• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৭ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

লটারির মাধ্যমে শিক্ষার উন্নয়নের আইডিয়া উদ্ভট-হাস্যকর

  রহমান মৃধা

১৬ ডিসেম্বর ২০২১, ১৩:০৩
লটারির মাধ্যমে শিক্ষার উন্নয়নের আইডিয়া উদ্ভট-হাস্যকর
ফাইজারের প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্টের সাবেক পরিচালক রহমান মৃধা (ছবি : সংগৃহীত)

ঢাকাসহ সারা দেশের সরকারি মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে ২০২২ শিক্ষাবর্ষে প্রথম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী ভর্তিতে আজ বুধবার ডিজিটাল লটারি অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ লটারির ফল প্রকাশ করেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি এর আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রী ছিলেন। যে সুযোগ এবং দায়িত্ব তিনি পেয়েছেন শিক্ষায় পরিবর্তন আনতে, তা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যোগ্য ব্যক্তি যোগ্য পজিশনে। তা সত্ত্বেও শিক্ষার পরিকাঠামোর সুচিন্তিত এবং সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে দেশের শিক্ষাপদ্ধতি অন্ধকারে হাবুডুবু খাচ্ছে। কী কারণ জড়িত শিক্ষার এই চরম অবনতির জন্য?

সমস্যা যদি না জানি সমাধান করা সম্ভব কি? জানা সমস্যার সমাধান না করে যদি নতুন সমস্যার সৃষ্টি করা হয় এবং সত্যিকারে 'রুট কজ' কী তা যদি এড়িয়ে চলা হয় হবে কি আদৌ সমস্যার সমাধান করা? সারাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা কি এক রকম? না হবার কারণ কী? দুর্নীতি বা ক্ষমতার অপব্যবহার যদি একটি বড় সমস্যা হয়ে থাকে তবে তার সমাধান না করে লটারির মাধ্যমে ভর্তি করা কি যুক্তিসঙ্গত? শুধু ক্ষেত্র বিশেষে এ পদ্ধতি চালু করলেই কি সমস্যার সমাধা হবে?

কী অবস্থা তাহলে যে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যুগ যুগ ধরে ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি চালু রেখেছে যেমন ক্যাডেট কলেজ, ঢাকা কেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল সহ শত শত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান? কী গ্যারান্টি আছে যে সেখানে দুর্নীতি হয় না? এবং সর্বোপরি আমার শেষ প্রশ্ন গোটা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কেন একই ধরনের সুযোগ সুবিধার অন্তর্ভুক্ত নয়?

আমি দূরপরবাসে বসবাস করলেও বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সাথে নিজেকে লতার মতো জড়িয়ে রেখেছি। জড়িয়ে রাখার কারণ একটিই আর সেটা হলো মেধা বিক্রি করে আমাদেরকে চলতে হবে। বাংলাদেশ জনবহুল দেশ, মেধাই হবে আমাদের সম্বল এবং সেটা হতে হবে ওয়ার্ল্ড ক্লাস। কিন্তু দেশের শিক্ষা পদ্ধতির যে দিকনির্দেশনার আভাস পাচ্ছি তাতে ভয় হচ্ছে ভেবে, যেমন ১৯ ডিসেম্বর রাজধানীর নায়েমে অনুষ্ঠিত হবে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভর্তি লটারির অনুষ্ঠান।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধুমাত্র লটারি পদ্ধতির কারণে প্রথম সারির শিক্ষার্থীরা ভালো স্কুলে পড়ার সুযোগ হারাবে। যদিও সরকার বলছে, এই পদ্ধতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মেধার সমতা ফেরাবে।

যতটুকু জেনেছি সারাদেশে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী আসন রয়েছে ৮০ হাজার ১১৭টি। এখন পর্যন্ত এই আসনের বিপরীতে ৫ লাখ ৩৮ হাজার ১৫৩ শিক্ষার্থী আবেদন করেছে। ফলে প্রতি আসনে ভাগ্য পরীক্ষা দিতে হচ্ছে ১৩ শিক্ষার্থীকে। এর ফলে শুধু মেধাবী শিক্ষার্থীই নয়, দুর্বল শিক্ষার্থীরাও ভর্তি হতে পারবে ভালো স্কুলে। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর জানায়, সারাদেশে সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মিলিয়ে মোট আসন সংখ্যা ১০ লাখ। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত আবেদন পড়েছে ৮ লাখের কিছু বেশি।

আরও পড়ুন : হৃদয়ে বাংলাদেশ

এর মধ্যে সরকারি মাধ্যমিকে ৮০ হাজার আসনের বিপরীতে আবেদন পড়েছে ৫ লাখ ৩৮ হাজার ১৫৩টি। তবে ব্যতিক্রম চিত্র বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে। বেসরকারি বিদ্যালয়ে ৯ লাখ ৩৫ হাজার আসন থাকলেও আবেদন পড়েছে মাত্র তিন লাখ। অর্থাৎ আবেদনের চেয়ে দুই লাখ আসন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ফাঁকা থাকবে।

অধিদপ্তর বলছে, এই পদ্ধতির ফলে যেমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মেধার সমতা আসবে, তেমনি শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপও কমবে। এছাড়াও বন্ধ হবে তদবির ও ঘুষ বাণিজ্য।

সবাই বলছে সমমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সবার পড়ার অধিকার আছে। এটি মৌলিক অধিকার। কিন্তু আজ সমাজ বিভক্ত। যে কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরও বিভিন্ন মান গড়ে উঠেছে। কোনোটাকে আমরা বলছি ভালো স্কুল, আবার কোনোটাকে বলছি ভালো স্কুল নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পার্থক্যের সঙ্গে শিক্ষার মানের পার্থক্যও সৃষ্টি হয়েছে। সবাই মেধাবী ফলে সবারই শিক্ষার সমান সুযোগ থাকা দরকার। তা না হলে ভর্তি আর লটারি বিষয়টি একই থেকে যাবে।

আবার অনেকে মনে করেন, আমার টাকা আছে। যদি সন্তানের পেছনে খরচই করতে না পারলাম তাহলে কী হলো! এ ধরনের মানসিকতা ক্ষুদে শিক্ষার্থীর জীবন বিষিয়ে তোলে। এতো অল্প বয়সে শিশুর মেধা যাচাইয়ের কিছু নেই। আন্তর্জাতিক পরিসরে যে যেই কমিউনিটির লোক তাদের বাচ্চারা সেখানেই পড়াশোনা করে। সমাজে মেধার সমতা নিশ্চিতে পরীক্ষার চেয়ে লটারি পদ্ধতিই বেশি বিজ্ঞানসম্মত। তাহলে জার্মান জাতির শিক্ষা পদ্ধতি সঠিক নয়? যেমন সেখানে প্রাথমিক পর্যায়েই মেধার যাচাই বাছাই হয়ে থাকে।

জেনেছি ডিজিটাল লটারি প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর প্রতিষ্ঠান প্রধান, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা টেলিটকের ওয়েবসাইট থেকে তাদের নির্ধারিত আইডি ও পাসওয়ার্ড দিয়ে ফলাফল দেখতে পারবেন। নির্বাচিত শিক্ষার্থীদের ভর্তির ক্ষেত্রে ভর্তি কমিটির সভা আহ্বান করে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ পূর্বক শিক্ষার্থীদের ভর্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এর মধ্যে কিছু আত্তীকৃত বিদ্যালয় আছে যারা কেন্দ্রীয় লটারিতে অংশ নিতে পারছে না।

এসব বিদ্যালয়ে পরবর্তীকালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে লটারির মাধ্যমে ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবে। তবে কোনো অবস্থাতেই কোন ভর্তি পরীক্ষা আয়োজন করা যাবে না। তবে এবারই সমঝোতার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয় পরিবর্তন করতে পারবেন।

আরও পড়ুন : বিজয় দিবসে জানতে ইচ্ছে করে

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ঢাকা শহরে ভিকারুননিসা, মতিঝিল আইডিয়াল এছাড়াও বেশকিছু মাফিয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনার মান যাই হোক না কেন, তারা সেরা শিক্ষার্থীদেরকে ছেকে নিয়ে বিদ্যালয়ে ভর্তি করে। এর ফলে সেখানে পড়াশুনো যাই হোক বা শিক্ষকের মান যেমনই হোক শিক্ষার্থীরা ভালো ফল করে। সেই বিবেচনায় আমরাও এসব প্রতিষ্ঠানকে সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি দিয়ে থাকি। তবে এই পদ্ধতি অনুসরণের ফলে চিরাচরিত ভালো প্রতিষ্ঠান চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। তারা যেমন ভালো শিক্ষার্থী পাবে, তেমনি দুর্বল শিক্ষার্থীও পাবে।

মেধার সমতার ভিত্তিতে তখন সেসব প্রতিষ্ঠান ভালো করলেই তাকে ভালো বলা হবে। যা আমাদেরকে একটি সুন্দর সমাজ ও সুন্দর দেশ বিনির্মাণে সহায়তা করবে। আমার প্রশ্ন তাহলে দেশের আরও যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেমন উপরে উল্লেখ করেছি, সেগুলোর ব্যাপারে কি ভাবা হচ্ছে?

শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য ভালো মানুষ তৈরি করা। ভালো দেশ ও সমাজ তৈরি করা। টেলিটকের মাধ্যমে মাত্র ১১০ টাকায় ৫টি বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা ঘরে বসেই অনলাইনে আবেদন করতে পেরেছে। এক্ষেত্রে তাদের একটি একটি করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও ঘুরতে হয়নি। ভর্তিযুদ্ধের নামে যে মানসিক চাপ থাকতো শিক্ষার্থীদের, এবার সেই চাপ থেকেও তারা মুক্ত। কিন্তু এ থিওরি শুধু ক্ষেত্র বিশেষে অ্যাপ্লাই করলে হবে কি?

ভর্তি পরীক্ষায় ঘুষবাণিজ্য ও তদবির চলতো। কিন্তু ডিজিটাল ভর্তি লটারিতে এইসব সুযোগ আর থাকবে না। মেধাকে হত্যা করতে হবে ঘুষ, তদবির এবং দুর্নীতি দমন করতে? অনেকটা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো হলো না?

এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এমন কথাও কেউ বলছেন ‘আমাদের সময়ে যাদের স্কুলে ১৭-১৮ রোল ছিল সে আজ সমাজে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু যার রোল ছিল এক সে পরবর্তী সময়ে পিছিয়ে পড়েছে। আমরা চাই শিশুদের অল্প বয়সে যেন শ্রেণিবিন্যাস না করা হয়।’ আমরা চাই প্রত্যেকটা শিক্ষার্থীই ভালো হোক। আমাদের সব প্রতিষ্ঠানে যেন ভালো পাঠদান হয় এ বিষয়টি বিবেচনা করা উচিৎ।

আরও পড়ুন : দেখা হয়েছিল পূর্ণিমা রাতে

শুধুমাত্র ঢাকা কলেজে নয়; বরং একটি স্ট্যান্ডার্ড সব প্রতিষ্ঠানে অনুসরণ করা উচিৎ। দেশ এবং জাতিকে ধ্বংস করার এটাই মনে হচ্ছে বর্তমান রাষ্ট্রের শেষ প্রচেষ্টা সেটা হলো লটারির মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন। ডিজিটাল পদ্ধতি চালু থাকা সত্ত্বেও যে দেশে জনগণ ভোট দিতে পারেনা সেই দেশেই ডিজিটাল পদ্ধতিতে লটারির মাধ্যমে শিক্ষার উন্নতি হবে বা দেশে সুশিক্ষা প্রতিষ্ঠিত হবে ভাবতেই গা শিউরে উঠছে!

লেখক : সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন।

[email protected]

ওডি/কেএইচআর

চলমান আলোচিত ঘটনা বা দৃষ্টি আকর্ষণযোগ্য সমসাময়িক বিষয়ে আপনার মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাই, সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইলকরুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড