• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

পেঁয়াজের পর চালেও চলছে চালবাজি

  মীর আব্দুল আলীম

২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, ২১:২৮
অধিকার

(১) “চালের দাম বাড়ছেই, পেঁয়াজের দামও কমছে না” (২) “পণ্য-মূল্য আঁকাশ ছোঁয়া” (৩) “পাইকারি বাজারের সাথে ভোক্তামূল্যে এতো ফারাক কেন?” এ সব আজকের (২৬ সেপ্টেম্বর) পত্রিকার শিরোনাম।

চাল, পেঁয়াজ, সবজির দাম বাড়ছে তো বাড়ছেই। প্রতিদিনই কমবেশি চালের দাম বাড়ছে। গত এক সপ্তাহে চালের দাম কেজিতে মানভেদে ৫ থেকে ৭ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, পেঁয়াজের দামও আর বাড়ছে।

দেশি পেঁয়াজ ৮০ থেকে ৯০ টাকা ও আমদানি করা পেঁয়াজ ৭০ থেকে ৮০ টাকায় রাজধানীর বাজারে বিক্রি হচ্ছে। ক্ষেত্রভেদে সেটা একশ’ টাকার উপরেও বিক্রি হচ্ছে। এক মাস আগেও এ পেঁয়াজ যথাক্রমে ৪০ থেকে ৪৫ টাকা ও ৩০ থেকে ৩৫ টাকা ছিল। তেলের দামও বেড়েছে।

করোনা সংকটে মানুষের আর্থিক সঙ্গতি কমেছে। মানুষের পকেটে পয়সা নেই, তাই পণ্যের চাহিদা এ কারণে আগের চেয়ে কম। তাহলে পণ্য মূল্য এভাবে বাড়ছে কেন?

ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ হবার ঘোষণার পরই (সেদিনই) কিন্তু দেশে পেঁয়াজের সংকট শুরু হয়নি। তার পরও সাথে সাথেই লাফিয়ে লাফিয়ে পেঁয়াজের দাম বাড়ল কেন? তখন পর্যাপ্ত আমদানি করা পেঁয়াজ ছিল বাজারে, হুট করে অস্বাভাবিক দাম বাড়াটাও অযৌক্তিক। বাজার যে সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই সেটা স্পষ্ট এখানে। দেশের মজুতদাররা যে সবসময় সক্রিয় তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। চাল, সবজি, তেলসহ অন্যসব পণ্যের এভাবে দাম বাড়ার কারণ আছে কী?

বর্ষা বন্যায় এসব পণ্যের দাম কিছুটা বাড়ে, তবে এবার যেভাবে বেড়েছে ততটা নয়। চাহিদা অনুযায়ী পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নানামুখী উদ্যোগ নেয়া সত্ত্বেও তার সুফল অনেক সময় ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় পরিবহন চাঁদাবাজি ও মজুদদারির কারণে। এবারো বেড়েছে। চলতি সরকারের অধীনেই বাজার অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে ছিল। এখন নেই। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম এভাবে বেড়ে যাওয়ায় ক্ষুব্ধ ক্রেতারা। সারাদেশে দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিভাগীয় এবং জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে কাজ করছেন সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। কিন্তু তাতেও কী দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আছে? বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আর জেলা প্রশাসনের হুমকি ধমকিকে কী পাত্তা দিচ্ছে ব্যবসায়ীরা? উল্টে পেঁয়াজের দামে আগুন লাগিয়ে ছেড়েছে।

চালেও চলছে চালবাজি। আমরা আসলে সবাই রাজা! কারোরই অর্থকড়ির অভাব নেই! তাই ১ টাকার জিনিস ২ টাকায় কিনতেও নেই সমস্যা। ভাবখানাতো এমনই। বাজারে পণ্য মূল্য বেড়েছে অবিশ্বাস দরে। জনগণ বাড়তি দামে এসব পণ্য কিনছে না তা কিন্তু নয়। পেঁয়াজসহ নিত্য পণ্যের এতো দাম! তবুও দেশের কোথাও কোন প্রতিবাদ নেই। আমজনতার মুখে কুলুপ আঁটা। বলতে গেলে জনগণের গাঁটে পয়সা আছে; তাই গায়ে লাগছে না এই আর কী! পেঁয়াজ ৩৫ টাকা থেকে কয়েকদিনের ব্যবধানে ১শত টাকায় গিয়ে ঠেকেছে।

কোন কোন পণ্য ৩০/৪০ টাকা থেকে লাফিয়ে বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। কাঁচামরিচ ও বেগুন ও অন্যান্য সবজি সবটার দামই বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ তিনগুণ হয়েছে। ২০ টাকার শসা বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৪০ থেকে ৫০ টাকা। কাঁচামরিচ ৫৫ থেকে ৬৫ টাকা দরে বিক্রি হলেও চলতি বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৫০ টাকা কেজি দরে। আর মাছ-মাংসের দাম তো আগে থেকেই বেড়ে আছে। ভর মৌসুমেও ইলিশের দাম চড়া। কেজি প্রতি পাঙ্গাশ ১৪০-১৬০, সিলভার কার্প ১৬০-২০০, শিং-মাছ ৬০০-৮০০, তেলাপিয়া ১৮০-২২০, দেশি মাগুর ৬০০-৮০০, চায়না পুঁটি ১৫৫-১৯০। দেশি আলু (লাল) ৩০-৪০, করলা ৬০-৮০, পটোল ৬০, কাঁকরোল ৫৫-৬০, চিচিঙ্গা ৫০-৬০, মিষ্টি কুমড়া (কাটা পিস) ২৫-৪০, লাউ ৪০-৬০, কচুর লতি ৫০-৬০, গাঁজর ৪০-৫০ টাকা, পেঁপে ৪০-৪৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এটাই বর্তমানে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারের হাল চিত্র। শুধু তরিতরকারি নয় ছোলা, ডাল, মাছ মাংস সব কিছুর দামই এখন বেশ চড়া।

সরবরাহ বাড়াতে ভারত ছাড়াও বিকল্প উৎস থেকে পিয়াজের পর্যাপ্ত আমদানি হলেও তার প্রভাব পড়েনি বাজারে। প্রশ্ন হলো তবে কি দেশে পেঁয়াজ মজুত নেই বা ছিল না? বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পারা গেছে, দেশে বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ মজুত রয়েছে। ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করেই ইচ্ছা অনুযায়ী পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে রাতা-রাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে বলছে, প্রতিবছর দেশে ১৫ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে স্থানীয়ভাবেই উৎপাদন হয় প্রায় ১২ লাখ টন। আর চাহিদার মাত্র ৩ লাখ টন পেঁয়াজ বছরের বিভিন্ন সময়ে আমদানি করা হয় ভারত থেকে। মানুষের পকেট মেরে রাতারাতি বাড়ি-গাড়ি আর ব্যাংক ব্যালেন্স করার জন্যই এসব করা হচ্ছে। পণ্যের দাম বাড়তে পারে। এটা চলমান প্রক্রিয়া। ফি বছর ধরেই হয়। তবে সকালে ৬০ দুপুরে ৮০ আর রাতে ১০০ টাকা এভাবে কি পৃথিবীর আর কোনো দেশে দাম বাড়ে?

এ দেশে হুট হাট পণ্য মূল্য বেড়ে; বাড়ে জনগণের নাভিশ্বাস। এটা নতুন নয় যে কোন অজুহাত মানেই পণ্য মূল্যের দাম বেড়ে যাওয়া। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন পাগলা ঘোড়া ছুটছে তো ছুটছেই। বর্তমানে অস্থির হয়ে উঠেছে বাজার। কোনই সুখবর নেই। চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, রসুন, ডিম, আলু, খেজুর, মাছ, মাংস, মসলা, কাঁচামরিচ, শাকসবজি, ফলমূলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় হেন পণ্য নেই যে, গায়ে মূল্যবৃদ্ধির উত্তাপ নেই-তফাৎটা শুধু ডিগ্রির, কোনটার বেশি কোনটার কম। ব্যবসায়ী-মজুদদাররা মুনাফায় পকেট ভারি করার মওকা ছাড়ে না। সুযোগমত দু’টো পয়সা কামিয়ে নিতে এরা কোমর বেঁধে প্রস্তুতি নেয়।

মজুদ গড়ে তোলে, দফায় দফায় মূল্য বাড়িয়ে সাধারণ ভোক্তাদের নাভিশ্বাস তুলে ছাড়ে। এসব মুনাফাখোররা এদেশের অসহায় মানুষের কথা ভাবে না। এখন নিম্ন আয়ের মানুষ তাদের চাপিয়ে দেয়া দাম দিয়ে খাবার কিনতে পারছে না। ওরা ২ বেলা পেট পুরে খেতে পারছে না। আসলে মানুষকে জিম্মি করে অধিক মুনাফা লাভের ব্যবসায়ীদের এই খেলা কোনো সরকারই বন্ধ করতে পারে না, একথা কেউ বিশ্বাস করবে না। সরকারের সৎ ইচ্ছা থাকলে এই খেলা বন্ধ করা অবশ্যই সম্ভব, কিন্তু এই সম্ভবকে অসম্ভবের হাত থেকে বাঁচাতে সরকারকে অবশ্যই হার্ড লাইনে চলতে হবে। প্রথমে চিহ্নিত করতে হবে সেসব অসাধু ব্যবসায়ীদের যারা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে তাদের সকল বিবেকহীন আয়োজন সম্পূর্ণ করেছে।

অর্থনীতিতে একটা কথা আছে, চাহিদার তুলনায় উৎপাদন যতো কম হবে পণ্যের দাম বাজারে ততো বেশি হবে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সহজ কাজ নয়। সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও চারদলীয় জোট সরকার এবং বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের সময় দেখেছি, যতবার পণ্যের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে, ততবার বাজারে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে। ব্যবসায়ীরা সরকারকে বারবার আশ্বাস দিচ্ছে, পণ্যের দাম বাড়বে না। কিন্তু বাস্তবে তা তামাশা মাত্র! তার কোনো প্রভাব কখনই বাজারে পড়ে না। দেশব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য অসৎ ব্যবসায়ী সব সময়ই বেপরোয়া। তারা মন্ত্রী, সচিব, ডিসি এসপিদের ছোঁড়া হুংকারকে দিব্যি ধিক্কার দিয়ে চলে। অসৎ বৃহৎ ব্যবসায়ীদের একটি গোষ্ঠী বরাবরই পণ্য মূল্য বাড়িয়ে তাদের পকেট স্ফীত করে চলেছে। এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণ সরকারকে যেকোনো মূল্যে নিতেই হবে।

এজন্য বিরোধীদলগুলোকেও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসতে হবে। এভাবে অহেতুক পণ্য মূল্য বাড়ার ঘটনা বোধ করি কোন সভ্য সমাজে ঘটে না। অন্য কোন দেশেও তার নজির নেই। এভাবে আর চলতে পারে না। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে এখনই ওদের রুখতে হবে। সরকার, জনগণ দলমত নির্বিশেষে ওদের ওপর দুর্বার গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। প্রতিবাদী হতে হবে। বাজার নিয়ন্ত্রণে এর আর বিকল্প আছে বলে আমি মনে করি না। দ্রব্যসামগ্রী অর্থাৎ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসমূহের মূল্য স্থিতিশীল রাখার ব্যাপারে বর্তমান পরিস্থিতিতে যা করা দরকার তাহলো- সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে তাদের নেয়া পদক্ষেপগুলো কার্যকর করতে হবে। যেকোনো মূল্যে মধ্যস্থানীয় শ্রেণির কারসাজি বন্ধ করতে হবে। সরকারকে ব্যবসায়ীদের ওপর বাজার নিয়ন্ত্রণে নির্ভরশীলতা কমাতে হবে।

আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য সামঞ্জস্য আছে কিনা নিয়মিত তা তদারকি করতে হবে। দোকানদারদের কাছ থেকে চাঁদাবাজদের চাঁদাবাজি বন্ধের ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। পরিবহন খাতের চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে।

বাজারেও যেসব পণ্যের চাহিদা বেশি, তা বেশি করে যোগান দিতে হবে। পাইকারি বাজার থেকে মধ্য শ্রেণির গোষ্ঠী যাতে স্বার্থ হাসিল না করতে পারে, সেজন্য পাইকারি বাজার থেকে খুচরা বাজার পর্যন্ত সরকারি নিজস্ব পরিবহন ও জনবলের মাধ্যমে খুচরা বাজারে পণ্যসামগ্রী পৌঁছে দেয়া যেতে পারে। তাতে করে চাঁদাবাজদের চাঁদাবাজিও বন্ধ হবে। বেশি করে পণ্য আমদানি করে সুষ্ঠুভাবে বণ্টন করা। আরও বেশি করে সরকারি বিক্রয় কেন্দ্র স্থাপন করে সুষ্ঠু ও স্বচ্ছভাবে বণ্টনের ব্যবস্থা করা। সর্বোপরি ব্যবসায়ীদের শপথ নেয়া উচিত-’আমরা পণ্যসামগ্রী মজুদের মাধ্যমে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বাড়াবো না এবং পণ্যসামগ্রীতে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন করবো না।’

আগাম সতর্ক বার্তার মতো উচ্চারণ করা যায়, বাজার একবার চড়লে সেই চড়া বাজার আর নামতে চায় না। এটা হচ্ছে অতীতের অভিজ্ঞতা। সে জন্য পণ্য মূল্য স্থিতিশীল রাখতে যা যা করা দরকার তা সরকারকে করতে হবে। এজন্য বাজার মনিটরিংয়ে সরকারকে আরও চৌকস হতে হবে। আর তাতে হয়তো কিছুটা মুক্তি মিলতে পারে।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গবেষক।
চলমান আলোচিত ঘটনা বা দৃষ্টি আকর্ষণযোগ্য সমসাময়িক বিষয়ে আপনার মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাই, সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইলকরুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড