রহমান মৃধা
হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর নতুন করে না ঘুমিয়ে লিখতে বসেছি। ভাবছি, ঘুমের মতো এমন একটি মুহূর্ত, তাকে কি কখনো আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি? ক্লান্ত হলে তো আমরা বিশ্রাম নিতে পারি, কিন্তু না ঘুমালে বিশ্রামের সেই পরিপূর্ণতা কি লাভ করা সম্ভব? হয়তো না।
ছোটবেলায় সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে ঘুম পেত, তেমন ঘুম এখন আর পায় না। সে যে কী ঘুম! তার বর্ণনা দেওয়ার নয়, তবে সে অনুভূতি আজও মনের মধ্যে গাঁথা রয়েছে। এখনকার ঘুম বেশ হালকা–পাতলা, কোনো রকম শব্দ হলেই ব্যস, গেল ঘুমের বারোটা বেজে। তবে মজার ব্যাপার হলো বাস, ট্রেন বা প্লেনে উঠলেই আমার প্রথম যে কাজ তা হলো ঘুম। দুটি পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে গেল।
একবার বাংলাদেশে, ঢাকা থেকে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিয়েছি। পায়ে সুন্দর এক জোড়া নতুন জুতা। বাসে বসতেই বড্ড ঘুম পেয়েছে। ছিটগুলো বেশ খালি, তো আমি দিব্যি ঘুমিয়ে গেছি। ফরিদপুর এসেছি, হঠাৎ একজন নতুন যাত্রী বাসে উঠে আমাকে আমার পা নিচে নামাতে বলল। চোখ খুলে দেখি ময়লা একটি জুতা পায়ে। ঘুমের ঘরে লোকটিকে বললাম, ‘ওটা আমার পা নয়!’ লোকটা একটু রেগে বলল, ‘এই ছেলে, ইয়ার্কি হচ্ছে? পা সরাও বলছি।’ তাড়াতাড়ি পা সরিয়ে দেখি, ওমা, এ তো আমার পা! তবে জুতা তো আমার না। জুতাচোর কখন পথে আমার নতুন জুতা পাল্টে পুরনো জুতা পায়ে পরিয়ে ভেগেছে, তার কিছুই জানি না। আরেকবার সুইডেন থেকে লন্ডনের গ্লাসগোয় আমাদের একটি অফিশিয়াল মিটিংয়ে যাওয়ার ঘটনা।
আমার অফিস থেকে ১০ জন স্টকহোম থেকে রওনা দিয়েছি। আমার পাশে বসেছে সদ্য চাকরিতে যোগ দেওয়া কারিনা হ্যানসন। কারিনা ভেবেছিল, সে এই দুই ঘণ্টার পথে আমার সঙ্গে পরিচিত হবে। দুঃখের বিষয়, প্লেন ল্যান্ড করতে যখন ১০ মিনিট বাকি ঠিক, তখন ঘুম ভাঙতেই কারিনা বলেছিল, ‘রহমান, তুমি আমার ঘাড়ের ওপর ঘুমিয়ে দুই ঘণ্টা পার করেছ।’ একটু লজ্জিত হয়েছিলাম সেদিন, কারণ মেয়েটি আমার অফিসে নতুন জয়েন করেছে।
প্রথমে সবাই বিষয়টি নিয়ে একটু আলোচনা করেছিল। আমার কি অন্য কোনো মতলব ছিল? না, ছিল না। কারণ, ঘুমই একমাত্র মতলব ছিল সেদিন, তাই উড়োজাহাজে বসতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সিনেমায় গেলেও পাঁচ মিনিট যেতেই আমি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে যাই। জেমস বন্ডের ছবি চলছে আর আমি গভীর নিদ্রায় মগ্ন। আবার নতুন কোথাও গেলে প্রথম রাতে চোখে ঘুমের বালাই নেই। জানি না কেন এমনটি হয়। হয়তো নতুন পরিবেশের কারণে ঘুম ভালো হয় না।
ঘুম আমাদের মনকে সবল ও প্রফুল্ল করে। মানসিক শান্তি নিয়ে আসে, ক্লান্ত সময়ে দেহে নিয়ে আসে প্রশান্তি। দেহ–মনকে চাঙা করে তোলে যে জিনিস, সেটা হলো এ ঘুম! ঘুম আমাদের চিন্তা চেতনার ওপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে। শৈশব ও কৈশোরে ঘুমের দরকার সবচেয়ে বেশি, কারণ শরীরের যথাযথ বৃদ্ধিতে ঘুমের দরকার অপরিসীম। বয়স্ক বা বার্ধক্যে ঘুমের দরকার, তবে অতিরিক্ত ঘুমের দরকার পড়ে না।
আরও পড়ুন : ওয়েলসে দুই রমণীর সঙ্গে একরাত
জীবনের এক-তৃতীয়াংশ সময় আমরা ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিই। অনেকের ধারণা, এটা সময়ের একধরনের অপচয়, কিন্তু বাস্তবে তা নয়। ক্রিয়েটিভ চিন্তার জন্য দরকার ঘুমের। ঘুম শরীর পুনর্গঠনে সাহায্য করে। ঘুম সমস্ত শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অবসাদ দূর করে শুধু শ্বাসপ্রশ্বাস ছাড়া। বয়স হয়েছে, ঘুম এখন আর ছোটবেলার মতো নেই।
সারা দিন অনেক পরিশ্রম করে ক্লান্ত। কাজ শেষ বিছানায় এসে চোখ বন্ধ করলেন, ঘুম ‘নাই হয়ে গেল’। রাতে অনেক সময় ঘুম ভেঙে যায় বারবার আর তখন মনে পড়ে অনেক কথা। জীবনের কথা, ভালো মন্দের কথা, প্রেমপ্রীতির কথা বা ইতিকথা। এমনটা কিন্তু হয়। আবার রাতের বেলা কোথাও একটু আওয়াজ হলো আর বুকটা ধড়ফড় করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে দুশ্চিন্তা এসে হানা দিল মাথার ভেতর।
এমনটি ঘটে কমবেশি সবার ক্ষেত্রেই। তবে রাতের পর রাত একটানা ঘুম না হওয়া মোটেও ভালো কথা নয়। ভালো ঘুম না হওয়ার কারণে মারাত্মক সব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। আসুন জেনে নিই, ছোট ছোট কী উদ্যোগ নিলে হতে পারে অবাধ গাঢ় ঘুম।
শারীরিক পরিশ্রম, ব্যায়াম, মেডিটেশন, ইয়োগা—এগুলো করলে ঘুম ভালো হওয়ার কথা। কিন্তু মানসিক উদ্বেগের কারণেও অনেকের ভালো ঘুম হয় না। কারণ কী? টেনশন। টেনশন প্রত্যেক মানুষের জীবনের একটি অংশ। সবাই বলবে টেনশনমুক্ত জীবনযাপনের কোনো বিকল্প নেই। বলা সহজ, ম্যানেজ করে চলা কঠিন। তারপরও টেনশন ম্যানেজ করে চলতে হবে। এ জন্য নিজেকে সৃজনশীল কাজে ব্যস্ত রাখতে হবে। সুস্থ ও চমৎকার জীবনের জন্য ভালো ঘুম অত্যন্ত জরুরি।
মায়ের কোলে শিশুর ঘুম যেমন নিশ্চিন্তের জীবন গড়ার স্বপ্নের জাল, যা মায়ের প্রতীক্ষার এক অপেক্ষা। শৈশব ও কৈশোরের দুরন্তপনা আর সারা দিনের দুষ্টুমির পরে সন্ধ্যার ঘুম, প্রভাতে সূর্য ওঠার আগে ঘুম থেকে উঠে জীবন গড়ার এক মধুময় স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার প্রচেষ্টা।
যৌবনে উদীয়মান ক্লান্ত সময়ে বিশ্রামের জন্য ঘুম, যে ঘুম ক্লান্তিকে দূর করে, জেগে জেগে দেখা স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে সাহায্য করে। ঘুম জীবনের এক অজানা অতিরিক্ত আবেগ–অনুভূতি, যা তার গোপন এক প্রাকৃতিক নিরাপত্তা। যৌবনে ঘুমন্ত অবস্থার সঙ্গে বার্ধক্যের ঘুমন্ত অবস্থার পার্থক্য হলো এ সময় মানুষের উত্তেজনায় সাড়া দেওয়ার ক্ষমতা (রিফ্লেক্স) হ্রাস পায়। গ্রামবাংলায় চৈতালি রাতে দখিনা হাওয়ায় ঘুম, সেটাও তো কখনো ভোলার নয়।
আরও পড়ুন : দেখা হয়েছিল পূর্ণিমা রাতে
উত্তর গোলার্ধের গ্রীষ্মে মাঝরাতে যখন ঘুম ভেঙে যায়, ব্যালকনির দরজা খুলে বাল্টিক সাগরের পানিতে চাঁদের আলোকে দেখে আবার ফিরে সহধর্মিণীর পাশে এসে ঘুমিয়ে পড়া, সেটাও যেন এক মধুর অনুভূতি। জীবনের সন্ধ্যা ঘনিয়ে যাবে আর বেলা যাবে ওই, কোথায় যাবে স্মৃতিগুলো আর হইচই! আসবে বার্ধক্য, বার্ধক্যের ঘুম জীবনের শেষ সময়ের ঘুম। যে ঘুমের পরে কখনো সকাল হবে। আবার হয়তো কখনোই সকাল হবে না। রাতের প্রদীপ নিভিয়ে ঘুমিয়ে রব শান্ত হয়ে চিরন্তন সুখের অপেক্ষায়।
লেখক : রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন।
ওডি/কেএইচআর
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড