রহামান মৃধা
কোভিড-১৯ গোটা বিশ্বে আতঙ্ক ছড়িয়েই ক্ষান্ত হয়নি, গ্রাস করে চলেছে লাখো লাখো মানুষের প্রাণ। তবে প্রথম দিকে মানুষের মাঝে যে ভয়ানক ভয়-ভীতির সৃষ্টি হয়েছিল সেটা এখন আর নেই। মৃত্যুর সংখ্যা কিন্তু বেড়েছে বৈ কমেনি।
আমি শুরু থেকেই নানাভাবে প্রাকৃতিক দুর্ভোগের মোকাবিলা করার মতো পরিবেশ তৈরি করে নিতে চেষ্টা করে আসছি। থাকি বিশ্বের একটি উন্নত দেশে, অথচ এ এধরণের একটি অসাধারণ পরিবেশে দেখলাম এই উন্নত দেশটি বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় পিছে পড়ে আছে। এই কারণে যে নিয়মের বাইরে বা আকস্মিক কিছু ঘটলে এরা দিশাহীন হয়ে যায়।
এ বছরের এপ্রিলের শেষের দিকে লিখেছি, বলেছি সুইডেন করোনা মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়েছে। কথাটি শোনার পর অনেকেই কিছুটা বিরক্ত বোধ করেছে তখন। আমার মুখে এমন ধরণের কথা শোভা পায় না এটাও বলেছে। গতকাল সুইডেনের রাজা একই কথা বলেছেন। কথাটি শোনার পর শুধু সুইডেন নয় গোটা বিশ্বে একটি আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে।
এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে এর প্রচার হয়নি। একটি সহজ সত্য কথা বলতে এত সময় এবং এত মানুষের মৃত্যু রাজাকে দেখতে হলো! একটি বছর কীভাবে পুরো বিশ্বের মানুষ পার করলো তা হয়তো পুরাপুরি জানতে পারিনি তবে নিজের জীবনটা সম্বন্ধে জানতে পেরেছি। দিনগুলো পার করে দিচ্ছি বলা যেতে পারে।
করোনার আবির্ভাব থেকে শুরু করে সবাই যতটুকু না হলে নয় ততটুকুর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা সত্ত্বেও নানা সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়েছে, হচ্ছে। সবার ধারনা ভ্যাকসিন এলে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমিও সেটাই আশা করছি, তারপরও কেন যেন মনে হচ্ছে জীবনটা আগের মতো আর হবে না।
পৃথিবী হয়তো বদলায়নি তবে পৃথিবীর মানুষ বদলেছে। অবাক হচ্ছি লিখতে গিয়ে, ভেবেছিলাম আমাদের পরিবর্তন হবে। আমরা পরস্পর পরস্পরের বিপদে পাশে দাঁড়াবো। লোভ-লালসা থেকে দূরে থাকতে চেষ্টা করবো, দুর্নীতি, ঘুষ, ধর্ষণ এসবের পরিমাণ কমে যাবে ইত্যাদি।
কী মনে হয়? বাংলাদেশের কথাই যদি বলি, আগের তুলনায় আমাদের মন-মানসিকতার তেমন পরিবর্তন হয়েছে কি? যদি হয়ে থাকে তাহলে সেই পরিবর্তনগুলো কি খারাপের চেয়ে ভালো, নাকি উল্টো? সুইডেনে বিষয়টি নানাভাবে বর্ণনা করা যেতে পারে। যেমন বৃদ্ধ লোকের মৃত্যুটা কেন যেন সবার কাছে ন্যাচারাল মৃত্যুর মতো মনে হচ্ছে। সামাজিকতা কমেছে প্রচুর অতীতের তুলনায়।
আমাকে নিয়ে যদি বিবেচনা করি তবে বলতে হয়, এই যে এখন লিখছি মাঝ রাতে। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল। কিছুতেই ঘুম আসছে না। কী করি? বিছানা ছেড়ে ড্রয়িং রুমে এসে টেলিফোনটা নিয়ে নানা বিষয়ের ওপর দেখছি, বিশ্বের কোথায় কী ঘটছে। দুটো বিষয়ের ওপর বেশি নজর পড়লো।
এলাকার একজন মুক্তিযোদ্ধা যার জন্য দেশটি পেলাম অথচ তাকে কেউ এতটুকু সম্মান দিতে আজ পর্যন্ত পারেনি। শেষে তিনি বিনীতভাবে প্রধানমন্ত্রীর দরবারে নক করেছেন মিডিয়ার মাধ্যমে। তাকে যেন মৃত্যুর পরে রাষ্ট্রীয়ভাবে দাফন করা হয়। কী আশ্চর্য আর্তনাদ! অথচ আমরা বিজয় দিবস পালন করছি। প্রকৃতপক্ষে যারা দেশের জন্য জীবন দিয়েছে তাদের সঠিক মূল্যায়ন এখনও হয়নি, বিশেষ করে মালেক বিশ্বাসের মতো মুক্তিযোদ্ধাদের। এমন একটি ঘটনা দেখে ভাবছি বিষয়টির সঠিক তথ্য জানা দরকার। এলাকার যে ছেলেটি বিষয়টি তুলে ধরেছে তাকে নক করতেই নজরে পড়ে গেল আরেকটি দুঃসংবাদ। আমার এক স্কুল বন্ধু, রুহল কুদ্দুসের মৃত্যুর খবর। ছেলেটি সহজ, সরল, হাসি-খুশির সাথে নিজ পরিবার নিয়ে জীবনযাপন করে আসছে। বহু বছর পর ফেসবুকের মাধ্যমে আবার নতুন করে পুরনো স্মৃতির চারণ। দারুণ তার গানের বাজনা। মাঝে মধ্যে শুনি ফেসবুকের মাধ্যমে। হঠাৎ সে নেই হয়ে গেছে!
করোনা তার জীবনের ইতি টেনেছে। এভাবেই পুরো বছরটি কেটে গেল, তাই চেষ্টা করি বিভিন্ন বিষয়ের উপর লিখতে, মাঝে মধ্যে গান গেয়ে নিজেকে যেমন কিছুটা সময় ব্যস্ত রাখি ঠিক সেগুলোকে শেয়ার করি যদি কারো ভালোলাগে। চেষ্টা করি সমস্যার শেয়ার না করে ভালো কিছুর শেয়ার করতে, একইসাথে তুলে ধরি বিষয়গুলো যা হতে পারে আমাদের কল্যাণের জন্য।
অনেক কিছুই লিখলাম আবার। তবে নির্ধারিত কোনোকিছুই পরিষ্কারভাবে জানাতে পারলাম না। তবে কেন যেন মনে হচ্ছে সারাদেশের মানুষের সাথে নিচের বিষয়টি অগত্যা শেয়ার করি। জানি না এমনও তো হতে পারে কারও মাধ্যমে মালেক বিশ্বাসের আর্তনাদ পৌঁছবে দেশের কর্তৃপক্ষের কাছে। মুক্তিযোদ্ধা ভাতা চাই না! চাই রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় জানাজা! এমনটাই বলেছেন বঞ্চিত বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আব্দুল মালেক বিশ্বাস (৭১)। স্বাধীনতোত্তর প্রায় অর্ধশত বছর পার হয়ে গেলেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃত পায়নি আঃ মালেক বিশ্বাস। তিনি নামে দেশের একজন সূর্যসন্তান। দেশের বিভিন্ন দক্ষ যোদ্ধাদের হাতে অস্ত্র চালানো প্রশিক্ষণ নিয়ে ভারতের রানাঘাট ক্যাম্প ও চাপড়া ইয়ুথ ক্যাম্প নদীয়ায় অবস্থান ছিল এই যোদ্ধার। যুদ্ধকালীন সময়ে মার্চের শুরুতেই বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন আঃ মালেক বিশ্বাস।
মাটি ও মানুষের প্রতি তার অকৃত্রিম ভালবাসা এবং বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের দিগ্বিজয়ী ভাষণ তাকে মুক্তিযুদ্ধে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছেন বলে জানা যায়। এছাড়া তৎকালীন ৮ নং নহাটা ইউনিয়ন, মহম্মদপুর, মাগুরার মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হাবিবুর রহমান বাঁশি মিয়া, নজির মিয়া, আইয়ুব হোসেন ও বীর প্রতীক গোলাম ইয়াকব মিয়ার নিকট থেকে বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়ে নহাটা এবং গংগারামপুরে সক্রিয় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তিনি। এ বিষয়ে অধিকার বঞ্চিত আঃ মালেক বিশ্বাস বলেন, আমার দক্ষতায় সন্তুষ্ট হয়ে তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্নেল আতাউল গণি ওসমানীর (এম.এ.জি) স্যার আমাকে একটি স্বাধীনতা সংগ্রামের সনদপত্র প্রদান করেন।
এছাড়া (১) মাগুরা জেলা ইউনিট কমান্ড বীর প্রতীক গোলাম ইয়াকব (২) মহম্মদপুর থানা ইউনিট কমান্ড আলী রেজা (৩) ইউনিয়ন কমান্ডার মোঃ রফিকুল ইসলাম (৪) মাননীয় সংসদ সদস্য মাগুরা-২ অ্যাডঃ শ্রী বীরেন শিকদার (৫) বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল কর্তৃক প্রত্যায়নপত্র যার মুক্তি সনদ নং ০৯৮৮/৯৮। অধ্যক্ষ আব্দুল আহাদ চৌধুরী চেয়ারম্যান বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল কার্যালয়। (৬) দেশরক্ষা বিভাগ স্বাধীনতা সংগ্রামের সনদপত্র-আতাউল গণি ওসমানী (৭) মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সাময়িক সনদ - যার ক্রমিক নং ২৪৫৪১।
মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের সচিব ও প্রতিমন্ত্রী স্বাক্ষরিত। (৮) ২২ জুলাই ১৯৯৯ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আবদুল আহাদ চৌধুরী চেয়ারম্যান কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ স্বাক্ষরিত "বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল সনদ" যার ক্রমিক নং ১১৪১৬ এবং উপরোক্ত সমস্ত ডকুমেন্ট তার কাছে সংরক্ষিত রয়েছে বলে তিনি জানান।
আঃ মালেক বিশ্বাস সম্পর্কে একই গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ রবিউল আউয়াল ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আজাদ হোসেন বলেন, তিনি একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা কিন্তু রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পান নাই এটা খুবই দুঃখজনক।
কী কারণে একজন মুক্তিযোদ্ধা তার অধিকার থেকে বঞ্চিত রয়েছেন এ বিষয়ে জানতে চাইলে ৮ নং নহাটা ইউনিয়ন কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ রফিকুল ইসলাম বলেন, আব্দুল মালেক বিশ্বাস আমাদেরকে যুদ্ধকালীন সময় নিয়মিত খাদ্য সরবরাহ করতেন। এরপর আব্দুল মালেক বিশ্বাসসহ ২০-২৫ জনকে ভারতে বিশেষ ট্রেনিং-এর জন্য ভারতে পাঠানো হয়। তবে তারা ভারতে ট্রেনিংরত থাকা অবস্থায় বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।
এ সময় আঃ মালেক বিশ্বাস আরও বলেন, মুক্তি সংগ্রামী জনাব ছাদেক মিয়ার নেতৃত্বে একমাস ট্রেনিং দেওয়া হয়। এছাড়া সেপ্টেম্বর মাসে ভারী এবং অত্যাধুনিক অস্ত্রের উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের নদীয়ায় চাপড়া ইয়ুথ ক্যাম্পে নেওয়া হয়। উল্লেখ্য চাপড়া ইয়ুথ ক্যাম্পটি আসাদ মিয়ার ক্যাম্প নামে পরিচিত ছিল। যার কমান্ডার ছিলেন এস কে ব্যানার্জী।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মহম্মদপুর উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল হাই এবং বর্তমান মহম্মদপুর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির সভাপতি রেজাউর রহমান রেজু বলেন, আব্দুল মালেক বিশ্বাস (খলিশাখালী) আমার পরিচিত। তাছাড়া একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার একাধিক সনদ রয়েছে। সুতরাং তিনি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পান এটা আমরাও চাই।
এসময় তিনি প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ঘোষণা ১০% এর কথা উল্লেখ করে বলেন, কোনোভাবেই যেন ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা এবারের তালিকায় প্রবেশ করতে না পারে সেদিকেও নজর রাখছি। এদিকে প্রধানমন্ত্রী এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি আতাউল গণি ওসমানীসহ আরও অনেকের স্বাক্ষরিত একাধিক সনদপত্র সঠিক বলে দাবি করেছেন আব্দুল মালেক বিশ্বাস। মোঃ তানভীর ইসলাম (শফিক)-এর ফেসবুকের পাতা থেকে নেয়া ঘটনটি শেয়ার করলাম সেই সঙ্গে আব্দুল মালেকের জন্য সবার সাহায্য কামনা করছি।
লেখক : রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন থেকে, [email protected]
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড