• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩১ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

যদি ফিরে পেতাম হারিয়ে যাওয়া সেই শৈশব

  সাজ্জাদুল আলম শাওন, দেওয়ানগঞ্জ (জামালপুর)

০৪ নভেম্বর ২০২১, ১৪:২৯
যদি পেতাম ফিরে হারিয়ে যাওয়া সেই শৈশব
হারিয়ে যাওয়া সেই শৈশব । ছবি : অধিকার

আমাদের শৈশব কেটেছে খালে বিলে মাছ ধরে, বাড়ির পুকুর পাড়ে ও মাঠেঘাটে খেলাধুলা করে। এই বাড়ি, ঐ বাড়িতে ঘুরে টিভি, ভিডিও দেখে। প্রতি শুক্রবার বিটিভিতে বাংলা সিনেমা হতো। সপ্তাহের এই দিনে সিনেমা দেখার জন্য উৎসুক হয়ে থাকতাম। কখন প্রতীক্ষার এই ক্ষণ আসবে। আমাদের বাড়ীতে তখন কোনো টিভি ছিল না। এমনকি আমাদের এলাকায় দুই একটি পরিবার ছাড়া কারো বাড়িতেই টিভি পাওয়া দুষ্কর ছিল।

যাদের বাড়িতে টিভি ছিল সিনেমা শুরু হওয়ার ১/২ ঘন্টা আগেই গিয়ে বসে থাকতাম। আমাদের সাথে থাকা কিছু বন্ধুরা তখন টিভির মালিকদের বিভিন্ন কাজে সাহায্য করতো। আবার মনে হলে দান পিঠে কিছু বন্ধুরা দূরদূরান্তে গিয়ে পালাগান, যাত্রাপালা ও মাহফিল শুনে আসতাম। দল বেঁধে মক্তবে, স্কুল, মাদ্রাসায় যাওয়া, কৃষি কাজ, ঘুড়ি উড়ানোসহ সবাই মিলে গ্রামীণ খেলা গোল্লাছুট, কাবাডি, দাড়িয়াবান্ধা, কানামাছি, বৌছি খেলেছি। নবান্নের উৎসবে কৃষাণের সাথে দিনে, রাত জেগে বাড়ির উঠানে গরু দিয়ে ধান মাড়িয়েছি, সেসব কাজের অনেক কিছুই এখন প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বিলুপ্ত প্রায়। গ্রামীণ সংস্কৃতির অনেক কিছুই বিলীন হয়ে হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে।

শৈশব নিয়ে কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ স্যার বলেছেন, ‘আমার শৈশবটা কেটে গেছে দুঃখ মেশানো আনন্দে-আনন্দে। যতই দিন যাচ্ছে সেই আনন্দের পরিমাণ কমে আসছে। আমি জানি, একসময় আমার সমস্ত পৃথিবী দুঃখময় হয়ে উঠবে। তখন যাত্রা করব অন্য ভুবনে, যেখানে যাবতীয় আনন্দ বেদনার জন্ম’। সত্যিই তাই, আমাদের জীবনে শৈশব কৈশোরের মতো আনন্দ আর নেই। এখন প্রযুক্তির জাঁতাকলে আমাদের সেই শৈশব হারিয়ে গিয়েছে। এভাবেই আমাদের স্মৃতি কোঠায় জমা রয়েছে হাজারো স্মৃতি। হারিয়ে যাওয়া সেই শৈশবের ছোট দিনগুলোতে কার না ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। ‘সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি… । ’

সামান্য বৃষ্টি হলেই ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে পড়তাম বিদ্যালয় মাঠ অথবা খোলা ধান ক্ষেতের মাঠে। হাজারো আনন্দমাখা খেলায় মেতে উঠতাম। কেউ খেলত ফুটবল আবার কেউ গোল্লাছুট। খেলার আনন্দে হারিয়ে যেতাম ভিন্ন এক জগতে। সেখানে থাকতনা কোনো হিংসা-বিদ্বেষ। বৃষ্টিতে সামান্য কিছু পানি জমলেই মাছ ধরতে নেমে পরতাম। আবার বিরামহীন বৃষ্টি মৌসুমে দু’জন বা তার চেয়ে বেশি বন্ধুবান্ধব মিলে বিল, হাওর বা হঠাৎ জেগে ওঠা কোনো জলাধারে সময় কাটাতে ব্যাকুল হয়ে পরতাম। কেউ একটা মাছের সন্ধান পেলেই হুমড়ি খেয়ে সেটার পিছেই লেগে থাকতাম। যতটা না মাছ পাওয়া যেত, তার চেয়ে ঢেরগুণ বেশি পাওয়া যেত আনন্দ। পাওয়া যেত রাশি রাশি হাসি আর দুষ্টুমির লাগালাগি।

আজ হঠাৎ রাস্তা দিয়ে যাওয়ার পথে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার এক খালে একদল দানপিঠে শিশু মাছ ধরায় ব্যাস্ত হয়ে আছে। তাদের উচ্ছ্বাস, হাসাহাসি, চিল্লাচিল্লি যেন সেই পরিবেশকে অন্যরকম এক মুহূর্তের সৃষ্টি করেছে। মাছ ধারা চেয়ে তাদের মাছের পিছনে দৌড়াতেই আনন্দ বেশী লক্ষ করা গেছে। তাদের এই দুরন্তপনা দেখে কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে পরি। হারিয়ে যায় পুরনো দিনে। খুঁজে ফিরি সেই শৈশবের আনন্দ। শৈশবে মাছ ধরা ছিল আমার অন্যতম নেশা। বর্ষা মৌসুমের শুরুতে জোয়ারের পানিতে খাল ভরে যেত। ফসল ছাড়া জমিতে ৩০-৪০ ফুট বা তারও বেশি লম্বা লাইলন সুতাতে এক হাত পরপর এক-দেড় হাত সুতার মাথায় বরশী লাগিয়ে মাছের আধার দিয়ে টোপ ফেলতাম। সেই সাথে ধানি জমি কিংবা ধইঞ্চাসহ অন্য ফসলী জমির মাঝে মাঝে লার পাততাম, তাও কচুরি পানার কঞ্চি কিংবা ধইঞ্চা দিয়ে তৈরি হাতলের মাঝে এক-দেড় হাত সুতায় বরশী লাগিয়ে জির-আটা দিয়ে টোপ ফেলতাম, বরশী পানির নিচে থাকতো, কচুরিপানা বা ধইঞ্চার হাতল ভেসে থাকতো পানির উপর। যেখানে কয়েক ঘণ্টা পরপর দেখতাম মাছ লাগছে কি না। মধ্যরাতে দেখে এসে, ঘুমিয়ে পুনরায় সকালে গিয়ে দেখতাম। মাছের পাশাপাশি প্রায় সময় শাপ, কুইঞ্চাও লাগতো বরশীতে। সেই সাথে কারেন্ট জাল পেতেও মাছ ধরা হতো।

সম্প্রতি দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার এক পরিত্যক্ত খালে স্কুল পড়ুয়া শিশু শিক্ষার্থীরা নেমে পড়েছে মাছ ধরতে। তাদের ছোট ছোট হাত দিয়ে মাছ ধরায় তারা ব্যস্ত। মাছ ধরার মহানন্দে তারা আত্মহারা। একজনের নাম জিজ্ঞেস করতে উত্তর এলো নাম সাগর, জিজ্ঞাসা করতেই সে হাসি মুখে উত্তর দিল। এখনো পর্যন্ত কোনো মাছ ধরতে পারি নাই। দুইটা মাছ হাতের নিচে পরেছিল কিন্তু আটকাতে পারি নাই। এখানে মাছ নয়, ব্যাঙ আছে বেশি।

পাশ থেকে সাব্বির বুলে উঠলো, এক ঘণ্টা থেকে মাছ ধরছি। কিন্তু বেশী মাছ পাই নাই। প্রথমে কয়েকটা মাছ দেখতে পেয়ে আমার বন্ধুদের দেকে নিয়ে আসি। এসে দেখি মাছ বেশি নাই। তাদের মাছ রাখার পাত্র তখনও খালি। অথচ এক ঘণ্টার পরিশ্রম তাদের গায়ে ঘাম হয়ে ঝরে পড়ছে। সাব্বির দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার দপরপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণীর ছাত্র। তার কথা বলার ভঙ্গি সত্যি ছিল অসাধারণ।

মাছ ধরা নিয়ে গ্রামের এক সময় অনেক কুসংকাস্কার প্রচলিত ছিল। মাছ ধরার সাথে জ্বিনের (কাল্পনিক শয়তান) এক নিবির সম্পর্ক ছিল। কেউ যদি দিনের বেলায় মাছ ধরবে বলে পরিকল্পনা করত, রাতে তার কাছের পরিচিত জন হয়ে ডাকতে আসত। গ্রামে বা শহরেও প্রচলিত আছে সন্ধ্যার পর থেকে মাছের উপর জ্বিন ভর করে। সেই সাথে মাঝরাতে মাছ ধরতে গেলে কত ধরনের অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটত। কিন্তু আমি সেটা কখনোই দেখিনি। অন্যদের থেকেও শুনেছি এ ঘটনা।

ছোটবেলায় জমির মাঝখানে গাছ দেখলেই ভাবতাম ভূত প্রেত, জ্বিন থাকে এগুলোতে। দিনের বেলায়ও অনেক সময় কাছ দিয়ে যেতাম না। রাতের বেলায় মাছ ধরতে গেলে দেখতাম গাছের উপর আগুলের উল্কা পরছে। কি যে ভয় পেতাম তখন, বলার মতো না। এক সময় ভয় কেটে যায়। দিনের বেলায় জমির মাঝখানে গেলে গাছে উঠতাম। বসে আড্ডা দিতাম। তবে কাক, ইগলের বাসা থাকত অনেক। জমির মাঝখানে একটা গাছ মানে, রোদে পুড়ে কাজ করা কৃষকদের রোদকে ফাঁকি দিয়ে একটু শান্তির পরশ পাওয়া। বাড়ি থেকে নেওয়া খাবারগুলো গাছের ছায়ায় বসে খাওয়া।

সময়ের পথ ধরে একদিন হয়তো এই শিশুরা এগিয়ে যাবে জীবন সফলতার পথে। অনেকে হয়তো তুলনামূলকভাবে পেছনেই পড়ে থাকবে দুঃখ-গ্লানি আর হতাশা বয়ে বয়ে। তবে শৈশবস্মৃতিরা আর পিছিয়ে পড়া প্রিয় শৈশব বন্ধুরা জীবনের মণিকোঠা থেকে কখনোই হারায় না। জীবনের কোনো এক মুহূর্তের একবিন্দু অবসরে তারা প্রতিবারই পাশে এসে নীরবে দাঁড়ায়।

ওডি/ এসএ

চলমান আলোচিত ঘটনা বা দৃষ্টি আকর্ষণযোগ্য সমসাময়িক বিষয়ে আপনার মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাই, সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইলকরুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড