• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৩ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

জীবনে প্রথম ফ্রান্স ভ্রমণ

  রহমান মৃধা

২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৪:১৫
জীবনে প্রথম ফ্রান্স ভ্রমণ
ফাইজারের প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্টের সাবেক পরিচালক রহমান মৃধা ও তার সহধর্মিণী মারিয়া (ছবি : সংগৃহীত)

হাতে হাত রেখে হাঁটব আর দেখব। রাতের আঁধারে কফি সোপের আড্ডা আর ফ্যান্সি রেস্টুরেন্টে ফ্রান্সের নানা ধরণের খাবার, সব মিলিয়ে হারিয়ে যাব আমি আর আমার সহধর্মিণী দিনে দুপুরে এবং রাতের আঁধারে। এমনটি অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল সেদিন হৃদয়ে স্টকহোম থেকেই। কোনো প্লান ছাড়াই কিনেছি টিকিট। কোথায় উঠব, কোথায় ঘুরব, কী করব, কিছুই জানিনে। শুধু প্যারিসের অদূরে এক বন্ধুর বাড়িতে যাব সেটা ছিল সিওর। সন্ধ্যা সাতটার দিকে পৌঁছে গেলাম প্যারিস চার্লস ডি গল এয়ারপোর্টে।

এয়ারপোর্ট থেকে ট্রেনে করে চলে এলাম প্যারিসে। সেন্ট্রাল প্যারিসেই সুন্দর একটি হোটেলে ঢুকে চ্যাকিং পর্ব শেষ করে দুজনে বেরিয়ে গেলাম প্যারিসের সামার ইন দি সিটিতে।

যাই করি আর যাই দেখি, সবই এক্সপেরিয়েন্স। এর আগে তো কখনো প্যারিসে আসিনি তাই স্বাভাবিকভাবেই সবই নতুন। প্যারিসে গিয়ে আনন্দ ফুর্তির রাজ্যে হারিয়ে যাওয়া বিচিত্র কিছু নয়। কোথায় যাব? কী দেখব? কোথা থেকে শুরু করব? আসতে লাগলো মনের মাঝে হাজারও প্রশ্ন।

দূর হতে শহরের নাম শুনেছি। বত্রিশটি সেতুর সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে এই শহর। প্রিয় সহধর্মিণীর হাত ধরে একটির পর একটি করে সেতুর ওপর দিয়ে হাঁটাহাঁটির সঙ্গে মন বিনিময় করা ছিল সেদিনের প্যারিসের জার্নি যা আজ এত বছর পর মনে পড়ে গেল সেই প্রথম দেখার স্মৃতি। মনে পড়ে গেল সেই হৃদয় দেবার তিথী। দুজনার দুটি পথ মিশে গেল, এক হয়ে নতুন প্যারিসের পথে।

শুরু করলাম আইফেল টাওয়ার লিফ্ট দিয়ে। রোমান্টিক শহরের দৃশ্য এক নজরে দেখতে পাওয়া ছিল সেদিন এক চোখের দেখা। পরের দেখা ছিল সেই লৌরি মিউজিয়াম, ভেতরে ঢুকে মোনালিসাকে দেখা। মোনালিসাকে দেখছি আর মাঝে মধ্যে আমার নব বিবাহিত সহধর্মিণী মারিয়াকে দেখছি। হঠাৎ মারিয়া জিজ্ঞেস করল, মোনাকে না দেখে আমাকে কেন বার বার দেখছ? উত্তরে বলেছিলাম, সেদিন তুমি সুন্দর তাই চেয়ে দেখি প্রিয় সেকি মোর অপরাধ! মোনাকে দেখে চলে গেলাম ক্যাথিড্রাল নটর-ডেম ডি প্যারিস, কাটালাম কিছুক্ষণ সেখানে দুজনে।

শুনেছি এই ক্যাথেড্রালের বিখ্যাত ঘণ্টাবাদকের কোয়াসিমোডো বিশাল ভালোবাসার কাহিনী তার জিপসি এসমেরাল্ডার সাথে, তাই মনের অজান্তে কিছুক্ষণ হারিয়ে গিয়েছিলাম দুজনে দুজনার সাথে সেদিন।

পথ চলতে চলতে আর কথা বলতে বলতে চলে এলাম অ্যাভিনিউ ডেস চ্যাম্পস-এলিসেসে, এই ১.৯ কিলোমিটার দীর্ঘ পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর এভিনিউ ‘প্লেস ডা লা কনকর্ড এবং আর্ক ডি ট্রাইম্ফে, যা না দেখলেই নয়। পরে স্যাক্রেড হার্ট ব্যাসিলিকার দিকে এক পলক ফেলে এলাম। দিনের শেষে সেই বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পীদের আড্ডাখানা, বিকালের শেষে ঘুরে ঘুরে চিত্রশিল্পীদের রংয়ের ছোঁয়া ছুঁয়েছিল সেদিন আমাদের হৃদয়ও।

ঘোরার রইল বাকি আর দেখার হোল না শেষ তবে সময় শেষ হতে চলেছে। হঠাৎ চারদিন পার হয়ে গেল প্যারিসে। সময় তাড়া করেছে যেতে হবে এক বন্ধুর বাড়িতে। বন্ধুর বাড়ি সেন্ট মালো, প্যারিস থেকে ট্রেনে সেন্ট মালোর দূরত্ব তিন ঘণ্টা। বন্ধুর নাম সামপেয়ার্স। এক সঙ্গে পড়েছি সুইডেনে। সামপেয়ার্স বিয়ে করেছে আমার আগে। সামপেয়ার্স আমার চেয়ে মস্ত বড় পরিচালক। বিয়েও করেছে এক জমিদারের মেয়েকে। মেয়ের বাবার বাড়ি জার্সিতে।

সকালে ঘুম থেকে উঠে এক্সপ্রেস ট্রেনে করে রওনা দিলাম সেন্ট মালোর উদ্দেশ্যে। তিন ঘণ্টার মতো এই ট্রেন জার্নি। পথে ফ্রান্সের গ্রামের সৌন্দর্য্য দেখতে দেখতে প্রায় চলে এসেছি, হঠাৎ টিকিট কাউন্টার আমাদের টিকিট দেখতে চাইলো, টিকিট বের করে দেখালাম। ফ্রান্স ভাষাতে কী সব বলতে শুরু করলো যার আগামাথা কিছুই বুঝলাম না তবে মারিয়া দিব্যি কথা বলে যাচ্ছে দেদারছে।

আরও পড়ুন : ওয়েলসে দুই রমণীর সঙ্গে একরাত

পরে জানতে পারলাম- টিকিট শুধু কিনলেই হবে না ট্রেনে ঢোকার আগে একটি মেশিনের মধ্যে দিয়ে চ্যাকিং করতে হয় যা আমরা করিনি, ভুলে গেছি বা খেয়াল করিনি। খেয়াল করব কী করে নতুন প্রেমের জোয়ার বইছে মনে, সব কী আর ঠিক থাকে? যতটুকু মনে পড়ে এসব ভুলের জন্য জরিমানা দিতে হয় দ্বিগুণ এটাই নরমাল নিয়ম কিন্তু মারিয়ার ফ্রান্স ভাষা জানা এবং হ্যানিমুনের ভ্রমণের কথা শোনার পরে বেচারা দয়া করেছিল তাই এক হাজার ফ্রাংক বেঁচে গিয়েছিল সেদিন।

স্টেশনে হাজির হতেই বন্ধু সামপেয়ার্স এবং তার স্ত্রী মালিকা অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য একগোছা রজনীগন্ধা হাতে করে। ফ্রান্সের রোমান্টিক ওয়েতে শুভেচ্ছা বিনিময় শেষে নিয়ে গেল আমাদেরকে সেই জার্সির সুন্দর চ্যানেল দ্বীপপুঞ্জের দিন ভ্রমণ। এই জার্সি শহরে বাস করে মালিকার বাবা-মা। মালিকার বাবা তার নিজের কন্ডোর নৌকাতে বসে আছে আমাদের জন্য। শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা বিনিময় শেষে রওনা দিলাম জার্সিতে। জীবনে এই প্রথম বেল্ট বাঁধলাম মাজাতে। কন্ডোর চলতে শুরু করল হাওয়ার বেগে এবং এক ঘণ্টা কুড়ি মিনিট পরে হাজির হয়ে গেলাম জার্সির স্টাইলিশ বিচ ক্যাফেতে এবং লান্স এখানে সেরে গাড়ি করে পৌঁছে গেলাম মালিকার বাবা-মার প্রাসাদ বাড়িতে।

বিশাল জায়গা নিয়ে জার্সিতে রয়েছে আঙ্গুর ফলের বাগান সাথে ন্যাচারাল পদ্ধতিতে ওয়াইন তৈরির কারখানা। আমি শুধু বলি, কি সুন্দর জায়গা এটি! মালিকার সাথে সামপেয়ার্সের প্রেমের কাহিনী শুনেছি আগে, এখন শেয়ার করব এক মজার গল্প। সামপেয়ার্স লেখাপড়ায় ভালো তবে মালিকার মতো বড়লোক নয়। তাদের প্রেম এবং পরে বিয়ে বলতে গেলে মালিকার বাবা-মার কিছুটা মতের বিরুদ্ধে। তবে তারা একে অপরকে ভালোবাসে বিধায় বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে।

সামপেয়ার্সের ধারণা ছিল একমাত্র মেয়ে, কী-না কী হবে বা পাবে বিয়ের পরে। দুঃখের বিষয় সাধারণভাবে বিয়ে হয়েছে এবং সামপেয়ার্স গিফট হিসেবে ৫০টি ওয়াইনের বোতল পেয়েছে। সামপেয়ার্সের মনটা বেশ খারাপ ছিল অনেকদিন ধরে। মালিকা এবং সামপেয়ার্স যেহেতু নিজেদের বাড়ি সেন্ট মালোতে থাকে তাই কোনো এক অকেশনে তাদের দুজনার সেলিব্রেশন পালন করবে।

ঘরে ড্রিংক করার মতো তেমন কিছু নেই, শেষে সামপেয়ার্স মনে করলো বাড়িতে ৫০টি ওয়াইনের বোতল রয়েছে চলো তার একটি ড্রিংক করি? বোতলের কর্ক খুলতেই দেখতে পেল বোতলে ওয়াইন ভরা হয়েছিল ১৮৫০ সালে যা কর্কে সিল মারা রয়েছে।

মালিকা তার বাবাকে ফোন করে বিষয়টি বলতে বাবা বলেছিলেন, ঐ ওয়াইনগুলো আমার নানা পেয়েছিলেন তার শ্বশুরের থেকে, পরে আমি পেয়েছিলাম তোমার নানার থেকে এখন তোমরা পেয়েছ আমার থেকে। সেদিন সামপেয়ার্স জানতে পেরেছিল পঞ্চাশ হাজার ফ্রাংক প্রতিটি ওয়াইনের বোতলের মার্কেট ভ্যালু যা সে গিফট পেয়েছিল, ১৯৯৪ সালের কথা। মনের আনন্দে ঘুরছি আর প্রতিটি মুহূর্ত এনজয় করছি জার্সিতে। তিনদিন কখন কীভাবে পার হয়ে গেল জানিনে। হঠাৎ মারিয়ার শরীরটা বেশ খারাপ মনে হচ্ছে এবং সে বলে সুইডেনে ফিরতে হবে। কী আর করা! তাড়াহুড়ো করে ফ্লাই ব্যাক করলাম বাড়িতে। বাড়িতে ফিরে এসে মারিয়া ডাক্তারের কাছে গিয়েছে। আমি বাসাতে রান্নাবান্নার ব্যবস্থা করছি।

আরও পড়ুন : দেখা হয়েছিল পূর্ণিমা রাতে

মারিয়া বাসাতে এসে বাথরুমের বাথ টবে পানি ভরে তার মধ্যে গোসল করছে, কিছুক্ষণ পর আমাকে বলল, রহমান আমি তোমাকে ভালোবাসি। এ কথা শুনেছি হাজারও বার তবে আমি তোমার সন্তানের মা হতে চলেছি, এ কথা শুনেছিলাম সেদিন প্রথমবার।

লেখক : রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন।

[email protected]

ওডি/কেএইচআর

চলমান আলোচিত ঘটনা বা দৃষ্টি আকর্ষণযোগ্য সমসাময়িক বিষয়ে আপনার মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাই, সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইলকরুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড