচ্ছ দেখতে পাই।
আরও পড়ুন : বিজয় দিবসে জানতে ইচ্ছে করে
এটি অত্যন্ত দুঃখজনক যে, সরকারের বিভিন্ন সংস্থার ওয়েবসাইটে 'মুজিব' ও 'বর্ষ' শব্দ দুটো আলাদা করে লিখিত হয়ে আসছে। কিন্তু ব্যাকরণিক দৃষ্টিকোণ থেকে 'মুজিব বর্ষ' বানানটিও শুদ্ধ নয়। শুদ্ধ বানানটি হবে 'মুজিববর্ষ'। এটি একটি সমাসসাধিত শব্দ। নিয়মটি হলো- সমাসবদ্ধ পদের অন্তর্গত পদগুলোকে সবসময় যুক্ত করে লিখতে হয়। এর ব্যাসবাক্য হতে পারে এমন: মুজিবকে উৎসর্গীকৃত বর্ষ (মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাস)।
লেখক : ওয়াহেদ সবুজ, প্রধান নির্বাহী, বানান আন্দোলন। তরুণ লেখক ও ভাষাবিদ।
ওডি/কেএইচআর
(মতামত পাতায় প্রকাশিত লেখা লেখকের একান্ত মত। এর সঙ্গে পত্রিকার সম্পাদকীয় নীতিমালার কোনো সম্পর্ক নেই।)
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড