• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

অসম্মতিতে সম্মত হবার আরেক নাম শান্তি

  রহমান মৃধা

০৭ নভেম্বর ২০২০, ১৬:১৫
অধিকার

ফ্রান্সে অতীতে বহুবার গিয়েছি। বিশ্বের সব দেশের মানুষের বাস সেখানে। তবে বোঝা যায় সেখানেও মানুষে মানুষে ভেদাভেদ রয়েছে। ধনী-গরিব, ভাষা-সংস্কৃতি, ধর্ম-বর্ণ এগুলো বিশ্বের সর্বত্র বড় আকারে প্রভাব ফেলে চলেছে। আমরা দিন দিন গ্লোবালাইজড হচ্ছি আর মানুষে মানুষে ভেদাভেদ সৃষ্টি করছি। আমি প্রায়ই বলে থাকি ‘to be poor is very expensive’.গরিবের না আছে বন্ধু, না আছে অর্থ। সেক্ষেত্রে সমাজের চোখে সব সময় অবহেলিত, নির্যাতিত এবং হেয় প্রতিপন্ন হয়।

বাংলাদেশে ভাষা, বর্ণ ও ধর্ম এক হওয়া সত্ত্বেও গরিব হবার কারণে সমাজে এদেরকে তেমন ভালো চোখে দেখা হয় না। আবার একই ভাষা বুকের মাঝে সত্বেও ধর্ষণ, গণহত্যা এবং শেষে মরদেহকে দিবালোকে পুড়িয়ে ফেলতেও বিবেক বাধা দেয় না। হিংসাত্মক ক্ষমতাবান বৈষম্যবাদী পুঁজিবাদের অন্ধকার হৃদয়কে গ্রাস করেছে। দেশে হত্যার উল্লাসে অনেকে উল্লসিত। মনে হচ্ছে সকলেই কোনো না কোনো ঘৃণার নেশায় নিমজ্জিত। সকলেই হয় আত্মঘাতী, নয়তো পরঘাতী। অনেকের ধারণা রাষ্ট্র, রাজনীতি, আইন-প্রশাসন ঠিক না করলে মানুষের আচরণ বদলাবে না। দেশের মানুষই যখন বেঠিক তখন রাষ্ট্র, রাজনীতি, আইন, প্রশাসন ঠিক করবে কারা?

বিশ্বের অনেক দেশেই একই অবস্থা। তা ছাড়া ধর্ম এবং বর্ণের অমিলে পাশ্চাত্যে হেয় প্রতিপন্ন হবার সম্ভাবনা একটু বেশি। সমাজের সঙ্গে নিজেকে অ্যাডজাস্ট করতে পারলে পার্থক্যটা এতটা চোখে পড়ে না। ইউরোপের সবচেয়ে বেশি মুসলমানের বসবাস ফ্রান্সে। এদের মোট লোকসংখ্যার মধ্যে প্রায় এক কোটি মুসলমান। সেক্ষেত্রে ফ্রান্স সরকারের উচিত হবে না মুষ্টিমেয় বা কতিপয় কিছু মুসলমানদের অমানবিক ব্যবহারের কারণে পুরো মুসলিম জাতিকে অবমাননা করা অথচ এমনটিই ঘটে চলেছে।

ভারত এবং চীনে মুসলমানরা সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে তাদের ওপর অমানুষিক দুর্ব্যবহার করা হচ্ছে। মায়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের বের করে দেয়া হয়েছে। বিশ্ব দেখছে অথচ তেমন কিছুই করছে না। নিউজিল্যান্ডের সেই খুনিটা ৫০ জন মুসলমানকে মেরে ফেলার পরও কেউ বলেনি যে, সেটা খ্রিস্টধর্মের সমস্যা যা প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রন বলছেন।

হিটলারের ইহুদী বিদ্বেষের ফল জার্মানির জন্য বিপর্যয়কর হয়েছিল। ভারতে মুসলিম বিদ্বেষের ঢেউ সাধারণ ভারতীয়দের জীবন জীবিকার অবনতি থেকে শুরু করে তাদের গণতন্ত্র ও অর্থনীতিকে রসাতলে ঠেলে দিচ্ছে। একইভাবে বর্ণবৈষম্যের কারণে বিশ্বের অনেক মানুষ প্রতিদিন ডিসক্রিমিনেট হচ্ছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিসংঘ গঠন করা হয়েছে। তবে জর্জরিত, নিপীড়িত মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। হঠাৎ যখন একটি অঘটন ঘটে, সবাই উত্তেজিত হয়ে কিছুদিন হৈহুল্লোড় করে, পরে সবকিছু শীতল হয়ে যায়। এভাবে চলতে থাকলে সমস্যার সমাধান হবে না, যার ফলে নিপীড়িত নির্যাতিতের সংখ্যা বেড়ে চলবে। সবাই দেখছে কিন্তু কেউ তেমন কিছু করছে না। সবাই বলতে আমার দৃষ্টিতে যাদের পরিবর্তন করার ক্ষমতা রয়েছে তাদেরকেই আমি দোষারোপ করছি।

ছোটবেলা যখন স্কুলে পড়েছি তখন শুনেছি ছবি তোলা যাবে না। ইসলামে ছবি আঁকা নিষিদ্ধ। যে ছবি আঁকবে বা তুলবে, সে জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে। এখন বিশ্বের সব মানুষের ছবি তোলা বা ছবি আঁকা নিয়ে তেমন কোনো বাধা নেই। এখন ফেসবুকে ছবি, লাইভ ভিডিও সবই চলছে। কিন্তু কেন ছবি নিষিদ্ধ এবং কেন সৃষ্টিশীল কাজগুলোকে ইসলামে নিষিদ্ধ করা হয়েছে তা নিয়ে কি আমরা এখন ভাবছি?

আমরা ছোটবেলা থেকেই দেখে এবং শুনে শিখতে শুরু করেছি। যেগুলো দেখা, শুনা বা ছোঁয়ার বাইরে সেগুলো জেনেছি ছবি দেখে। যেমন অক্ষর, হোক না তা বাংলা, ইংরেজি বা আরবি। ছবি থেকে হাজার বছর ধরে অক্ষরের উৎপত্তি হয়েছে। মানুষের মুখে ভাষা এসেছে এবং মানুষ তার মনের ভাব ভাষা ও অক্ষরের মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারছে।

পরিবার পরিজন থেকে যখন দূরে থাকি তখন তাদের ছবিগুলো দেখি। একেকটা ছবি যেন একেকটা মুহূর্ত, একেকটা স্মৃতি, সময়কে ধরে রাখার প্রচেষ্টা। যখন ক্যামেরা ছিল না তখন মানুষ গাছের পাতায়, দেয়ালে, মাটিতে এবং পাথরে খোদাই করে তাদের স্মৃতি ধরে রাখতো । তারপর এল কাগজের ব্যবহার। ক্যানভাসে আর রংয়ের তুলিতে মানুষ সময়কে, নিজের সৃজনশীলতাকে ধরে রাখতে শুরু করল।

আমাদেরকে ছোটবেলায় বিভিন্ন দৃশ্যের ছবি আঁকতে বলা হতো। গ্রামের দৃশ্য, শহরের দৃশ্য। কিন্তু যখনই কোনো মানুষের বা প্রাণীর অবয়ব আঁকার চেষ্টা করতাম, তখন মুরুব্বিরা মানা করতেন আর হারাম বলে ঘোষণা দিতেন। অথচ ছবি এখন বিভিন্ন কাজে লাগছে। পরীক্ষার প্রবেশপত্রে, ভোটার আইডিতে, পাসপোর্ট করতে, বিয়েতে, হজ্জে যেতে, জমি নামজারিতে ছবি লাগে, তখন আবার ছবি তোলা নিষেধ নয়।

‌মোনালিসার ছবিটা যদি আঁকা না থাকত আমরা জানতামও না তাকে দেখতে কেমন ছিল। ছবি এখন আবার দুরকম। স্থির ছবি আর চলমান ছবি। স্থির ছবি যেন সময়টাকে স্তব্ধ করে দেয়, আমাদেরকে নিয়ে যায় সেই স্তব্ধ সময়ের কাছে, সময়ের রেলগাড়িতে চড়িয়ে। আমাদের স্কুলজীবনে ক্যামেরার চল কম থাকায় এখনও আফসোস হয় যে কেন সে সময়ের ছবি নেই। আর এখন ছবি তোলা কত সহজ। সবার হাতের মুঠোয় ক্যামেরা। বিজ্ঞানের এই অগ্রগতি নিঃসন্দেহে অনস্বীকার্য।

যা কিছু নতুন তাকে সাদরে গ্রহণ করা হচ্ছে। নতুনকে গ্রহণ ও পুরাতনকে বর্জন বা সংস্কার করা হচ্ছে তা নিশ্চিত আমরা লক্ষ্য করছি। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে কিন্তু চলছি। আমরা এখন সেলফি তুলছি, সেলফি তোলা এখন কোনো অন্যায় নয়। এখন সরাসরি সেলফি থেকে শুরু করে টিভির মাধ্যমে মক্কা থেকে হজ্জ পালনের দৃশ্য দেখছি, নবীজির কবরস্থান দেখছি। তাহলে ছবি তোলা বা আঁকাতে কোনো ক্ষতি এখন আর আগের মতো নেই। যার কারণে এখন আমরা মনের আনন্দে ছবি তুলছি। ছবি তোলাকে আজকাল প্রফেশন হিসেবেও নেয়া হয়েছে। ছবি হচ্ছে মনের ভাষ প্রকাশ করার সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম। অথচ কিছুদিন আগে গ্রামের এক ইমাম সাহেব আমাদের বাড়িতে এসে বলেছেন, সবকিছু ভালো লেগেছে তবে মৃত ব্যক্তির ছবিটি যেন সরিয়ে ফেলা হয়, এতে ঘরে ফেরেশতা আসে না। পরে সেই ইমাম সাহেবের মৃত্যু হলে শুনেছি তার ছেলে বাবার ছবিটি দেয়ালে ঝুলিয়ে রেখেছে। ছবি না হয় দেয়ালে ঝুলিয়ে নাই রাখলাম কিন্তু মনের ভেতর যে ছবি গেঁথে আছে তা কিভাবে সরিয়ে ফেলবো, ভেবেছি কি? সেখানে কি ফেরেশতা আসবে, না আসবে না!

মনে রাখা দরকার মত প্রকাশের স্বাধীনতা আর চিন্তার স্বাধীনতা এক নয়। মতামত ব্যক্তির মনের মধ্যে সব সময় লুকিয়ে থাকতে পারে না। মতামত চিন্তার বহিঃপ্রকাশ। পরিবেশ, পরিস্থিতি এবং জ্ঞানের সমন্বয়ে গড়ে উঠে বিবেক বা চিন্তাচেতনা। নানা কারণে চিন্তার বহিঃপ্রকাশ সব সময় ঘটে না। তবে চিন্তার যোগ্যতা এবং স্বাধীনতা ছাড়া কেউই দুনিয়ায় তাদের অধিকার কায়েম করতে পারে না। সেক্ষেত্রে দরকার বাক স্বাধীনতার মৌলিক অধিকার। আমাদের অবশ্যই মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করা উচিত। তবে মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে অবশ্যই সীমারেখা থাকতে হবে এবং তা লঙ্ঘন করা উচিত নয়। আমাদের অন্যদের প্রতিও সম্মান দেখাতে হবে। ধর্মবিদ্বেষ অসুস্থ মতপ্রকাশের বিকার, চিন্তার স্বাধীনতা আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠাকে সাহায্য করে। আমাদের কাজ হওয়া উচিত নিজ নিজ জায়গা থেকে যেটা সঠিক সেটা মেনে চলা।

আমি যেটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি সেটা যদি অন্য কেউ না করে সেখানে জোর করার কিছু থাকতে পারে না। সেক্ষেত্রে যার যার ধর্ম তার তার কাছে থাকা ভালো। অন্যের ধর্মকে ছোট করা একজন ধর্মপ্রাণ মানুষের কাজ নয়। তাই আসুন ঘৃণা নয় ভালোবাসা দিয়ে জয় করি এবং জয়ী হই।

লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন থেকে, [email protected]

চলমান আলোচিত ঘটনা বা দৃষ্টি আকর্ষণযোগ্য সমসাময়িক বিষয়ে আপনার মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাই, সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইলকরুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড