দায়িদ হাসান মিলন
নাগোরনো-কারাবাখ অঞ্চল নিয়ে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে সংঘাত চলছেই। টানা কয়েকদিন চরম উত্তেজনার পর ২৭ সেপ্টেম্বর দেশ দুটির মধ্যে সংঘাত শুরু হয়। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি দেশ দুপক্ষকে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়েছে। শুরুতে আর্মেনিয়া তাতে রাজি না হলেও সুর পাল্টেছে এখন। তারা রাশিয়া, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি চায়।
এ দিকে শুরু থেকেই যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নাকচ করে আসছে আজারবাইজান। এখনো সেই সিদ্ধান্তে অনড় তারা। আজারবাইজানের সিদ্ধান্তকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে তুরস্ক। ফলে ‘বাকু’র নেতাদের পেছনে ফিরে তাকাতে হচ্ছে না। আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভের কণ্ঠের দৃঢ়তাও সেটিই বলছে।
ইলহাম আলিয়েভ সম্প্রতি কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, নাগোরনো-কারাবাখ অঞ্চল থেকে বিদায় নিতে হবে আর্মেনিয়া ও এর সামরিকবাহিনীকে। তারপরই কেবল যুদ্ধ থামবে এবং দ্বন্দ্বের অবসান ঘটবে।
অন্যদিকে আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনইয়ান বলছেন, আজারবাইজানকে উপযুক্ত জবাব দেওয়া হবে। এ জন্য তিনি দেশের মানুষকে এক হওয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন।
আরও পড়ুন : আর্মেনিয়া-আজারবাইজানের যুদ্ধে ভয়ঙ্কর হুঁশিয়ারি ইরানের
দুটি দেশের মধ্যে সংঘাত শুরু হলেও তা এখন আর দুই দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। তৃতীয় পক্ষ হিসেবে এতে যুক্ত হয়েছে বেশ কয়েকটি দেশ। এক্ষেত্রে সবচেয়ে আলোচিত দেশ দুটি হলো- তুরস্ক ও রাশিয়া। শুধু আজারবাইজান-আর্মেনিয়াতেই নয়, সিরিয়া ও লিবিয়াতেও তুরস্ক ও রাশিয়ার অবস্থান মুখোমুখি।
সংঘাতের সম্ভাব্য পরিণতি
আজারবাইজান-আর্মেনিয়ার সংঘাত যে কোনো সময় সর্বাত্মক যুদ্ধে রূপ নিতে পারে বলে মনে করছেন বৈশ্বিক বিশ্লেষকরা। আর সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হলে তাতে রাশিয়া ও তুরস্কের মতো আঞ্চলিক শক্তিগুলো জড়িয়ে যেতে পারে। ফলে শেষ পর্যন্ত সেই যুদ্ধ কোনদিকে মোড় নেবে বা কোথায় গিয়ে শেষ হবে তা বলা কঠিন। এ সম্পর্কে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের বিশেষজ্ঞ অলিসিয়া ভারতানিয়ান বলেন, আমরা নিশ্চিতভাবেই একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ দেখার কাছাকাছি রয়েছি। এমনকি এই যুদ্ধ আঞ্চলিক পর্যায়েও হতে পারে।
আজারবাইজানের-আর্মেনিয়া সংঘাতে বাকু-র প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছে আঙ্কারা। শুধু তাই নয়, তুর্কি প্রেসিডেন্ট রেসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান বলেছেন, তুরস্ক ও আজারবাইজানের মানুষজন ‘একই’। তার এই বক্তব্য আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে সংঘাতে আজারবাইজানকে বেশ এগিয়ে রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে। তাছাড়া বাকু-কে আঙ্কারা সব ধরনের সর্বোচ্চ সহায়তার আশ্বাস দিচ্ছে বার বার। আঞ্চলিক একটি শক্তির এমন আশ্বাসের কারণে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট।
রাশিয়াকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে তুরস্ক?
আর্মেনিয়ার সঙ্গে তুরস্কের সীমান্ত থাকলেও দেশ দুটির মধ্যে কোনও কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। অন্যদিকে আজারবাইজান থেকে তুরস্কে পাইপ-লাইনের মাধ্যমে তেল ও গ্যাস আসে। এছাড়া দেশ দুটির মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্কও বেশ ভালো। সব মিলিয়ে নাগোরনো-কারাবাখ ইস্যুতে বাকু-কে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে আঙ্কারা। এতে দুপক্ষই লাভবান হবে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।
আরও পড়ুন : জয় ছাড়া আর্মেনিয়ায় আক্রমণ বন্ধ করবে না তুরস্ক
অন্যদিকে রাশিয়া এই ইস্যুতে বেশ কয়েকবার যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিলেও তারা মূলত ঝুঁকে আছে আর্মেনিয়ার দিকে। যদিও আর্মেনিয়ার প্রতি রাশিয়ার সমর্থন ততটা জোরালো নয়। এর কারণও ব্যাখ্যা করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, আর্মেনিয়ার হয়ে যুদ্ধে জড়ালে বা কোনও সামরিক পদক্ষেপ নিলে রাশিয়ার জন্য ইতিবাচক কিছু আসবে না।
কাগজপত্রে আর্মেনিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র রাশিয়া। তাদের মধ্যে ‘কালেকটিভ সিকিউরিটি ট্রিটি অর্গানাইজেশন (সিএসটিও)’ নামের একটি সামরিক চুক্তিও আছে। আজারবাইজান যদি নাগোরনো-কারাবাখের পর আর্মেনিয়ার নিজস্ব ভূমিতে হামলা চালায় তাহলে সিএসটিও চুক্তি অনুযায়ী মস্কোর সামরিক সহযোগিতা চাইতে পারবে ইয়েরেভান।
আর্মেনিয়ার হয়ে রাশিয়া যুদ্ধে জড়িয়ে গেলে তুরস্কের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের ব্যাপক অবনতি হবে। এতে মস্কোর সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ শুরু হতে পারে আঙ্কারার। এ কারণেই আর্মেনিয়ার হয়ে যুদ্ধে জড়াবে না রাশিয়া। কারণ, ইতোমধ্যে ইউক্রেন ও সিরিয়ায় যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে মস্কো। নতুন করে আরও একটি যুদ্ধ রুশ অর্থনীতিকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে। এতে বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলোর প্রতিযোগিতা থেকে ৩০-৫০ বছরের জন্য ছিটকে যেতে পারে রাশিয়া।
অন্যদিকে ‘কালেকটিভ সিকিউরিটি ট্রিটি অর্গানাইজেশন (সিএসটিও)’ চুক্তির আওতায় আর্মেনিয়ার হয়ে রাশিয়া যুদ্ধে না জড়ালে বৈশ্বিকভাবে মস্কোর প্রভাব হুমকির মুখে পড়বে। এটা রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের জন্য উভয়সংকট।
কী সমাধান বের করবে রাশিয়া?
নিজেদের সুবিধার্থে নাগোরনো-কারাবাখ অঞ্চল নিয়ে উত্তেজনা হ্রাসের চেষ্টা করবে রাশিয়া। তবে এটা যে এখনই করতে হবে এমন নয়। রাশিয়া বরং এই পরিস্থিতিতে আর্মেনিয়া সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে বিভিন্ন সুবিধা আদায় করবে। আর্মেনিয়ান সেন্টার ফর পলিটিক্যাল অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের পরিচালক আগাসি ইয়ানোকিয়ান এমনটিই মনে করেন।
আরও পড়ুন : আর্মেনিয়ার গোলার আগুনে পুড়ছে প্রতিবেশীরাও
আগাসি ইয়ানোকিয়ান আরও মনে করেন, আর্মেনীয় সামরিকবাহিনীর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনইয়ানের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করতে পারে রাশিয়া। এই চাপের উদ্দেশ্য হলো- পাশিনইয়ান যেন আরও বেশি রুশপন্থি হন। আর পাশিনইয়ান যদি রাশিয়ার কথামতো না চলে তাহলে তার বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটাবে মস্কো।
সূত্র : ওয়াশিংটন পোস্ট, আল-জাজিরা, বাইলাইন টাইমস
লেখক : দায়িদ হাসান মিলন, লেখক ও সাংবাদিক
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড