রহমান মৃধা
একবার আমি আমার সুইডেনের বাড়িতে বসে আছি। চাকরি করি বিশ্বের সব চেয়ে বড় ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি ফাইজারে। বলতে গেলে বাড়ি-গাড়িসহ সব সুযোগ সুবিধা দিয়ে কোম্পানি আমাকে ট্রান্সফার করেছে সুইডেনের ছোট একটি শহর স্ট্রেংন্যাছে। চলছে আমার লাইফ স্টাইল ভালোই। হঠাৎ একদিন প্রায় বিশ বছর বয়সী এক ছেলে এসে আমাকে বলল
- স্যার আমি কি আপনার কোম্পানিতে একটি কাজ পেতে পারি?
- হ্যা, পারো।
সে অত্যন্ত খুশি হয়ে নিজের অভিজ্ঞতা এবং শিক্ষার উপর বর্ণনা শুরু করল। আমি তার হাতে আমার কাজের ভিজিট কার্ড দিয়ে বললাম, অফিসে ফোন করে আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য একটি সময় যোগাড় করবে। আর যে কথাগুলো বললে এর উপর যদি ডোকুমেন্টস থাকে নিয়ে আসবে।
ছেলেটি কিছুটা অবাক হয়ে বলল,
- আপনি কি আমেরিকান?
- না, কেন?
- আমি মনে করেছি আপনি আমেরিকান। কারণ ফাইজারে চাকরি করেন তাই। আমার খুব সখ আমেরিকা যাবার এবং আপনার মতো বড় অফিসার হতে চাই।
আমি তার বিনয়, সাহস ও লেখাপড়ার যোগ্যতার কথা শুনে তাকে কাছে ডেকে নিয়ে আলাপ শুরু করে দিলাম। আলাপের শেষ দিকে তাকে বললাম, তুমি এভাবে বাড়িতে নক না করে অফিসে বা পেপারে অথবা ইন্টারনেটের মাধ্যমে কাজ খুঁজতে চেষ্টা করো। তুমি তো একজন মেধাবী ছাত্র। তা তোমার দেশের বাড়ি কোথায়?
সে বলল, আমার বাড়ি পেরু। আমার দু বছর বয়সেই বাবা মারা যান। আমার মা মানুষের বাড়িতে বুয়ার কাজ করে। আমি এবং আমার ছোট বোন বাইরে টুকটাক কাজ করে বেড়াই বাড়তি কিছু রোজগারের আশায়, যা দিয়ে আমাদের লেখাপড়ার খরচ চলে। এইভাবে পেরুতে এইসএসসি শেষ করে নৌবাহিনীর ক্যাডেট কোরে যোগ দেই। পরে একটি কোর্সে সুইডেনে আসার সুযোগ হয়। এখানে এক বছর ট্রেনিং শেষ করে দেশে না ফিরে সুইডেনে রিফুজি হয়ে ঢুকেছি এক বছর হোল। আমি শুনেছি আমেরিকান কোম্পানিতে নাকি মেধাবী কর্মীদের উচ্চতর পোস্ট পেতে সুযোগ দেয়। আমার খুব ইচ্ছা সেখানে যাবার। কিন্তু সেখানে যেতে হলে আমাকে তো ওদের কোম্পানিতে ঢুকতে হবে।
খেয়াল করলাম ছেলেটি স্প্যানিশ জানে তবে সুইডিশ এবং ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা খুব ভালো না। আমি বেশ অবাক হলাম প্রথমত, নৌবাহিনীর ভালো চাকরি, সুযোগ সুবিধা ভালো, কেন সেটা ছাড়লো? দ্বিতীয়ত, দেশের প্রতি দেখছি এর কোনো মায়া মহব্বত নেই! ব্যাপার কী? কৌতুহলের বশে জানতে চেষ্টা করলাম তার মনের কথা। সব কথা শুনে বুঝলাম বাংলাদেশে যেমন সশস্ত্র বাহিনীতে সুযোগ সুবিধা, পেরুতে ঠিক তেমন না।
আরও পড়ুন : বাবা-মা এবং ভালোবাসা
ছেলেটি বলল, আমাদের সমাজে আমার পরিচয় ‘once a solder always a solder’. আমি জিজ্ঞেস করলাম কিন্তু তুমি তো চাকরিতে ঢুকার আগেই জানতে কী হবে, কী না হবে, কী পাবে, কী না পাবে ইত্যাদি? ছেলেটি উত্তরে বলল, সব জানা সত্ত্বেও নতুন পৃথিবী নতুন চোখ খুলে দিয়েছে যখন সুইডেনে ঢুকেছি।
মানে?
স্যার আমি অফিসার হয়েছি, ছোট বোনকে ইঞ্জিনিয়ার হতে সাহায্য করছি। মাকে আর্থিকভাবে সাহায্য করি। মা এখন পরের বাড়ি কাজ করেন না। তা সত্ত্বেও একটি মেয়েকে ভালোবেসেও বিয়ে করতে পারিনি। কেন? সে বলল, আমার মা পরের বাড়ির আয়া ছিলেন এটাই অপরাধ। সুইডেনে ঢুকে প্রথম বছরেই এদের লাইফ স্টাইল, সমাজে সবার অবস্থা, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ সব কিছু দেখে আমি সিদ্ধান্ত নেই আর দেশে ফিরবো না। যেদেশে আমার ভালোবাসার অধিকার নেই, সেদেশের সৈনিক হয়ে বেঁচে থাকতে চাই না। ছেলেটির কথাবার্তা শুনে বাংলাদেশের সাথে বেশ মিল পেলাম। “এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না, শুধু সুখ চলে যায়..।
বিদায় বেলায় সিদ্ধান্ত হলো সে তার কাগজপত্রগুলো আমাকে দিবে। কিছুদিন পর আমি তাকে আমার কোম্পানিতে চাকরির ব্যবস্থা করে বললাম এবার নিজ দায়িত্বে আমেরিকা যেতে চেষ্টা কর।
সে তার মেধা ও কঠিন চেষ্টার জোরে কয়েক বছরের মধ্যেই আধুনিক টেকনোলজির কনিষ্ঠ টেক ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। নিউইয়র্কে ফাইজারের হেড অফিসে যোগ দেয়।
তার ঈর্ষণীয় সফলতায় আমি ও আমার পরিবার আনন্দিত হই। তাকে না জানিয়ে তার মা ও বোনের ভিসা ব্যবস্থা করি ফাইজারের মাধ্যমে।
এখন সে ফাইজারের সেরা কর্মীদের একজন। ছেলেটি বিয়ে করেছে আমেরিকায়।
আরও পড়ুন : ভালোবাসো মোর গান
অনেক দিন পর হঠাৎ একদিন সে আমার বাড়িতে হাজির। কী ব্যাপার? স্যার আপনার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা কীভাবে দেখাব বুঝতে না পেরে সরাসরি চলে এলাম সুইডেনে। কিছুদিন আপনার সঙ্গে থাকতে চাই।
স্যার আমিও আমার পরিচয় মনে রাখতে চাই আপনার মতো করে। আমি মনে রাখতে চাই আমি কী ছিলাম আর আজ কী হয়েছি এবং আপনি আমার জন্য কী করেছেন। যে শূন্য হাতটি সেদিন আপনি ধরেছিলেন, আজ সেই হাত পূর্ণ হয়েছে, আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। এতক্ষণ যে ছেলেটির কথা আলোচনা করলাম তার নাম রিকার্ডো।
এখন প্রশ্ন হতে পারে আমি কি সেই আগের মতোই আছি নাকি অনেকখানি বদলে গেছি? আগের মতো দেখতে নেই, আগের মতো ছোট নেই, আগের মতো চিন্তাভাবনা নেই। অনেক পরিবর্তন হয়েছে নানা দিক দিয়ে তবে আমি যে নহাটার (নহাটা, মাগুরা জেলার একটি গ্রাম) ছেলে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
মানে?
বুজতে পারলে না?
আরও পড়ুন : দেখা হয়েছিল পূর্ণিমা রাতে
আমি দেশ ছেড়েছি, দেশের মানুষ ছেড়েছি বটে, তবে সঙ্গে নিয়ে এসেছি বিশাল সম্পদ যা দেশে থাকতে দীর্ঘ ১৯ বছর ধরে অর্জন করেছিলাম। এখন যে সম্পদগুলো নৈতিক দিক দিয়ে ভালো ছিল না সেগুলো বর্জন করেছি, একই সাথে দূরপরবাসে যেগুলো সুন্দর তা অর্জন করতে চেষ্টা করছি।
লেখক : রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন।
ওডি/কেএইচআর
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড