ড. আবদুর রব
‘বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী’ একটি প্রাচীন প্রবাদ। বাণিজ্যে ধন লাভ করা যায়। ধনের দেবী লক্ষ্মী। তাই বাণিজ্যে লক্ষ্মীদেবী বসত করেন। ধনী হতে হলে ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও কিছুদিন বাণিজ্য পেশায় ছিলেন এবং তিনি এর গুরুত্ব সম্পর্কে বলে গিয়েছেন।
প্রাচীনকাল থেকে বাণিজ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কার্যক্রম এবং পেশাও বটে। একজনের কাছ থেকে বেশি পরিমাণে কম দামে কিনে অনেকজনের কাছে অল্প পরিমাণে বেশি দামে বিক্রি করে লাভ করা হচ্ছে বাণিজ্য। কাজটি সহজ। তবে বাণিজ্য করে লাভ করতে হলে অভিজ্ঞতার প্রয়োজন। একসময় বাণিজ্য পেশায় নিযুক্ত হওয়ার জন্য কোন শিক্ষার প্রচলন ছিল না, প্রয়োজনও ছিল না। কালক্রমে দেখা গেল বাণিজ্যের কাজটি অনেক প্রসার লাভ করেছে এবং কিছুটা জটিল হয়েছে। তাই বাণিজ্য একসময়ে শিক্ষার বিষয় হয়ে উঠলো।
বাংলাদেশে বাণিজ্য শিক্ষার ইতিহাস তেমন পুরাতন নয়। উনিশশো একুশ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময়ে বাণিজ্য বিভাগ ছিল ও বি.কম নামে বাণিজ্য শিক্ষার ডিগ্রী শুরু হয়। এরপর কলেজেও বি.কম চালু হয়। একসময় এইচএসসি ইন্টারমিডিয়েট পর্যায়ে আই.কম ও পরে কমার্স পর্যায়ে বাণিজ্য শিক্ষা শুরু হয়। এর অনেক পরে উনিশশো ছেষট্টি সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এখানে দুই বছর মেয়াদি এমবিএ ডিগ্রী দেওয়া শুরু হয়।
বাণিজ্য শিক্ষায় প্রধানত হিসাবরক্ষণ, ক্রয়-বিক্রয় এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি সেবার কার্যক্রম, নীতি ও পদ্ধতি সম্বন্ধে শিক্ষা দেওয়া হতো। এম.বি.এ-তে মূলত ব্যবসা ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন কলাকৌশল শিক্ষা দেওয়া হয়। এখানে ব্যবসার ধারণাটি অনেক ব্যাপক। এটা ক্রেতার চাহিদা নিরূপণ থেকে শুরু করে উৎপাদন বিপণন ও বিপণন পরবর্তী সেবা ছাড়াও ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্ট যে সকল কাজ ও সেবা প্রয়োজন সে সম্বন্ধে বিস্তারিত শিক্ষা দেয়। তবে প্রধান যে বিষয়টি বাণিজ্য শিক্ষা থেকে ভিন্ন তা হচ্ছে কিভাবে ব্যবসার প্রতিটি কাজ সুষ্ঠুভাবে ব্যবস্থাপনা করা যায় সে বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া। এম.বি. এ-তে ব্যবহারিক শিক্ষার বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। এমনকি হাতে-কলমে ব্যবস্থাপনা শেখার জন্য ছাত্রদের ছয় মাসের জন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কাজে নিযুক্ত করা হয়।
প্রথম দিকে এম.বি.এ প্রোগ্রামের জন্য যে ধরনের মেধাবী ছাত্র প্রয়োজন ছিল, প্রচলিত পাস কোর্স এর ডিগ্রি থেকে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ছাত্র পাওয়া যাচ্ছিল না। বাংলাদেশের মেধাবী ছাত্ররা এইচএসসি পাশ করার পরে মেডিকেল, প্রকৌশল, কৃষি অথবা অনার্সে ভর্তি হয়। যাদের এই সুযোগ হয়না বা যাদের আর্থিক সামর্থ্য থাকে না তারা পাস কোর্সে পড়তে যায়। এই পরিস্থিতিতে উনিশশো সত্তর সালের শেষ দিকে আইবিএর এক সভায় বিবিএ চালু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এর জন্য আইবিএর শিক্ষক মুহাম্মদ আলিমউল্যা মিয়ানকে চেয়ারম্যান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করে বিবিএ কারিকুলাম তৈরির কাজ শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়।
কিন্তু উনিশশো একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে কাজটি মুলতুবি হয়ে যায়। পরবর্তী পর্যায়ে বিভিন্ন সমস্যার কারণে এবং তারও পরে যারা আইবিএর পরিচালক ছিলেন তাদের অনাগ্রহের কারণে বিষয়টি আরও পিছিয়ে যায়। আমরা যারা বাণিজ্যে মাস্টার ডিগ্রী করেছিলাম এবং এমবিএ ও করেছিলাম তারা বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারতাম। সেই কারণে বিবিএ চালু করার জন্য বিশেষভাবে আগ্রহী ছিলাম। তাই উনিশশো সাতাশি সালে যখন ডক্টর আলিমউল্যা মিয়ান পরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন, তখন বিবিএ শুরু করার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হলো। অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনকে বিবিএ কারিকুলাম তৈরি করার দায়িত্ব দেওয়া হলো। আর আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হলো অ্যাডমিশন এর জন্য টেস্ট ও অন্যান্য কাজ শুরু করার।
কাজটি খুব সহজ ছিল না। কেননা বিবিএ চার বছরের আমেরিকান ধাঁচের ডিগ্রী প্রোগ্রাম হবে। বাংলাদেশ তখন দুই বছরের পাস কোর্স, তিন বছরের অনার্স কোর্স এবং এক বছরের মাস্টার্স কোর্স ছিল। কেবল প্রকৌশল ও কৃষি ছাড়া চার বছরের কোন ডিগ্রি ছিল না। মেডিকেল ডিগ্রি ছিল পাঁচ বছরের। প্রথম ধাক্কাটা লাগলো চার বছরের ব্যাচেলর ডিগ্রী কোর্স নিয়ে। যদিও আইবিএর নিজস্ব একটি আইন ছিল। কিন্তু সেখানে চার বছরের ব্যাচেলর কোর্স করার কোন উল্লেখ ছিল না। ইতোপূর্বে এক বছরের মাস্টার্স এর পরিবর্তে দুই বছরের এমবিএ ডিগ্রী চালু করার বিষয়ে তখন কোন মতভেদ হয়নি।
উনিশশো উননব্বই সালে বিবিএর কারিকুলাম তৈরি করে বিভিন্ন কমিটিতে পাস করা হয় এবং সে বছরই বি.বি.এ-তে ভর্তির জন্য দরখাস্ত আহ্বান করা হয়। কিন্তু একটি ঈর্ষান্বিত মহল শেষ মুহূর্তে ভর্তি পরীক্ষা বন্ধ করতে সফল হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে চার বছরের কোন ব্যাচেলর ডিগ্রী নেই এবং আইবিএর আইনে এর কোন উল্লেখ নেই এই অভিযোগে তারা বিবিএ শুরু করতে বাধা সৃষ্টি করে। এই জটিলতা নিরসন করতে চার বছর লেগে যায়। শেষ পর্যন্ত উনিশশো তিরানব্বই সালে আইবিএতে বিবিএ শুরু করা হয়।
প্রফেসর আলিমউল্যা মিয়ান ১৯৮৮ সাল থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় করার চিন্তা–ভাবনা করছিলেন এবং আমাকে বিবিএ কারিকুলাম তৈরি করতে অনুরোধ করেন। কারিকুলামটি প্লানিং অ্যাকাডেমিতে একটা সেমিনারে শিক্ষাবিদ, ব্যবসা-শিল্প প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ও সরকারী কর্মকর্তাদের কাছে উপস্থাপন করা হয়। তাদের মতামত বিবেচনায় নিয়ে কারিকুলামটি পরিমার্জনা করা হয়। আইবিএর পরিচালকের পদ থেকে অবসর নিয়ে প্রফেসর মিয়ান উনিশশো একানব্বই সালে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ বিজনেস এগ্রিকালচার এন্ড টেকনোলজি (আইইউবিএটি) নামে একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করেন ও উনিশশো বিরানব্বই সালের জানুয়ারিতে বিবিএ শুরু করেন।
আরও পড়ুন : ১০ নভেম্বর ১৯৯০ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাস
এর পরের বছরই অর্থাৎ ১৯৯৩ সালে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি বিবিএ চালু করে। এরপর অন্যান্য প্রাইভেট ও পাবলিক ইউনিভার্সিটি বিবিএ ডিগ্রি দিতে থাকে। বিবিএ এখন একটি অতি জনপ্রিয় এবং আকর্ষণীয় শিক্ষা কার্যক্রম। তাই সব বিশ্ববিদ্যালয় তো বটেই কলেজেও এখন বিবিএ ডিগ্রি দেওয়া হচ্ছে। বিবিএ ডিগ্রিধারী মেধাবী ছাত্ররা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সফল নেতৃত্ব দিচ্ছে যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। বিবিএ শুরুর উদ্যোগ নেওয়ায় আইবি’র ও বিবিএ শুরু করার জন্য আইইউবিএটি’র ভূমিকা এবং উভয় ক্ষেত্রে প্রফেসর আলিমউল্যা মিয়ান এর অবদান চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
লেখক: উপাচার্য, আইইউবিএটি ও প্রাক্তন অধ্যাপক এবং পরিচালক, আই.বি.এ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড