ইমরান হুসাইন
আমরা মানুষ।সৃষ্টির সেরা জীব। সৃষ্টি কর্তা আমাদের সর্বগুণে গুনান্বিত করেই সৃষ্টি করেছেন। তবুও স্রষ্টার সৃষ্টি এই দুনিয়াতে বিচিত্র মানুষের বসবাস,বিচিত্র মানুষের বিচরণ।এর মধ্যে আমরা কেউ সুস্থ আছি আবার কেউ নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেই জীবন যাপন করছি।কেউ কেউ বেঁচে আছেন বেশ ত্রুটিপূর্ণ অবস্থাতেও।আর তাই বলতে হয় সুস্থতা একটি বড় নিয়ামত কারণ আমরা সুস্থ আছি।আমাদের চারপাশে এমন অনেক মানুষ আছে যারা ত্রুটিপূর্ণ অবস্থায় জীবন যাপন করছেন। যাদেরকে সমাজ প্রতিবন্ধী নামে চিহ্নিত করেছেন। যারা আমাদের কাছে প্রতিবন্ধী হিসাবে পরিচিত।
পৃথিবীতে শারীরিক যোগ্যতার ভিত্তিতে দু ধরনের মানুষ পরিলক্ষিত হয়ে এক শ্রেণির মানুষ নিখুঁত দেহ-বৈশিষ্ট্যের অধিকারী,অন্য দিক এক শ্রেণি ত্রুটিপূর্ণ। আর এই দ্বিতীয় শ্রেণির মানুষকে বলা হয় প্রতিবন্ধী। প্রতিবন্ধী শব্দের অর্থ বাধাগ্রস্ত ব্যক্তি। প্রতিবন্ধী মানুষ নানা জটিল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে জীবন ধারণ করে। প্রতিবছর ৫ এপ্রিল জাতিসংঘের উদ্যোগে সারা বিশ্বে উদযাপিত হয় “আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস’।
মানব সমাজের একটি অক্ষম অংশের নাম প্রতিবন্ধী। মানবদেহের নানা ত্রুটিপূর্ণ অবস্থার কারণে প্রতিবন্ধীকতার কয়েকটি শ্রেণিতে বিভাজন করা যায়। যেমন- অন্ধ প্রতিবন্ধী,মূক ও বধির প্রতিবন্ধী,মানসিক প্রতিবন্ধী,অস্থির সমস্যাজনিত প্রতিবন্ধী অর্থাৎ বিকলাঙ্গ প্রভৃতি। পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ। মানুষের দৈহিক অবয়ব তার চলাফেরা ও কর্ম-বৈচিত্র্যের সহায়ক। কিন্তু যে সেহের মেয়ে মানুষ কর্মপরতার মাধ্যমে প্রাণিজগতের মধ্যে স্বতন্ত্র মর্যাদায় উন্নীত,তা যদি বিকল হয়,তাহলে মানব জীবনে নেমে আসে হয় অমানিশা। এ কারণে প্রতিবন্ধী জীবন অভিশাপগ্রস্ত। আমরা জানি যে প্রতিবন্ধী বা পঙ্গু ও বিকলাঙ্গ ব্যক্তিরা সমাজের বড় ধরনের কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে পারে না। তারা নিজেদের সময় নিজেরা সমাধান করতে সাধারণত অক্ষম। অন্যের ওপর নির্ভরশীলতা তাদের জীবনের পরম নিয়তি।
কিন্তু কর্মহীন মানুষ স্থবির ও জড়। তারা চলার পথের সহায়ক নয়,বিঘ্ন। এ কারণে প্রতিবন্ধীদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি জনক ও সহানুভূতিপূর্ণ নয়। তবে সাম্প্রতিককালে ব্যাপক প্রচারণা, প্রতিবন্ধীদের নানা প্রশিক্ষণ প্রদান, তাদের বিভিন্ন কর্মে আংশগ্রহণ ইত্যাদি কারণে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটছে। প্রতিবন্ধীরাও মানুষ, এই মানবিক আবেদন তাদের প্রতি সাধারণ মানুষকে কেবল সহানুভূতিপূর্ণিই নয় বরং কর্তব্যমুখীও করে তুলছে।
জন্ম ও দুর্ঘটনা জনিত কারণে মানুষ প্রতিবন্ধী হয়। সুস্থ মানুষেরই যেখানে থাকে অত্র সমস্যা, সে ক্ষেত্রে প্রতিন্ধীরা সীমাহীন কষ্ট ও সমস্যায়-আকীর্ণ জীবনযাপন করবে সেটাই স্বাভাবিক। পারিবারিক পর্যায়ে শুরু হয় এদের দুঃখ-বিদীর্ণ জীবন। এরপর তার প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে। পরিবারের একান্ত আপনজন ব্যতীত কারাে কাছে তারা সহানুভূতি পায় না। সমাজ থেকে পায় করুণা ও উপহাস। রাষ্ট্র তাদের দিতে পারে না অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা সুতরাং পরনির্ভশীলতাই তাদের একমাত্র ভরসা। এর ফলে হতাশ ও হীনম্মন্যতায় তারা কুষ্ঠিত হয়ে পড়ে। এদের পঙ্গুত্ব। সমাজ ও রাষ্ট্রের বিরূপ পরিবেশে তারা হয়ে ওঠে অসহায়।
আপাতদৃষ্টিতে মানুষকে সুস্থ মনে হলেও লক্ষ কোটি লােক দৃশ্য-অদৃশ্য নানা প্রতিবন্ধকতায় জড়িত। World Health Organization (WHO)বা জাতিসংঘের বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার জরিপকৃত হিসাব অনুযায়ী বিশ্বের মােট জনসংখ্যার শতকরা প্রায় দশ ভাগ মানুষ কোনাে না কোনােভাবে প্রতিবন্ধী। মানুষ প্রতিবন্ধী হয় নানা কারণে। যেমন-পঙ্গুত্ব নিয়েই জন্মগ্রহণ,অপুষ্টির কারণে পঙ্গুত্ব বরণ, রােগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে প্রতিবন্ধী হয়ে ওঠা অথবা দুর্ঘটনার কারণে। গর্ভকালীন সময়ে অপুষ্টি বা মায়ের অনিয়মনিত কারণে শিশু পঙ্গু হয়ে জন্মগ্রহণ করে। পােলিও,টাইফয়ে,নিউমােনিয়া, রিকেট ইত্যাদি রােগ প্রতিবন্ধিতার অন্যতম কারণ। স্নায়ুগত সমস্যা,হাড় বা অস্থির অসম অবস্থান, অঙ্গাহানি,দুর্ঘটনা ইত্যাদি কারণেও শিশু বা ব্যক্তি প্রতিবন্ধী হয়। আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর পূর্বে বাংলাদেশে প্রচ্ছন্ন ও প্রকৃত প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ছিল প্রায় অধ কোটির মতাে। এর মধ্যে শিশুদের সংখ্যাই ছিল অধিক। বর্তমানে এ সংখ্যা মােটামুটি এক কোটি বিশ লাখের কাছাকাছি। বস্তুত, এ চিত্র কোনােভাবেই সুখকর নয় জাতিসংঘ,আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং সরকারি প্রয়াসে প্রতিবন্ধীদের জন্য নানামুখী কর্মসূচি প্রণীত হয়েছে। অন্ধদের জন্য টঙ্গিতে গড়ে উঠেছে ‘অব ওরিয়েন্টেড সেন্টার'। সারা দেশে আছে বােবা ও বধিরদের জন্য স্কুল এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
বিশেষ শিক্ষা নীতিমালা-২০০৯ জাতিসংঘ ঘােষিত প্রতিবন্ধী বাক্তিবর্গের অধিকার সনদ (ইউএনসিআলপিডি) এর প্রতি সমর্থন প্রদানকারী প্রথম সারির দেশসমূহের মধ্যে উদ্যোগে ২০০৯ সাল হতে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আওতায় এ যাবৎ অটিস্টিক শিশুসহ ৫০০ বিভিন্ন ক্যাটাগরির প্রতিবন্ধী ব্যক্তি এবং তাদের পিতা-মাতা/ অভিভাবকদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। এছাড়াও জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের প্রথম পৃষ্ঠপােষকমণ্ডলীর সভায় ফাউন্ডেশনের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামাে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে ফাউন্ডেশনকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি পূর্ণাঙ্গ সরকারি অধিদফতরে রপান্তর করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
প্রতিবন্ধীরা আমাদেরই সন্তান, আমাদের প্রতিবেশী, আমাদেরই আপনজন। সুতরাং তাদের প্রতি আমাদের উদাসীনতা প্রদর্শন না করে তাদের উন্নতির জন্য মনােনিবেশ করা কর্তব্য। বাংলাদেশে প্রতিবন্ধীদের উনয়ন প্রকল্প'জাতীয় প্রতিবন্ধী ফোরাম প্রণয়ন করেছে জাতীয় নীতিমালা। কিন্তু এ নীতিমালা তেমন একটা কার্যকর হয়নি। অনেক প্রতিবন্ধীকে সরকারি,বেসরকারি ও প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে কর্মে নিযুক্ত দেখা গেলেও বিশাল প্রতিবন্ধী জনগােষ্ঠীর তুলনায় অত্যন্ত অনুল্লেখযােগ্য। এ ব্যাপারে পেশাভিত্তিক কর্ম কৌশল প্রণয়ন করা প্রয়ােজন।
বস্তুত, প্রতিবন্ধী মানুষেরা এক ধরনের অসুস্থ ব্যক্তি। চিকিৎসার সাহায্যে তাদের অবস্থার পরিবর্তন সাধন করা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অসম্ভ। তাই তাদের প্রতি ভালবাসা প্রদর্শন, তাদেরকে যােগ্যতা অনুযায়ী সম্মান প্রদান,সুষ্ঠভাবে, আনন্দ ও সাহায্য সহযোগিতার মধ্য দিয়ে জীবনযাপনে সহযােগিতা করা আমাদের সকলের দায়িত্ব ও কর্তব্য। মনে রাখা আবশাক যে, একজন প্রতিবন্ধী মানুষ তার সেই অবস্থার জন্য নিজে দায়ী নয়, পরিস্থিতির শিকার মাত্র। সুতরাং,দয়া, করুণা ও অবহেলা তার প্রাপ্য নয়। একজন প্রতিবন্ধীরও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। আমরা তাদেরকে আশাহত করতে পারি না। আমাদের সমাজের সবার উচিৎ তাদের পাশে দাঁড়ানো।তাদেরকে যে কোন প্রয়োজনে সাহায্য সহযোগিতা করা এবং তাদেরকে ভালোবাসা দেওয়া।
ইমরান হুসাইন, শিক্ষার্থী বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সাংগঠনিক সম্পাদক বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা
নোট: অধিকারে প্রকাশিত কলাম/মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। অধিকার-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য অধিকার কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। |
সম্পাদক: মো: তাজবীর হোসাইন
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118241, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড