• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৬ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

হৃদয়ে এসেছে শরৎ

  রহমান মৃধা

২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৪:৪১
হৃদয়ে এসেছে শরৎ
ফাইজারের প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্টের সাবেক পরিচালক রহমান মৃধা (ছবি : সংগৃহীত)

গ্রীষ্মের আমেজ, বসন্তের বাহার মানুষের দেহ–মনকে ভরিয়ে রাখে শত রকমের অজানা ফুলের সমারোহে। রমণী যেন রঙিন হয়ে পরিণত হয় একটি ফুটন্ত ফুলে। সূর্যের একটু আলো পেতে এবং শরীরের ফ্যাকাশে সাদা রং বাদামি করতে সব সৈকতে বসে রৌদ্রস্নান করে। লেক থেকে শুরু করে সব সমুদ্রের পাড়ে রমণীদের মেলা বসে। ভালোবাসার ছোঁয়া নিয়ে তারা যেন বসে আছে পথ চেয়ে কারও জন্য। তারপর হঠাৎ করেই যেন প্রকৃতি বদলাতে শুরু করে। গ্রীষ্মের মতো শরৎও এক সময় শেষ হয়ে যায়।

বাংলা বর্ষপঞ্জিতে বছরকে ছয়টি ঋতুতে বিভক্ত করা হয়েছে; যথা গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত। এ জন্যই বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। বিশ্বের অধিকাংশ দেশে বসন্ত, গ্রীষ্ম, হেমন্ত ও শীত—এই চারটি ঋতু রয়েছে। সুইডেন তার মধ্যে একটি। ঋতু হচ্ছে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে ভূপৃষ্ঠের কোনো একটি স্থানের জলবায়ুর ধরন।

মহাকাশে সূর্যের অবস্থানের সাপেক্ষে পৃথিবীর অক্ষের অবস্থানের পরিবর্তনের কারণে কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থানে ঋতু পরিবর্তন হয়। মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে এ দেশে ঋতুর আবির্ভাব ঘটে এবং সেগুলো পর্যায়ক্রমে আবর্তিত হয়। সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর মাস মিলে যে ঋতুটি, তাকে সুইডেনে বলা হয় হোস্ত। বাংলাদেশের শরৎ ও হেমন্তের সমন্বয়ে সুইডিশ হোস্ত ঋতুটি।

দেখতে দেখতে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার সামার শেষ হয়ে গেল। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নতুন অনুপ্রেরণা নিয়ে শিক্ষার্থীদের আমন্ত্রণের সঙ্গে বরণ করছে। কর্মজীবনে কিকঅফের মধ্য দিয়ে ছোট–বড় কোম্পানিগুলো কর্মচারীদের মোটিভেশন ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন ধরনের অ্যাকটিভিটিস বা টিম বিল্ডিংয়ের ব্যবস্থা করছে।

আমাদের রাজা স্পিকারের অনুরোধে জাতীয় সংসদ উদ্বোধন করেন প্রতিবছর একই সময় সুইডিশ ট্র্যাডিশন অনুযায়ী। এ বছর ১৪ সেপ্টেম্বর, জাতীয় সংসদের (রিক্সডাগ) নতুন কার্যদিবস শুরু হয়েছে।

নতুন প্রজন্মের অনেকের জন্য প্রথম স্কুলজীবন শুরু হয়েছে। কেউ নতুন কিছু পেল কেউ আবার পুরনো কিছু হারাল। চারদিকে বেশ পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। এ সময়ের সকালটা আর সূর্যের কিরণ দিয়ে শুরু হচ্ছে না। আকাশ মেঘে ঢাকা কিছুটা অন্ধকার এ সময়টিতে।

খোলামেলা বা হালকা কাপড়ে চলাফেরা করার সময় শেষের পথে। হঠাৎ এক ঝলক সূর্যের আলো যখন গাছপালার ওপর পলক ফেলছে, ঠিক তখন এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য সবার নজর কেড়ে নিচ্ছে। কারণ, শরতের আবির্ভাব একটু একটু দেখা দিতে শুরু করেছে।

কমপক্ষে এক মাসের বেশি সময় নিখিলের এত শোভা এত রূপ এত চমৎকারভাবে ফুটে উঠবে, যা শুধু ইউরোপে বিশেষ করে সুইডেনে পরিষ্কারভাবে অনুভব করা যাবে। গাছের পাতাগুলো তার রং পাল্টিয়ে রংধনুর মতো সাত রঙে রাঙিয়ে তুলতে শুরু করেছে। শিল্পীর তুলিতে আঁকা শরতের এই মনোমুগ্ধকর দৃশ্য কেড়েছে অনেক ট্যুরিস্টের মন। সুইডেনের শরৎ সত্যিই এক মন জুড়ানো দৃশ্য, যা না দেখলেই নয়।

আরও পড়ুন : এ যেন এক অবাক কাণ্ড!

আমি কাছ থেকে দেখছি, আমি দূর থেকে দেখছি আর মুগ্ধ হচ্ছি প্রতিক্ষণ। শরতে ঘুমের ঘোরে অনেকেই স্বপ্ন দেখবে আবার কেউ জেগে জেগে সোনার বাংলাকে তার মনের মতো করে গড়বে এবং হয়তো সাজাবে সুইডেনের শরতের মতো করে।

বাংলাদেশেও শরৎ ঋতু সুইডেনের মতোই সব সৌন্দর্যের চিরন্তন প্রতীক। বলা যেতে পারে শরতে বাংলাদেশ শুধু সুন্দর নয়, অপূর্ব, অতুলনীয় ও অসাধারণ সুন্দর। কেন যেন মনে হচ্ছে আমার সেই ছোটবেলার দিনগুলোর কথা। সেই শরতের বিকালে নীল আকাশের নিচে দোল খেতে দেখা শুভ্র কাশফুলকে। প্রকৃতির পালাবদলের খেলা তখন চলত শরতের মাঝামাঝি সময়।

এখনো কি বাংলাদেশের প্রকৃতিতে চোখ রাখলে ধরা পড়ে শরৎ; প্রকৃতির সেই মোহনীয় রূপ, কাচের মতো স্বচ্ছ নীল আকাশে গুচ্ছ গুচ্ছ সাদা মেঘের ভেলার ছোটাছুটি, নদীর বা বিলের ধারে কিংবা গ্রামের কোনো প্রান্তে মৃদু সমীরণে দোল খাওয়া শুভ্র কাশফুলের স্নিগ্ধতা, আর সেই বিল ও ঝিলের পানিতে শাপলা শালুক ফুলের সুন্দর মায়াবী দৃশ্যের সমারোহ! বাংলাদেশের শরৎকে সুইডেনে বসে অনুভব করা সত্যি এক স্বপ্ন, যা শুধু জেগে জেগে নয় ঘুমের ঘোরেও দেখি।

বিশেষ করে শরৎ সম্পর্কে আমার জ্ঞানের মাত্রা আগে কতটা ছিল, তা বলতে পারব না। গল্প-উপন্যাসে কতটা পড়েছি বা বুঝেছি, তা আমার ঠিক মনেও নেই। বলা হয়, বয়স বাড়লে বা যৌবনের আবির্ভাব হলে মানুষ প্রকৃতির প্রেমে পড়ে। প্রেমে পড়েছি বলব না, তবে প্রকৃতির অনেক না দেখা সৌন্দর্য আমি দেখেছি সুইডেনে। এ দৃশ্য যে কত বিশাল, তা এ দেশে না এলে হয়তো দেখা হতো না। গাছের পাতার রং যে কত বাহারি হতে পারে, তা না দেখলে বিশ্বাসই করা কঠিন। প্রকৃতির ছাপ আমি শুধু হাঁটতে পথে নিজের চোখে দেখি না, দেখি এখানের প্রতিটি মানুষের চোখে।

প্রকৃতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এদের মনেও আলোড়ন ঘটে। তবে সুইডেনের প্রকৃতিতে ১২ মাসই নতুন কিছু না কিছু ঘটে। চোখের সামনে সুন্দর সাজানো গাছগুলোর পাতা যেন ফলের মতোই পেকে গেল। কখনো লাল, কখনো বেগুনি, কখনো তীব্র হলুদ, তারপর উত্তাল বাতাসে ঝিরঝির করে পাতাগুলো পড়তে শুরু করছে। একটু দাঁড়ালেই দেখা যাচ্ছে বৃষ্টির মতো ঝরছে। প্রতিটা গাছে পাতাও প্রচুর।

সব পাতা যখন ঝরে যাবে, তখন দেখব চারপাশে শুধু পাতাবিহীন গাছ, নিদারুণভাবে গাছগুলো পাতাশূন্য হয়ে যাবে। মনে হবে প্রেম ছাড়া জীবন আর পাতা ছাড়া গাছ। প্রকৃতির পরিবর্তনের সঙ্গে ক্ষণিক বিরহ লেগে থাকে মানুষের চোখে–মুখেও। বিবর্ণ প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে বিবর্ণ হতে থাকে মানুষের মন। চলতে থাকবে প্রস্তুতি। দীর্ঘ বিরহ, দীর্ঘ শীতের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি। তখন আর হালকা কাপড় থাকবে না কারও গায়ে। শরীরে কাপড়ের পরিপূর্ণতায় ভরে যাবে।

আরও পড়ুন : মনে হচ্ছে পৃথিবী মানেই আমেরিকা!

জীবন ফুলশয্যা নয়, এখন বুঝি তা হাড়ে হাড়ে। অল্প বয়সী থেকে বয়স্ক কর্মজীবী মানুষের জীবন এমন কাছে থেকে দেখলে বোঝা যায় জীবন কতটা কষ্টের! আবহাওয়া যা–ই থাক, কাজ করতে হয় সবাইকে। প্রচণ্ড শীত এক সময় সহ্য হয়ে, স্বাভাবিক হয়ে ওঠে, কিন্তু মৌসুমের এ বদল হতে একটু সময় লাগে। ব্যস্ত নগরীর মানুষ কষ্ট উপেক্ষা করে প্রকৃতির মতোই চলছে নিজের ভাগ্য বদলাতে। সব আছে, তবু কী যেন নেই মনে হয়।

শরৎ এসেছে হৃদয়ে

যা–ই হোক না কেন, শরতের এই প্রকৃতির বাহারে চিত্রশিল্পীরা আছে মেতে আঁকা-ঝোঁকার মাঝে। আমি প্রতিদিন একবার হলেও ঘরের বাইরে যাচ্ছি। হাঁটছি কখনো প্রিয় সঙ্গিনীর সঙ্গে, কখনোবা একা। দেখছি এবং উপভোগ করছি মন-প্রাণ-হৃদয় ভরে শরতের এই বাহার।

আমি সুইডেনের শরৎ ও হেমন্তের সময়টুকুকেই বাংলাদেশের শীতকাল হিসেবে উপভোগ করে আসছি। কারণ ছোটবেলায় বাংলাদেশে যখন শীতকাল ছিল, তখন আমি সকালে ঘাসের ডগায় যেমন শিশির জমে থাকতে দেখেছি, তেমনি দেখেছি কুয়াশাও। কয়েক দিন ধরে সুইডেনের শরতের সময়টুকু আমাকে বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে ছোটবেলার দিনগুলো।

জানি না এমনটি অনুভূতি কি আজও আছে গ্রামবাংলায়? এখনো কি সকাল হলে নির্ভেজাল খেজুরের রস, খাঁটি গরুর দুধ এবং আতপ চালের ভেজালমুক্ত চালের গুঁড়া পাওয়া যায়? বড় সাধ জাগে একবার ফিরে যাই সেই বাংলার কোলে, যেখানে কেটেছে আমার মধুময় শিশুকাল।

শরৎ প্রতিবছরই সুইডেনে ফিরে আসে, তবে শীতের সেই দুধচিতই পিঠা ফিরে আসেনি একবারও। ছোটবেলার অনেক স্মৃতিই মাঝেমধ্যে হৃদয়ের মাঝে এসে বেশ জ্বালা দিয়ে যায়।

মাকে পাব না। খেজুর রস, সেই দুধচিতই পিঠা, তা–ও হয়তো পাব না। হে বাংলাদেশ, হয়তো কিছুই নাহি পাব তবুও তোমায় আমি দূর হতে ভালোবেসে যাব।

আরও পড়ুন : দেখা হয়েছিল পূর্ণিমা রাতে

আমি সৃষ্টিকর্তার প্রতি আমার প্রাণঢালা ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি, তুমি আমাকে এ সুন্দর ভুবনের সবকিছু উপভোগ করার সুযোগ দিয়েছ। তুমি শ্রেষ্ঠ, তুমি মহান, তুমি পরম দয়ালু এবং করুণাময় রাব্বুল আলামিন।

লেখক : রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন।

[email protected]

ওডি/কেএইচআর

চলমান আলোচিত ঘটনা বা দৃষ্টি আকর্ষণযোগ্য সমসাময়িক বিষয়ে আপনার মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাই, সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইলকরুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড