মাহবুব নাহিদ
আমার মনে হয় আমাদের দেশে অসাম্প্রদায়িক নামে যে একটা বচন ধ্বনিত হয় এরমধ্যে যথেষ্ট গলদ আছে। মানুষ কখনোই অসাম্প্রদায়িক হতে পারে না, হতে পারে সম্প্রদায় নিরপেক্ষ! এখানে কেউ কেউ আসলে সেই সম্প্রদায় নিরপেক্ষ হতে চায় না। যার টা সে করুক! যার ধর্ম নির্বিঘ্নে পালন করবে, একজনও যদি এক ধর্মের থাকে তাহলে তারও অধিকার আছে!
আর সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে কেউ যখন আঘাতপ্রাপ্ত হয়, খুন হয় তখন সংখ্যালঘু কিংবা সম্প্রদায় নিয়ে পরিচয় দেওয়াটা! একটা দেশের মানুষ আহত বা নিহত হয়েছে এটা সবার জন্যই সমান হবে কিন্তু কেন ধর্ম আসবে? কেন আমরা দেশের নাগরিক হতে পারি না?
এবার আসি অবমাননা ইস্যুতে! আমি জানি যে আমার পবিত্র কুরআন শরীফ কোনো মূর্তির কাছে রাখলে সেটা অন্যায় হবে, একজন প্রকৃত হিন্দুও চাইবে না তার পবিত্র দেবতা বা দেবীর হাতে কুরআন থাকুক! এটা তাদের জন্যও অবমাননার! আমাদের দেশের মানুষ, আমরা ধর্ম নিয়ে বড্ড স্পর্শকাতর। এই দুই শ্রেণির মানুষ এটা করতে পারে না। আবার করতেও পারে, যদি কারও এখানে কোনো সুবিধা থাকে। এখন অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করে কারা বা কে সুবিধা নিল সেটা আলোচ্য বিষয়!
আমাদের দেশে একের পর ইস্যু জন্ম নেয়, এই ইস্যুগুলো কে বা কারা স্বেচ্ছায় তৈরি করে। যার ভেতরে ভেতরে তারা কোনো না কোনো গোল দিয়ে দেয়! এবার কে কীভাবে গোল দিয়ে দিল! সেটা দেখার বিষয়! তা ভাই, কুরআন শরীফ অবমাননা যে করেছে সে নিশ্চয়ই পাপ করেছে। কিন্তু যারা মূর্তি ভেঙে বা অন্য ধর্মের মানুষকে মেরে অন্য ধর্মের অবমাননা করেছে! এটা পাপ নয়? কেউ আপনার ধর্মকে অবমাননা করেছেই হয়তো, তাই বলে আপনি তার দেবতা ভাঙতে যেতে পারেন না। মানুষ খুন করতে পারেন না, ধর্ষণ করতে পারেন না। আপনি ধর্ম নিয়ে এত সচেতন কিন্তু আপনি এটাই জানেন না যে আপনার ধর্ম অন্য ধর্মকে অবজ্ঞা করার নির্দেশ আপনাকে দেয়নি! আপনাকে সবার ওপরে সদয় হতে দিয়েছে।
আর সবচেয়ে বড় একটা গলদ হচ্ছে, সংখ্যালঘু শব্দটা! একটা দেশে সবাই সমান, এখানে আর সংখ্যালঘু কিসের? সংখ্যালঘু শব্দটায় আমার ঘোর আপত্তি। একই দেশের নাগরিক আবার সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু কিসের? আমার পরিবারে দুই ভাই আর এক বোন থাকলে বোনকে কি সংখ্যালঘু বলব? কিংবা বাংলাদেশের যে জেলায় জনসংখ্যা সবচেয়ে কম তাদের সংখ্যালঘু জেলা বলব? আমাদের তো সবার একটাই পরিচয় থাকা উচিত আর তা হলো আমরা বাংলাদেশি।
হিন্দু-বৌদ্ধ-খিস্টানদের ওপর হামলা হলে, তাদের বাড়ি ভাংচুর হলে সংখ্যালঘু নির্যাতন বলা হয়, তাহলে মুসলমানদের হামলা হলে কি সংখ্যাগুরু নির্যাতন বলব? মোটেও তাই নয়। আমি মনে করি হামলা কিংবা নির্যাতন সেটা সবার জন্যই এক। আমাদের এই সংখ্যালঘু নির্যাতনের ধারণা থেকে বের হয়ে আসতেই হবে। দেশের যার ওপর হামলা হোক, বাড়ি ভাংচুর হোক তখন আমাদের ভাবতে হবে বাংলাদেশি নাগরিকের ওপর হামলা হয়েছে। আসলে সংখ্যালঘু শব্দটাকে বানাল কারা? তারা নিশ্চয়ই আমাদের দেশের শত্রু, আমাদের মধ্যে একটা বিভক্তি করার জন্যই এই প্রচেষ্টা হয়তো। দেশ স্বাধীন হয়েছে সবার প্রচেষ্টায়, সবার দেশের প্রতি সমান অধিকার আছে, এই দেশে নিরাপদে বসবাসের অধিকার রয়েছে।
আমি বিশ্বাস করি, আমাদের দেশে যে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য বিদ্যমান তার ব্যতিক্রম আছে। কিন্তু ভণ্ড বকধার্মিক আছে, এদেরকে একদম প্রশ্রয় দেওয়ার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। এদেরকে কঠোর হাতে দমন করতে হবে। আইনের আওতায় আনতে হবে। আমাদের দেশে শুধুমাত্র বিচারহীনতা অপরাধ অনেকাংশে বাড়িয়ে দেয়। সঠিক সময়ে সঠিক বিচার হলে ঠিকই এরা প্রশ্রয় পেত না!
জাতিগত হামলা বা নির্যাতন পৃথিবীতে খুবই স্বাভাবিক একটা ঘটনা। সারা বিশ্বজুড়েই এই ঘটনা চলতে থাকে। কথায় বলে, জোর যার মুল্লুক তার। তাই যারা সংখ্যার দিক দিয়ে এগিয়ে থাকে নিজেদের বল প্রকাশ করতে চায়, নিজেদের শক্তি দেখাতে চায়। এটাই হচ্ছে সংখ্যালঘু আর সংখ্যাগুরুর তত্ত্ব। বিশ্বজুড়ে এই প্রথা চলে আসছে। একেক সময় একেক গোত্রের ওপর চলে এই নির্যাতন। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন হলো, ভারতে মুসলমানদের ওপর চলছে, ফ্রান্সেও চলছে মুসলমানদের ওপর, বাংলাদেশেও বিভিন্ন সময়ে দেখা যায় নির্যাতন।
শুধুমাত্র শারীরিক নির্যাতন যে ঘটে তা কিন্তু নয়। বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপর ধর্মের স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে নোংরামি করা হয়। আসলে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের যে মূল চিন্তাটা আছে সেটা কেউই বুঝতে পারে না। অসাম্প্রদায়িক বলতে আমি যেটা বুঝি তা হচ্ছে সাম্প্রদায়িক বৈষম্যহীনতা। এর মানে হচ্ছে সাম্প্রদায়িক নিরপেক্ষতা। এর মানে নিজের সম্প্রদায় বাদ দিয়ে দেওয়া নয়। এর মানে হচ্ছে, সকল সম্প্রদায়কে সম্মান করা, সকলের সমান অধিকার নিশ্চিত করা।
তবে একটা বিষয় সত্য যে অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশে এই ধরনের ঘটনা অনেক কমই হয়। আমাদের দেশে সৌহার্দ্য, ভ্রাতৃত্ব অনেক ভালো। কিন্তু তবুও কিছু অসাধু ব্যক্তি আছে যারা নিজেদের প্রোপ্যাগান্ডা ছড়াতে চায়।
আরও পড়ুন : শহীদ না হলে সোনার বাংলা বিনির্মাণে কাজ করতেন শেখ রাসেল
বিভিন্ন সময়ে আমাদের দেশে হামলার ঘটনা দেখা যায়। এই হামলার মাধ্যমে কাদের সুবিধা হচ্ছে এটা ক্ষতিয়ে দেখা উচিত। এই হামলা কারা করছে তাদের চরম শাস্তি দেওয়া উচিত। তারা দেশে হয়তো একটা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চায়। কিন্তু কোনো ধর্মই কিন্তু অন্য ধর্মকে অপমান করার কথা বলে না, বরং সকলকে সম্মান দেখানোর কথা বলে। যে যার ধর্ম পালন করবে এটাই কাম্য কিন্তু কেউ অন্যের ধর্মকে কটাক্ষ করবে তাও ঠিক নয়। এদেরকেও বিচারের আওতায় আনা উচিত।
দুঃখের বিষয় হলো, এই ঘটনাগুলো ঘটছে অধিকাংশই ফেসবুকের ওপর ভিত্তি করে, আমরা কতটা উন্মাদ হয়ে গেছি ভাবতে অবাক লাগে। সময় এসেছে এই খোলস উন্মোচনের, এরা আমাদের দেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করার পায়তারা চালাচ্ছে। এ ষড়যন্ত্র বন্ধ করতে হবে। সকলের ওপর নির্যাতন বন্ধ করতে হবে, কোনো ধর্মের ওপর কারও বিদ্বেষ থাকা চলবে না। মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবাই আমরা সমান, সবাই মিলে আমরা বাংলাদেশি, কেউ এখানে সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু নয়। এই ধারণা যেদিন সবার মাঝে প্রতিষ্ঠিত হবে সেদিন সকল ফ্যাসাদ বন্ধ হবে।
ওডি/নিলয়
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড