রহমান মৃধা
গত কয়েক মাস যাবত বিবেকের সঙ্গে চলছে জীবনের লড়াই। জন্মের শুরু থেকে অদ্যাবধি কী করেছি, কেন করেছি, কী করা উচিৎ ছিল নানা বিষয় নিয়ে ভেবেছি। মনে হচ্ছে নিজের জীবনের সব সমস্যার সমাধান করতে পারলে গোটা বিশ্বের সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। কারণ আমার সমস্যাই পৃথিবীর সমস্যা আর সেই সমস্যার সমাধান মানেই পৃথিবীর সমস্যার সমাধান, যাকে বলে লোকাল কনসার্ন গ্লোবাল সোলিউশন।
কেন যেন মনে হচ্ছে জীবনের মানে খুঁজতে গিয়ে হৃদয়ের অনুভূতি বুঝতে শিখেছি। ছয় মাস হয়েছে স্টকহোম শহর ছেড়ে পাশের ছোট্ট একটি শহরে মুভ করেছি। অতীতের মতো সবকিছু উপভোগ করছি তবে অনুভূতিটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। মনে হচ্ছে এ এক নতুন দেশ। কথায় বলে হাজার লেকের দেশ সুইডেন। সত্যিই অপূর্ব এবং মনোরম দৃশ্য। আমি বড় ভাগ্যবান, কারণ আমার জীবনসঙ্গিনীও ঘুরতে পছন্দ করেন। তিনিও নেচারের ভক্ত। তাছাড়া চারিদিকে মানব জাতির মধ্যে যে মহামারির আতঙ্ক বয়ে চলেছে সেখানে সত্যিকারার্থে আমরা পরস্পর পরস্পরের পাশে সারাক্ষণ রয়েছি যা অনেকের জন্য সম্ভব হচ্ছে না।
সম্ভব না হবার পেছনে অবশ্য অনেক কারণ রয়েছে। যেমন- অর্থ, স্বার্থ, ব্যক্তিত্ব, কর্তৃত্ব, লোভ, লালসা এসব বিষয় আমাদের জীবনে প্রভাব ফেলেছে প্রচুর। এসব বিষয় যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় তখন ব্যক্তির চিন্তাধারার পরিবর্তন ঘটে, আর তখনই জীবন জটিল থেকে জটিলতর হতে শুরু করে।
আমরা সবাই সময়ের পরিবর্তনের সাথে কমবেশি জটিলতার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছি এবং সেটা আস্তে আস্তে এমন একটি পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে তাকে এখন নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
যেহেতু আমি আমাকে নিয়ে আলোচনা করছি তো স্বাভাবিকভাবেই ভ্রমণের শুরু সেই বাংলাদেশের ছোটবেলার দিনগুলো থেকে। একান্নবর্তী পরিবার যেখানে অর্থের চেয়ে স্বার্থ ছিল বড় এবং সেটা ছিল ভালোবাসার স্বার্থ। সেটা এখন ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ উল্টো হয়ে গেছে। এখনো সেই স্বার্থই বড় আছে তবে ভালোবাসার নয়, লোভ-লালসার স্বার্থ। যার ফলে পরিবারের মধ্যে দিনের পর দিন হিংসা, বিদ্বেষ, লোভ-লালসা ও ঘৃণার পরিমাণ বেড়ে চলেছে এবং হাজারও অমীমাংসিত সমস্যা যার কোনো সমাধান হচ্ছে না।
এটা শুধু যে আমার পরিবারে তা নয় এটা দেশজুড়ে বিরাজমান। অথচ এ বিষয় নিয়ে আমরা কিন্তু কথা বলি না, তবে পরনিন্দা বা পরচর্চা করতে খুবই পছন্দ করি। তার প্রমাণ যেমন বলি ফিলিস্তিন এবং ইসরায়েলের অমানবিক, অমীমাংসিত সমস্যা দেখে আমরা নিন্দা করছি অথচ তার চেয়ে জঘন্য ঘটনা দেখা যাচ্ছে নিজ পরিবারে সেটা নিয়ে আমরা কথা বলছি না, ভাবছি না। ভাবছি না পরিবারের শত শত অমীমাংসিত সমস্যা যা আমাদের অবর্তমানে ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনিদের চেয়েও জঘন্য রূপ ধারণ করবে বা করতে শুরু করেছে।
এটা যেমন একটি দিক যার কোনো মীমাংসা নেই অন্য দিকে বর্তমানের কী অবস্থা সেটা ভাবারও সময় নেই। তাহলে আমাদের জন্মের সার্থকতা কি শুধু পরনিন্দা আর পরচর্চার মধ্য দিয়েই শেষ হবে, নাকি ধ্যানে-জ্ঞানে-মানে তার সমাপ্তি হবে?
আরও পড়ুন : কৌতূহলের ছলে হলেও একবার ভেবে দেখো
অনেক কথাই বলা হলো, অনেক পথই চলা হলো। জন্মের সফলতা কী তার উত্তর হয়তো জানা গেল না, তবে মনে হলো চলমান জীবনের শিক্ষায় নিজেকে শাণিত করে মনুষ্যত্বের মহান ব্রত ধারণ করে নিরন্তর সামনের দিকে এগিয়ে চলার প্রত্যয়, সেখানে উন্নয়নচিন্তা আসছে জোয়ারের মতো।
মাঝেমধ্যে ভাটায় টানছে আবার কূলও ভাঙছে, অনেকে দিশা হারাচ্ছে। তারপরও জীবন চলছে, চলবে তার গতিতে। ভাঙনের পর নতুন চরের দেখা মিলবে, আবার সেই নতুন চরে গড়তে হবে স্বপ্নের আবাস, সেই চেতনায় মগ্ন জীবন। প্রকৃত পক্ষে এটাই জীবন শিক্ষার একমাত্র উপকরণ। একে অপরের হাত ধরে মানবতার জয়গান গেয়ে সৃজনশীল পথ পাড়ি দিব হৃদয়ের বন্ধনকে সুদৃঢ় করে।
অন্য দিকে সংসার, সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে পাশ্চাত্যে দেখা যাচ্ছে স্বামী-স্ত্রী মাঝে মধ্যে কিছুদিনের জন্য একা থাকে বা ভ্রমণে বের হয়। অনেকে একত্রে বসবাস করলেও দেখা যায় তারা তাদের নিজ নিজ বাসাবাড়িটি ধরে রাখে। অনেকেই অর্থনৈতিক ভাবে সেলফডিফেন্ডেড। অনেকের ধারণা সারাক্ষণ একসঙ্গে থাকার কারণে সম্পর্কের অবনতি হয়। একাধারে যদি দিনের বেশির ভাগ সময় একসঙ্গে থাকা হয়, তবে কখনো কখনো ভালোবাসা বৃদ্ধির বিপরীতে কিছু একঘেয়েমি, কিছু ভুল বোঝাবুঝি, কিছু রাগ, অভিমান এবং শেষমেশ ঝগড়াঝাঁটি পর্যন্ত হয়। স্বামী–স্ত্রী নিজেদের মাঝে আলাদাভাবে একটু জায়গা করে নিতে চেষ্টা করে। যখন মনে করে একেবারে একান্তই তাদের আলাদা কিছু সময় দরকার তখন সেটা করে থাকে। তাতে নিজের জীবনে অন্যজনের গুরুত্ব অনুধাবন করার কিছুটা সময় পেয়ে থাকে।
খুব বেশি দিন একসঙ্গে দিনরাত থাকার যেমন সুবিধা আছে, অনেক ক্ষেত্রে অসুবিধাও আছে। একসঙ্গে থাকলে মাঝেমধ্যে চরম বিরক্তি এবং পরস্পরের প্রতি অনাগ্রহ আসতে পারে। তবে এমন নয় যে ভালোবাসা আসে না। এটা সবার ক্ষেত্রে নয়, তবে অনেকের ক্ষেত্রে হয়। করোনা প্যান্ডামিকের সময় লকডাউনের কারণে স্বামী–স্ত্রী একটা দীর্ঘ সময় কাছাকাছি থাকার সুযোগ পেয়েছে।
শুরুর দিকে ব্যাপারটা বেশ সাবলীল ও রোমান্টিক হলেও আস্তে আস্তে বিরক্তির কারণ বেড়েছে। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের জায়গা দিন দিন হারিয়েছে। নানা ক্ষেত্রে ভুল বোঝাবুঝি ব্যাপক হারে বেড়েছে। শেষ পর্যন্ত বিচ্ছেদে গিয়ে নিষ্পত্তি হয়েছে।
আবার একেবারে কাছাকাছি থাকলেই যে শ্রদ্ধাবোধ চলে যায়, তা-ও নয়। মানুষ হয়তো একটু পরিবর্তন চায়। আসলে অনেক পরিবারে অনেকের রুচিবোধ আলাদা।
সংসার করবেন অথচ ঝামেলা হবে না, তা তো নয়। অল্পস্বল্প সমস্যা থাকবে, তা নিয়েই চলতে হবে। তবে সহ্যের সীমা অতিক্রম করলেই বিচ্ছেদের প্রশ্ন আসে। কেন ইদানীং বেশি বিচ্ছেদের আবেদন হচ্ছে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল, বেশির ভাগ নারী বিচ্ছেদের আবেদনে উল্লেখ করেছেন, স্বামীর সন্দেহবাতিক মানসিকতা, পরকীয়া, স্বামীর উদাসীনতা, যৌতুক, মাদকাসক্তি, ফেসবুকে আসক্তি, ব্যক্তিত্বের সংঘাত, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ইত্যাদি।
অন্য দিকে স্বামীর পক্ষে আবেদনের ক্ষেত্রে স্বামীর ইচ্ছাকে প্রাধান্য না দিয়ে নিজের ইচ্ছায় চলা, ফেসবুকে আসক্তি, বদমেজাজ, সংসারের প্রতি কম মনোযোগ দেওয়া, ধর্মকর্মে উদাসীনতা, বন্ধ্যত্বসহ বিভিন্ন কারণ দেখানো হয়েছে। এসব তত্ত্ব আগামী দিনের জন্য ভয়াবহ।
একটা বিচ্ছেদ মানে কেবল দুজন আলাদা হওয়া নয়। একটা পরিবারের বিচ্ছেদ, বাচ্চাদের বিচ্ছেদ। তবে একেবারে নিরুপায় হয়ে গেলে বিচ্ছেদ ছাড়া উপায়ও থাকে না।
লকডাউনের কারণে দিনের পুরো সময়ই স্বামী-স্ত্রী কাছাকাছি থাকছেন। তাতে করে ছোটখাটো বিষয় নিয়েও পরস্পরের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দিচ্ছে। এমনকি অন্য সময় হলেও খুব কাছাকাছি থাকলে, সন্দেহবাতিকতা, ফেসবুক নিয়ে সন্দেহ, পারস্পরিক সম্মান ইত্যাদির ঘাটতি থাকে বিধায় ছোটখাটো ঝগড়া বিচ্ছেদে গড়ায়। বেশিরভাগ বিচ্ছেদ মধ্যবিত্তসহ, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী পরিবারেও হচ্ছে। এটা শুধু পাশ্চাত্যে নয় গোটা বিশ্বের সমস্যা বর্তমানে।
আরও পড়ুন : সুইডেনে ভূত?
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার সম্পর্কে একটু জায়গা দরকার। নিজেদের কিছুটা আলাদা সময় দরকার। পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা, মূল্যায়ন, সম্মান, শ্রদ্ধাবোধ দেখানো দরকার। সংসারে সবকিছু যে একজনের ভালো লাগায় হবে, তা কেন? কখনো কখনো অন্যের ভালো লাগার গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ।
সদ্য ঘটে যাওয়া ঘটনা বিল গেটস এবং তার স্ত্রী মেলিন্ডার বিবাহ বিচ্ছেদ নিয়ে বাংলাদেশে যেভাবে লেখালিখি চলছে বিশ্বের অন্য কোথাও তেমনটি দেখা যাচ্ছে না। কেন যেন মনে হচ্ছে আমরা অন্যের সমস্যায় বেশ জড়িয়ে পড়ি। শিক্ষণীয় হলেও কথা ছিল বরং পরনিন্দা এবং পরচর্চায় মগ্ন থাকাটা কেমন যেন নেশা এবং পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিল গেটস এবং তার স্ত্রী যত ধনীই হোক না কেন তারাও তো মানুষ। ভালোবাসা যে সবার জন্য সমান এবং সেটার ভাঙ্গন শুধু গরীবদের ক্ষেত্রে হয়, এ জীবনে কোনোদিন শুনিনি বা দেখিনি। বিল গেটসের পরিবার আর দশজন পরিবারের মতো, যদিও অনেকের কাছে সেটা বিশ্বাস হবে না।
তাদের ছেলে-মেয়ে বড় হয়েছে, আগের মতো যৌথ দায়িত্ব কর্তব্য হয়ত নেই। অতীতে যেমনটি একসঙ্গে কাজ করেছে এখন তেমনটি নয়। যৌবনের জোয়ার এখন হয়তো ভাটায় যেতে শুরু করেছে, যার কারণ হতে পারে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ। "অলির কথা শুনে বকুল হাসে, কই তাহার মত তুমি আমার কথা শুনে হাসো না তো।
জীবনে যখন হাসি তামাশা না থাকে তখন নিভে যায় আলোর ঘর। যাই হোক না কেন যদি শিক্ষণীয় কিছু না থাকে তবে কেন এত জল্পনা কল্পনা? চাঁদের গায়ে যদি দাগ পড়তে পারে তবে কেন তাদের জীবনে দাগ পড়বে না? ভালোবাসা সেতো একদিনের জন্য নয়, ভালোবাসা প্রতিদিনের ব্যাপার, প্রতিক্ষণের ব্যপার।
জীবনে শুধু অর্থ নয় দরকার স্বার্থেরও সেদিকে নজর দিতে হবে। আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি ভালোবাসায় রয়েছে শুধু ভালোবাসা, সুতরাং মন খুলে প্রিয়জনকে ভালোবাসুন। এই ভালোবাসা হোক কিছুটা ভিন্ন ধরনের যেমন খাবারের টেবিল বা বসার ঘরে। একটু সুন্দর করে সাজিয়ে একটি মোমবাতি জ্বালিয়ে দিন।
এতে করে একটা আলোছায়ার পরিবেশ তৈরি হবে। সেই আলোছায়াতে প্রিয়জনের সঙ্গে মুহূর্তগুলো হয়ে উঠবে আরও রঙিন। রেস্টুরেন্টগুলোও এখন সে রকম খোলা নেই। কিন্তু ঘরে কিছু মজার খাবারের আয়োজনে কিছুটা ভিন্নতা আনতে পারেন বা পিকনিক করতে পারেন।
দুজনেই হয়তো একে অন্যের পছন্দের কোনো খাবার রান্না করলেন বা বানালেন নিজের মতো করে। তারপর সেটা নিয়ে বসলেন আড্ডা দিতে। একে অন্যের পছন্দ–অপছন্দকে গুরুত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে এর থেকে ভালো উপায় আর কী-বা হতে পারে!
তবে রান্নাবান্না ঠিক আপনার কর্ম না হলে বাইরে থেকে খাবার অর্ডারও করে নিতে পারেন। বিল গেটস আর মিলেন্ডার বিচ্ছেদ নিয়ে তামাশা ছেড়ে বরং নিজের জীবনসঙ্গীর সঙ্গে আনন্দময় কিছু মুহূর্ত কাটান দেখবেন ভালো লাগবে। লকডাউনে এক সঙ্গে থাকার মাঝে যে মজা, জীবনে এ সুযোগ হয়ত আর নাও আসতে পারে, এমন সুযোগ হেলায় হারানো কি ঠিক হবে?
আরও পড়ুন : দেখা হয়েছিল পূর্ণিমা রাতে
চাঁদের আলোয় রাত যেমন আলোময় হয়ে যায়, ঠিক তার মতো একে অপরের একান্ত সময়ে ভালোবাসার মাঝে হারিয়ে যাওয়া ক্ষণিকের তরে, ভাবতেই গা শিউরে উঠছে।
লেখক : রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন।
ওডি/কেএইচআর
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড