• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩০ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

জ্যাক দারিদা : নির্মাণ বিনির্মাণের খেরখাতা 

  সিদ্ধার্থ শংকর জোয়ার্দ্দার

২৬ আগস্ট ২০২০, ১৬:৪৮
করোনা
ছবি : সংগৃহীত

১৯৯৭ সালে কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলার ফোকাল থিম ছিল ‘রিপাবলিক অব ফ্রান্স’। এজন্য খুব সঙ্গত কারণেই মেলার উদ্বোধনে আনা হয় সে সময়ের ফ্রান্স তথা সারা বিশ্বের সবচেয়ে নামকরা দার্শনিক জ্যাক দারিদা (১৯৩০-২০০৪)-কে। মেলা শুরু হওয়ার পর ভয়ানক এক অগ্নিকাণ্ডে সব ভস্মীভূত হয়ে গেলে ক’দিন বাদে ঠিকঠাক করে পুনরায় সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এসময় কবি আনন্দ শংকর রায় দারুণ এক সরস মন্তব্য করেন, “Since we do not believe in deconstruction, we have been able to reconstruct the fair”। কবি আনন্দ শংকর তার এই রসিকতা দিয়ে কী বোঝাতে চেয়েছিলেন তা বোধকরি কারো বুঝতে অসুবিধা হয়নি। কবির এহেন রসিকতার ভেতর একটা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত আছে। এই বিশ্বখ্যাত দার্শনিক কিন্তু মোটেও সমালোচনা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। ২০০৪ সালের ১১ অক্টোবর সোমবার দ্যা গার্ডিয়ান পত্রিকা তাঁর মৃত্যুর খবর নিয়ে এক নিবন্ধ ছাপে, সাথে ছাপে তাঁর একটা বড় ছবি। ছবির নিচে লেখা ছিল, “জ্যাক দারিদাঃ গভীর এক চিন্তক নাকি সত্য চোর?”

যাই হোক, কবি আনন্দ শংকর আসলে ইঙ্গিত করেছিলেন উত্তর-আধুনিক চিন্তকদের অগ্রদূত ফরাসী দার্শনিক জ্যাক দারিদাকে, যিনি সারা বিশ্বে শুধু একটামাত্র দার্শনিক ভাবনা দিয়ে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন আর সেটা হলো তাঁর ডিকন্সট্রাকশান থিওরি যাকে আমরা সবাই বাংলায় বিনির্মাণবাদ নামে জানি। অত্যন্ত দুর্বোধ্য ব্যাখ্যার আড়ালে বিনির্মাণবাদ বলতে গেলে সাধারণের কাছে বড্ড অচ্ছুৎ হয়ে আছে বিশেষ করে ফরাসী ভাষার প্রবেশাধিকার সব জায়গায় সমান না হওয়ার কারণে বাঙ্গালির কাছে তো বটেই অনেক ভাষায় এর মর্মবাণী এখনও বেশ ঘোলাটে। তবে শুরুতেই বলে রাখি, বিনির্মাণবাদ হলো আপেক্ষিক সংশয়বাদী একটা ধারা যা কিনা ফেড্রিক নিটসের হাত ধরে ১৯৬০ এর দশকে দারিদার কাছে এসে পরিপুষ্ট হয়েছে। সাহিত্য বা মানুষের চিন্তার ক্ষেত্রে বিনির্মাণবাদ একটা নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে। তিনি বলতে চেয়েছেন, আমরা একটা নির্দিষ্ট পরিসরে সুনির্দিষ্টভাবে ভাষা ব্যবহার করি চিন্তার জগতকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। আর এক্ষেত্রে কোন বিষয়ের লিখিত ও উপলদ্ধি-র মাঝে প্রায়শ ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ থাকে। কাজেই কোন একটা টেক্সট পড়া দরকার টেক্সট হিসেবে। তাঁর বিনির্মাণবাদের মূলসূত্র তাই, “টেক্সট বা পাঠ প্রকৃতির বাইরে কিছু নেই”। আমরা এই ছোট্ট পরিসরে দারিদার এই নতুন দার্শনিক তত্ত্বের ব্যখ্যা নিয়ে আলোচনা করবো এবং দর্শন, সাহিত্য, সামাজিক বিজ্ঞান, ধর্ম, এবং ইতিহাসের ওপর এর প্রভাব কতো গভীরে তা একটু তলিয়ে দেখার সুযোগ পাবো। তার আগে যে সামাজিক ও দার্শনিক বাস্তবতার মধ্যে দারিদার এই তত্ব আত্মপ্রকাশ করেছিলো তার সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে দু’চার কথা বলা দরকার।

মানুষের আবিষ্কারের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে তাৎপর্যময় বিষয় হলো ভাষা। কারণ ভাষা ছাড়া মানব সমাজ অর্থহীন। অবশ্য রবিনসন ক্রুসোর মতো ২৮ বছর জনশুন্য দ্বীপান্তরে থাকলে হয়তো ভাষার দরকার হতো না! কিন্তু আমরা তো সমাজে বাস করি। চাল, ডাল, তেল-নুন, পড়ালেখা, লোক- লৌকিকতা আর টাকা উপায়ের জন্য মানুষের সাথে কথা বলতেই হয়। ভাষার দায়িত্ব নিজেকে অন্যের কাছে বোঝানো; অন্যের সাথে যোগাযোগ করার উপায় ভাষা ছাড়া কিছু নেই, তা সে যে ভাষায় হোক--লিখিত, কথ্য বা ইঙ্গিত-ইশারা। ভাষা দিয়ে আমরা বই পড়ি, গান গায়, দোকানে গিয়ে জিনিস কিনি, এটা দাও, সেটা দাও। ক্রিকেট আম্পেয়ার দু’হাত ওপরে তুললেই নিশ্চিত হই “ছয়” হয়ে গেছে। রাস্তায় লালাবাতি দেখলে গাড়ি থামিয়ে ফেলি। ভাষা দিয়ে ভালোবাসা প্রকাশ করি, আবার ভাষা দিয়ে বকাও দিই। কাজেই ভাষা যেন মানব মনের একটা বিচ্ছেদহীন ব্রিজ, যার ওপর দিয়ে আমরা পার হই। সবকিছু অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে, “জ্বলে ওঠে আলো, পুবে-পশ্চিমে”।

কিন্তু এটা ঠিক, যে ভাষা দিয়ে আমরা সবকিছু করি তা যদি একটু গড়বড় হয়, তাহলে আমরা তার মানে বুঝতে পারিনে। যেমন দু’বন্ধুর ভেতর কেও যদি বলে, “আমরা দু’জন একে অন্যের থেকে দুই বছরের বড়”, তাহলে আমরা কী বুঝি? অথবা কেও যদি বলে, “আমি গতকাল রাজধানী যাবো”, তাহলেইবা কি বুঝবো? সুতরাং, ভাষা যদি অর্থপূর্ণ হতে হয় অর্থাৎ যা বলছি তা ঠিকঠাক অন্যের কাছে পৌছাতে হয় তাহলে তার প্রথম শর্ত হলো, তাকে অবশ্যই ব্যাকরণের বিধি মানতেই হবে। অন্য শর্ত হলো, যা বোঝাচ্ছি তা হতে হবে পরিষ্কার, দ্ব্যর্থহীন, সোজাসাপ্টা, আর সম্পূর্ণ রেফারেনশিয়াল মূলক। যেমন, ছোট শিশুকে কোলে নিয়ে বলি, ঐ দেখ চাঁদ! চাঁদ বললে চাঁদের একটা অবয়বকে দেখাতে হয়, পাথর কিম্বা ময়না পাখি বললে একটা বস্তু বা প্রানিকে নির্দেশ করে ইত্যাদি ইত্যাদি। ভাষার এই ধরণের কাঠামোগত পরিণতি ১৯২০ এর দশকে রাসেল- ভিটগেন্সটাইনের যৌক্তিক পরমানুবাদের ভেতর প্রকাশিত হয়েছে। ভাষা যেন আমাদের বাস্তব জগতের প্রতিচ্ছবি। প্রতিটা ঘটনার (fact) থাকে ঠিক অনুরূপ একটা ভাষা।ভাষা আর ঘটনা যেন একে অন্যের পরিপূরক, এক সুতোয় গাঁথা মাণিকজোড়! এই পৃথিবীটা হলো ঘটনার সমষ্টি। ভিটগেন্সটাইনের বিখ্যাত বই ট্রাকটেটাস লজিকো-ফিলসফিক্যাস এই দার্শনিক ধারার এক জীবন্ত বাইবেল।

তবে, এই গাঁটছড়া বাদে কি ভাষা হয় না? হয়, অবশ্যই হয়। মনে আছে না সেই ছোটবেলায় পড়েছিলাম সুকুমার রায়ের “খিচুড়ি”—“হাঁস ছিল সোজারুও (ব্যাকরণ মানি না)/ হয়ে গেলো ‘হাঁসজারু’ কেমনে তা জানিনা”? অর্থহীন দম ফাটানো হাসি ছাড়া এর অন্য কোন মানে নেই! এ নিয়ে জটিলতা আর মারাত্মক ঝামেলাও তৈরি হয়। যেমন, রবিঠাকুর যখন বললেন “প্রহর শেষের রাঙা আলোয় সেদিন চৈত্র মাস, তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ”, অথবা জীবনানন্দ দাস যখন বললেন, “পথে চলে পারে-পারাপারে/ উপেক্ষা করিতে চাই তারে/ মড়ার খুলির মতো ধ’রে/ আছাড় মারিতে চাই, জীবন্ত মাথার/ মতো ঘোরে”(বোধ)—তখন ভীষণ এক অস্পষ্টতার বোধ জন্ম নেয়, নয় কি? বিতর্ক হয় সেখানেই। দর্শন কি এ ধরণের হেঁয়ালি বা উপমার আকর? দর্শন কি রূপক ভাষার আড়ালে ঢেকে রাখা সত্যের অনির্বচনীয় মাধুর্য? না, অন্তত সমকালীন বিশ্লেষণী দার্শনিকরা তা বলেন না। এজন্য বিশ শতকের কিছু দার্শনিক বললেন, কোন ভাষা অর্থপূর্ণ আর কোনটা অর্থহীন সেটা ঠিক করা জরুরী অর্থাৎ ভাষার জ্ঞানজ মূল্য নির্ধারণের জন্য দরকার এবং তার জন্য প্রয়োজন এর চুলচেরা বিশ্লেষণ। সাথে সাথে তাঁরা বললেন, দর্শনের কাজ হচ্ছে শুধু ভাষার বিশ্লেষণ। সেই প্রাচীন গ্রীক দর্শন থেকে শুরু হয়ে আজ অবধি ভাববাদীরা নিজেদের মতো করে ভাষা ব্যবহার করে মানুষের সরল মনের ওপর আধিবিদ্যক প্রলেপ দিয়ে ইমোশনাল ব্লাক মেইল করে চলেছেন। তাই আমরা নির্বিচারে মনের মাধুরী মিশিয়ে যেসব ভাষা ব্যবহার করে থাকি তার যদিও একটা আবেগঘন মূল্য আছে তবু এর জ্ঞানজ মূল্য নেই। দর্শনের কাজ জ্ঞানজ মূল্যের অনুসন্ধান। কারণ দর্শন মানেই জ্ঞান। এঁদেরকে আমরা বিশ্লেষণী দার্শনিক নামে চিনি। ফ্রেগে, রাসেল, ভিটগেন্সটাইন, ম্যুর থেকে শুরু করে বিশ শতকের অনেক দার্শনিক এই বিশ্লেষণী দর্শনের নানারকম চড়াই উৎরাই এর সাথে জড়িত। এতকাল দার্শনিকদের ছদ্মবেশ ধারণ করে অধিবিদ, থিওলজিস্ট আর ভাববাদীরা ভাষার যথেচ্ছ অপব্যবহার করে জ্ঞানের পরিবেশকে ভারাক্রান্ত করে তুলেছে। বিশ্লেষণী দার্শনিকরা জোরের সাথে মন্তব্য করেছেন, দর্শন থেকে এই সব আবর্জনা বাতিল ঝুড়িতে ফেলে দিতে হবে। বিখ্যাত স্কটিশ দার্শনিক ডেভিড হিউম An Essay Concerning Human Understanding বইতে ভীষণ এক স্পর্শকাতর কথা বললেন, বললেন যেসব ভাষা (বাক্য) গণিত-যুক্তিবিজ্ঞান অথবা প্রাকৃতিক বা সামাজিক বিজ্ঞানে আমরা ব্যবহার করি, তা বাদে যা কিছু আছে সে গুলোকে আগুনে পুড়িয়ে দেও, কারণ সেগুলো অর্থহীন বাগাড়ম্বর আর কথার ফুলঝুরি ছাড়া কিছু না। তিনি এর ভেতর দিয়ে অধিবিদ্যা, নীতিবিদ্যা, কবিতার প্রতি আঙ্গুল তোলেন। আর অবশ্যই আঙ্গুল তোলেন থিওলজির দিকে। পরবর্তীতে যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদীরা ভাষার এই অর্থপূর্ণতা নিয়ে দারুণ এক দার্শনিক আন্দোলন গড়ে তোলেন। যখন এর আন্দোলন ইউরোপে তুঙ্গে তখন দারিদার জন্ম হয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা যে ভাষা ব্যবহার করি বা যা বলে থাকি তার অর্থ কি সুনির্দিষ্ট? একটাই কি তার মানে? যদি বলি, “তার মতো ভালো মানুষ আর নেই”। তাহলে পরিষ্কার যে সেই সবচেয়ে ভালো মানুষ। কিন্তু যদি ইঙ্গিত করি, “হুম, তার মতো ভালমানুষ নেই’! শব্দগুলো একই হলেও দ্বিতীয় বাক্যটিতে একটা শ্লেষ্মাত্বক ইঙ্গিত আছে। তাহলে নিশ্চিত যে আমরা বাক্য এক হলেও তার মানে এক রকম নাও হতে পারে। যে বই ২০ বছর আগে পড়েছি সেটা যা বুঝেছিলাম এখন পড়লে নিশ্চিত অন্যরকম বোধ তৈরি হবে। আবার কয়েকদিন পর যে আজকের বোধেই আটকে থাকবো এমন গ্যারান্টি কোথায়? ঠিক পঁচিশ বছর আগে আমি নিজে যখন আলবেয়ার কামুর আউটসাইডার পড়ি তখন আমার এক ধরণের বোধ হয়েছিল, এই সেদিন হলো আরেকটা। আলবেয়ার কামুকে নিয়ে আমার পূর্ববর্তী লেখায় এর বিশদ বিবরণ দিয়েছি। ভাবনার এই আপেক্ষিকতা থেকে ভাষার যে নতুন বোধ তৈরি হয়েছে সেটাই আমরা বিনির্মাণতত্ব বলে জানি। আর যাকে ঘিরে এই তত্বের এক নতুন প্যারাডাইম গড়ে উঠেছে তিনিই উত্তর-আধুনিক যুগের সবচেয়ে আলোচিত ও দুর্বোধ্য দার্শনিক হিসেবে পরিচিত জ্যাক দারিদা। একপাশে বলে রাখি, দারিদার আগে অস্ট্রিয়ান দার্শনিক ভিটগেন্সটাইন ভাষার বহুমাত্রিক অর্থের বিষয়টা তাঁর ইনভেস্টিগেশন-এ বলে দিয়েছিলেন। সময় পেলে সেই কথায় আসব। তার আগে দেখে নেব দারিদার পেছনের কথা।

১৯৩০ সালের ১৫ জুলাই আলজেরিয়ার এল বিয়ারে জ্যাকুয়েস দারিদা জন্ম গ্রহণ করেন এক ইহুদী পরিবারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু এবং নিজের দেশ আলজেরিয়ার ফরাসী উপনিবেশ থেকে মুক্ত হওয়ার জাতীয়তাবাদী আন্দোলন—এই দুই বৈশ্বিক ভু-রাজনৈতিক টানাপড়েনের মাঝে দারিদা বড় হতে থাকেন। একদিকে মার্ক্সবাদ, অন্যদিকে নিজের দেশের অস্তিত্ববাদ, ক্লাসিক্যাল জার্মান ভাববাদ, এবং উত্তরাধুনিক সাহিত্য সমালোচনা ইত্যাদির এক বহুমুখী মিশ্রণের ভেতর দিয়ে দারিদার দার্শনিক মনন গড়ে ওঠে। দারিদার ওপর কিঞ্চিত হলেও জ্যাঁ-পল-সার্ত, আলবেয়ার কামু, মিশেল ফুকো ও অবশ্যই ফেড্রিক নিটসের প্রভাব ছিল। প্রভাব বলতে সাহিত্য, রাজনীতি, সংস্কৃতি, ভাষা, এবং মানব মনের বিচিত্র অনুভূতির এক পাঁচমিশালী মিশ্রণ তাঁর দর্শন-সাহিত্য-রাজনৈতিক মননের ওপর কাজ করে। ১৯ বছর পর ১৯৪৯ সালে তিনি ফ্রান্সে আসেন। ফ্রান্সের বিখ্যাত স্কুল École Normale Supérieure এ ভর্তি হন যেখানে ফ্রান্সের বিখ্যাত মানুষগুলো পড়াশোনা করেছেন। এ ছাড়া তিনি সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিষয়ে পড়েন। ১৯৫৬-৫৭ সালে হাবার্ডে তিনি স্কলারশিপ পান। ষাটের দশকে তিনিই ছিলেন তরুণ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে একমাত্র যিনি সে সময়ের সবচেয়ে নামকরা জার্নাল Tel Quel এ লিখতেন। দারিদা বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন যার মধ্যে আছে, জন হপকিংস বিশ্ববিদ্যালয়, ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, ইত্যাদি। তিনি তাঁর উত্তরসূরি জ্যাঁ-পল- সার্তের মতই ছিলেন বিশ্বখ্যাত সেলেব্রিটি। ১৯৬০ এর দশকের থেকে শুরু করে তিনি বিস্তর লিখেছেন, তবে বেশীরভাগ বিষয়ই ছিল অত্যন্ত দুর্বোধ্য আর দার্শনিক জটিলতায় পরিপূর্ণ। জ্যাক দারিদা যেখানে জন্মগ্রহণ করেন সেখানে তিন ধরণের ধর্মীয় পরিমণ্ডলে তিনি বড় হন, ইহুদী, খ্রিষ্টান আর ইসলাম। তিনটা ধর্মই সত্যের কথা বলছে অথচ তিনটা ধর্মই নিজেদের মধ্যে সংঘাতে লিপ্ত হচ্ছে। ধর্ম যেখানে অভিন্ন সত্য প্রচার করে তাই কি করে তারা সঙ্ঘাতে জড়িয়ে পড়ে, এটা তাঁর মনে প্রশ্ন জেগেছিল। ১৯৬৭ সালে দারিদার তিনটি বই প্রকাশিত হয়, Speech and Phenomena and other Essays on Husserl’s Theory of Signs, Of Grammatology, Writing and Difference । এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ও পঠিত বই Of Grammatology যেটা ফরাসী ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক যার ফলে সারা পৃথিবীতে দারিদা পরিচিত হয়ে ওঠেন।

বিনির্মাণবাদ কী?

বিনির্মাণবাদ হলো টেক্সট এবং তার অর্থের মধ্যে সম্পর্ক বোঝার একটা পদ্ধতি, বিশেষ করে দর্শন ও সাহিত্য সম্পর্কিত ভাষার একটা বিচারমূলক অনুসন্ধান যার ভেতর দিয়ে ভাষার অভ্যন্তরীণ ও ধারণাগত প্রকৃতির অবয়ব বোঝার চেষ্টা করা হয়। তাছাড়া অর্থ সম্পর্কিত গুণগত মান এবং যা বলা হয়নি সেসব না বলা বাণীর অর্থ যাচাইয়ের এক পদ্ধতির কাজে বিনির্মাণ শব্দটা ব্যবহার করা হয়। এটা কেন আমরা করবো? দারিদা বলছেন, ভাষার ইন্টারনাল লজিক এবং যে কোন টেক্সট অথবা অভিসন্দর্ভ বোঝার ক্ষেত্রে এর মাঝে যে বৈপরীত্য বা বিরুদ্ধ চিন্তা লুকিয়ে আছে সেটা আমাদের বুঝতে সাহায্য করবে, সেটা হতে পারে আইন, বিচার, রাজনীতি, অর্থনীতি, বিজ্ঞান এমনকি ধর্মীয় ভাবনাও। স্মরণ রাখতে হবে, বিনির্মাণবাদ হলো পোষ্ট-স্ট্রাকচারলিজমের সরাসরি একটা উপজাত। আবার পোষ্ট-স্ট্রাকচারলিজম হলো স্ট্রাকচারলিজমেরই বিরুদ্ধ মত। এর প্রেক্ষিতে স্ট্রাকচারলিজম একটু বোঝা আবশ্যক।

অবয়ববাদ বা স্ট্রাকচারলিজম মনে করে মানুষের সামগ্রিক আচরণ বুঝতে হবে যে সমাজে তারা বেড়ে ওঠে তার সামাজিক রীতিনীতি অর্থাৎ তার একটা প্রতিষ্ঠিত কাঠামোর আলোকে। মানুষ কোন সময় একক নয় বা বিচ্ছিন্নভাবে আলাদা করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। তারা এই সমাজ থেকেই উদ্ভুত যেহেতু সমাজের ভেতরে থেকেই তারা জন্ম নেয়। সোজা কথায়, চিহ্ন, চিহ্নায়ক এবং চিহ্নিতের মাঝের ত্রিমাত্রিক সম্পর্কই হলো স্ট্রাকচারলিজমের মূলকথা। আধিভৌতিক বিষয় চিন্তার বিষয়বস্তু হতে পারেনা। গাছ শব্দটা উচ্চারণ করলে আমাদের মনের ভেতর গাছের একটা অবয়ব মনে আসে। অর্থাৎ গাছ কিছুতেই ফুল, পাখি বা প্রজাপ্রতি নয়। গাছ গাছই। এখানে গাছের ‘গা’ এর বদলে ‘মা’ দিলে সম্পূর্ণ অর্থটা ভেঙে পড়ে। তাই গাছ হলো চিহ্নায়ক বা signifier, আর এই শব্দের বদলে অর্থবোধ হলো চিহ্নিত বা signified। ঠিক এটা যেন প্লেটোর ধারণা তত্বের বিপরীত। ঘোড়া বললে প্লেটো যেমন ভেবেছিলেন ঘোড়ার একটা আদর্শ রূপ, যেন স্বর্গ থেকে এসব ঘোড়ার ডামি এসে লাল, সাদা, কালো ঘোড়াগুলো ঘুরাঘুরি করছে। স্ট্রাকচারলিজম প্লেটোর এধরণের উন্নাসিক বক্তব্য বাতিল করে দেয়। এর ভেতর ছোট করে বলে রাখি, পোষ্ট-স্ট্রাকচারলিজম স্ট্রাকচারলিজমের বিপরীত অবস্থানে থাকলেও সেটা কিন্তু প্লেটোনিজমের সম্পূর্ণ বিপরীত মতবাদ। প্লেটোর কাছে অবভাস থেকে সত্তার গুরুত্ব বেশি। কিন্তু বিনির্মাণবাদ বলছে ঠিক তার উল্টো কথা। তুমি ছিলে অমূর্ত, ছিলে ভাবনার পেছনে। যদি প্রকাশিত না হতে তাহলে জানতাম কী করে? কবি গুরু যেমনটি বলে ফেললেন, “তাই তোমার আনন্দ আমার 'পর/ তুমি তাই এসেছ নীচে।/ আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর,/ তোমার প্রেম হত যে মিছে।/ আমায় নিয়ে মেলেছ এই মেলা,/ আমার হিয়ায় চলছে রসের খেলা,/ মোর জীবনে বিচিত্ররূপ ধরে/ তোমার ইচ্ছা তরঙ্গিছে”। অর্থাৎ বিনির্মাণবাদ বলল, তোমার মূর্তিই আমার কাছে অমূর্তি থেকে অধিক গুরুত্ববহ। পোষ্ট-স্ট্রাকচারলিজম বিশেষ করে বিনির্মাণবাদে এই বিষয়টাকে বলে Logocentrism। চিহ্নায়ক ও চিহ্নিতের মাঝে এই অবধারিত সম্পর্ক একটা দ্বিবাচনিক বিপ্রতীপ(bionary opposition) এর মধ্যে আমাদের আটকে রাখে। যেমন ‘গাছ’ (‘+’ গাছ), নয় ‘ফুল’ (‘-’ গাছ) অথবা ‘সাদা’ (‘+’ সাদা), নয় ‘কালো’(‘-’ সাদা)। কিন্তু এটা করলে শব্দের বহুমাত্রিকতা সর্বাংশে নষ্ট হয়। এখানে উল্লেখ করতে হবে, স্ট্রাকচারলিজম যেখানে অর্থ-পদ্ধতি নিয়ে ব্যস্ত থাকে সেখানে পোষ্ট-স্ট্রাকচারলিজম ভাবে মানুষের পদ্ধতিগত চিন্তা নিয়ে। ১৯৭০ এর দশকে পোষ্ট-স্ট্রাকচারলিজম ভাষা এবং সাহিত্যতত্বের মধ্যে এমন একটা সম্প্রত্যয়গত ধারণার জন্ম দিয়েছে যার প্রেক্ষিতে পূর্বতন স্ট্রাকচারলিজমের বিদায় হয়। সক্রেটিস থেকে শুরু করে রুশো অবধি সবাই মনে করতেন মানুষের বাচনিক ক্রিয়া লিখিত থেকে নিষ্কলঙ্ক এবং অগ্রাধিকারী। দারিদা বলেছেন, এ ধরণের ভাবনা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক কারণ রুশো নিজেই Confession লিখে নিজের সবকথা লিপিবদ্ধ করে গেছেন। নামকরা সুইস ভাষাতাত্বিক ফারদিন্যান্ড দ্য স্যুসর (১৮৫৭-১৯১৩) বাচনকে লিখনের ওপর স্থান দিয়েছিলেন। তিনি স্ট্রাকচারলিস্ট-দের মতো চিহ্ন, চিহ্নায়ক, চিহ্নিতের ত্রিমাত্রিক সম্পর্কের কথা দারুণভাবে প্রচার করেছিলেন। তিনি এটাকে বলেছিলেন discourse। ফারদিন্যান্ড দ্য স্যুসরের এই খেয়ালী ভাবনার ভেতর রয়ে গেছে একটা বড় ফাঁক। স্যুসরের মনে হয়েছে পাখি বললে কিছুতেই বিড়াল, ঝিঁঝিঁপোকা, গরু কিম্বা শিম্পাজি বোঝাবে না, একটা মাত্র প্রাণীই বোঝাবে, কিন্তু দারিদা বললেন পাখি বললে কি একটা মাত্র পাখিই বোঝাবে? না। পাখি বললে আমার সামনে এসে হাজির হবে হরেক রকম পাখি। ময়না, কাকাতুয়া, চড়ুই আরও কত্ত কী! এদের ভেতর পার্থক্য বোঝাতে দারিদা একটা শব্দ উচ্চারণ করলেন, ডিফারন্স(DIFFERANCE)। ডিফারন্স বহু বলা না বলা বাণীর ধারক। যেমন ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ শব্দটা পৃথিবীর সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারক সেখানে কেম্বিজ, অক্সফোর্ড, গ্রিন উইচ থেকে শুরু হয়ে মিরপুরের গ্রিন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বোঝায়। তাই দারিদা বলছেন, কোন একটা চিহ্নকে বিকল্পহীন মনে করার কিছু নেই।

সম্ভবত একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা আরো বেশি পরিষ্কার হবে। ধরুন আপনি একটা অত্যন্ত ব্যয়বহুল সিনেমা বানাচ্ছেন। বিপুল টাকা বিনিয়োগ করেছেন। আপনার পরিচালক দারুণভাবে কাজও করছে। খুব নামকরা পরিচালক। অর্ধেক কাজ শেষ। হঠাৎ একদিন আপনার পরিচালক মারা গেলো। আপনি সিদ্ধান্ত নিলেন, নতুন এক পরিচালক দিয়ে বাকি কাজটা শেষ করবেন। অনেক ভালো ভালো পরিচালকদের থেকে একজনকে বেঁছে নিলেন। সে কাজটা শেষ করলো। কিন্তু এটা সত্যি যে আপনি যদি প্রতিটা পরিচালককে আলাদা আলাদা ভাবে নির্বাচন করতেন তাহলে প্রত্যেকেই তাদের নিজেদের মতো ভিন্ন ভিন্ন সমাপ্তি টানত। এখানেই দারিদার বিনির্মাণবাদ। প্রতিটা মানুষ আলাদা, আলাদা রুচি, আলাদা ব্যক্তিত্ব, আলাদা জানাশোনা, অর্থাৎ আলাদা দর্শন। আপনি যখন দোকানে কাপড় কিনতে যান, সেখানে বিভিন্ন রঙের, বিভিন্ন কাটিং-এর কাপড়-চোপড় আছে। কিছু কাপড়ের রঙ দেখলে আপনার মনে হবে, এ ধরণের রঙের কাপড় কে কিনবে? এতো অরুচিশীল মানুষও কি আছে? দোকানি নিশ্চয় বলবে, অবশ্যই আছে। এসব কাপড় কেনার বহু খরিদ্দার আছে। তাহলে এক জনের কাছে যেটা অরুচিশীল অন্যের কাছে সেটা দারুন পছন্দের। কাজেই আমরা কিছুতেই অন্যের পছন্দকে ভালো বা মন্দ বলতে পারিনা। বিবেচনায় আনতে হবে, কে এই মূল্যায়নটা করছে? যেন রবিঠাকুরের কথায়, “যাহা-কিছু হেরি চোখে কিছু তুচ্ছ নয়,/ সকলি দুর্লভ ব’লে আজি মনে হয়”।

দারিদার বিনির্মাণতত্বের সারৎসার এক জায়গায় করলে দাঁড়ায়:

ক) বিনির্মাণতত্ব বহুরৈখিক মাত্রার ফলাফল; খ) আসল সত্য জানা অসম্ভব; গ) প্রতিটা বাক্যের একাধিক অর্থ থাকতে পারে এবং সেগুলো পরস্পর বিরোধী হতে পারে; ঘ) এই পরস্পর বিরোধী মাত্রাগুলো একজায়গায় এনে সরল কিছু করার সুযোগ নেই; ঙ) ব্যখ্যামূলক পাঠের মধ্যে আছে ধাঁধা যেগুলোকে বলে অ্যাপরিয়া, এই অ্যাপরিয়াই বিনির্মাণবাদের মূল প্রেরণা। J.W. Bertens তাঁর Literary Theory: Basics. গ্রন্থে দারিদার বিনির্মাণতত্বের একটা সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরেন। তিনি বলছেন, দারিদা তাঁর বিনির্মাণতত্বে বলছেন, ভাষা প্রকৃতিগতভাবে অনির্ভরযোগ্য ব্যাপার। একটা শব্দ প্রকৃতপক্ষে যাকে রেফার করে সেটা কিন্তু ফলত শব্দের সাথে শব্দের পার্থক্য, সরাসরি কোন নির্দেশক নয়। কাজেই এই শব্দগুলো একটা ভাষিক পদ্ধতির মধ্যে কাজ করে, যা কখনই বাস্তব জগতকে স্পর্শ করে না। বাস্তবতা ভাষিক প্রকৃতি নির্ধারণ করে। একটা শব্দের থেকে আরেকটা শব্দের যে পার্থক্য যার প্রেক্ষিতে ঐ শব্দটা স্বতন্ত্র হয় তাকে নিয়ে আমাদের ভাবতে হয়। তবে বিনির্মাণ তত্বের একটা বড় ফলাফল হলো, এই তত্ব মনে করে কোন শব্দের অর্থ কোন সময়ই একটা সময়ের ফ্রেমে আবদ্ধ নয়, যার প্রেক্ষিতে এটা চলমান ও পরিবর্তনশীল। দারিদা এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, বাচন প্রক্রিয়ায় কোন পারমাণবিক বিভাজন নেই (There is no atom: Dialanguages: in Points … Interviews, 1974-94)। এর অর্থ আমরা ভাষা দিয়ে যা প্রকাশ করি তার সবটুকু বিভাজন করা সম্ভব। জীবন কী? জীবন অনেক কিছুর সমন্বয়, সম্ভবত বহু মাত্রার এক সমন্বিত দ্যোতনা। কবি রণজিৎ দাসের এক কবিতা দিয়ে দারিদার বিনির্মাণতত্বকে বোঝাতে চেয়েছেন দারিদা বিশেষজ্ঞ তপোধির ভট্টাচার্য তার “জাক দেরিদা তাঁর বিনির্মাণ” গ্রন্থে।

“যা কিছু বিষণ্ণ করে, যেমন সূর্যাস্ত, নারী, গির্জা ও গোলাপ যা কিছু বিষণ্ণ করে, যেমন উৎসব, চাঁদ, নৌকো ও সমুদ্র যা কিছু বিষণ্ণ করে, যেমন বিগ্রহ, ধুপ, মুদ্রা, পূজারিণী যা কিছু বিষণ্ণ করে, যেমন পাহাড়, মেঘ, শালবন, চিঠি ও চুম্বন যা কিছু বিষণ্ণ করে, গরম ভাত, হাতপাখা, গন্ধলেবু, আদিবাসী গ্রাম যা কিছু বিষণ্ণ করে, যেমন সার্কাস, তাঁবু, ফেরিঘাট, পাগলের হাসি যা কিছু বিষণ্ণ করে, যেমন মায়ের ছবি, ডাকঘর, শিলাবৃষ্টি, মাঝিদের গান যা কিছু বিষণ্ণ করে, যেমন সমস্তই, হে জীবন, তোমার আনন্দ-অভিধান”। [‘যা কিছু বিষণ্ণ করে’, সন্ধ্যার পাগল, রণজিৎ দাস]

কবির এই বিচিত্র ও ভিন্ন ভিন্ন অনুভবের ভেতর দিয়ে জীবনের নানা প্রকরণের উন্মেষগুলো প্রকাশিত হয়েছে নানা রঙ্গে, নানা ঢঙে। আসলেই তো জীবনের বিচিত্র রাগঃ দুঃখ, মৃত্যু, বিরহ, শান্তি, আনন্দ –এসবই তো জীবনের অংশ। কবিগুরু তো বললেন, “তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা, বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে”॥ জীবনের এই বহুমাত্রিকতা, বহুঅনুভবতা আর নিত্য পরিবর্তনশীলতাই তো বিনির্মাণতত্বের সারৎসার। অধ্যাপক তপোধির ঠিকই বলেছেন, “সমস্ত অনুষঙ্গ মনে রেখে লেখা যায়, দেরিদার বিনির্মাণপন্থা আসলে সমস্ত বাচনিক, প্রতীতিগত (ধারণা সম্বন্ধীয়), মনস্ত্বাতিক, নান্দনিক, ঐতিহাসিক, নৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও পাঠকৃতি বিষয়ক দৃশ্য–প্রপঞ্চ- পরিস্থিতিকে আমুল আলোড়িত –রূপান্তরিত- পুনঃস্থাপিত করার কৃতকৌশল”(পৃ. ১২৬)।

দারিদা ও ভিটগেন্সটাইন

দারিদার সাথে ভিটগেন্সটাইনের মাঝে কিছু পার্থক্য থাকলেও অনেক মিল আছে বলে অনেকেই মনে করেন। ভিটগেন্সটাইন ১৯৩০ এর পরের থেকে ধীরে ধীরে আগের অবস্থান থেকে সরে আসেন। আগের অবস্থান ছিল শব্দ ও বস্তুর ভেতর এক কড়া শাসনের নিয়ম, কিন্তু ভিটগেন্সটাইন পরে বোঝা শুরু করলেন, শব্দ হচ্ছে একটা খেলা। কেমন খেলা? সমস্ত খেলার নিয়মই আলাদা আলাদা। ফুটবল, হকি, ক্রিকেট, দাবা ইত্যাদি ইত্যাদি। কোন নিয়মের সাথে কোন নিয়মের মিল নেই। তারপরেও খেলা। এটা একটা পরিবারের সদস্যের মতো, কারো সাথে কারো মিল না থাকার পরেও তারা একই পরিবারের সদস্য। ভাষা প্রকৃতপক্ষে এরকম। কোন একটা শব্দ দিয়ে আমরা কি বুঝায় সেটা নির্ভর করে তার ব্যবহারের ওপর, তার মনোভাবের ওপর। একই শব্দ একেক সময়ে একেক অর্থ প্রকাশ করতে পারে, অর্থাৎ এটা নির্ভর করে কী পরিস্থিতিতে, কোন অবস্থায় শব্দটা ব্যবহৃত হচ্ছে। শব্দ ব্যবহারের এই বহু মাত্রিকতা যেন জীবনের নানা রঙ্গে রঞ্জিত। ইউনিভার্সিটি অব আলাবামার অধ্যাপক মার্ক রল্যান্ডস তাঁর চমৎকার প্রবন্ধে বলেছেন, “The context-sensitiviy of criterion entails the linguistic signs for Wittgenstien are also characterised by the notion of trace and difference”। অর্থাৎ ভিটগেন্সটাইন যে শব্দ ব্যবহারের পরিবেশ ও অবস্থার কথা বলেছিলেন তার সাথে দারিদার DIFFERANCE মিল আছে।

বিশ শতক জুড়ে সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, শিল্পকলা, আইন ইত্যাদি নতুন করে উপলব্দধির জোয়ার এসেছিল, সেই ধারার একটা পালক জুড়ে দিয়েছেন জ্যাক দারিদা। তবে মনে রাখতে হবে, দারিদা শুধু তাঁর বিনির্মাণতত্ব নিয়েই ভাবেননি। ভেবেছেন রাজনীতি, নৈতিকতা, প্রাণীর অধিকার, মানুষের মৃত্যদণ্ড ইত্যাদি ইত্যাদি। দারিদা সারাজীবন একজন মার্ক্সসিস্ট ছিলেন। অনেক লিখেছেন, অনেক বিতর্ক তৈরি করেছেন, হয়েছেন অনেকের বিরাগভাজন। তিনি প্রায় ৭০ খানা বই লিখেছেন, লিখেছেন অজস্র প্রবন্ধ। ১৯৯২ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর সম্মানসূচক ডিগ্রী প্রদান করে। ভীষণভাবে ক্ষিপ্ত হন অনেকেই। কাগজে বেরোয় তাঁর ব্যাঙ্গ চিত্র। তখন কাগজ-পত্রে তাঁর নাম আসতে থাকে, ছবি ছাপাতে থাকে। খ্যাত-বিখ্যাতের তকমা লাগে গায়ে। ২০০১ সালে তাঁর বছারাধিক কালের বক্তৃতা নিয়ে শেষ লেখা প্রকাশিত হয় ফরাসী ভাষায় Chaque fois unique, la fin du monde শিরনামে যার অর্থ Each time unique, the end of the world। ২০০৪ সালের ৮ অক্টোবর দারিদা মারা যান।

লেখক : সিদ্ধার্থ শংকর জোয়ার্দ্দার, অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

চলমান আলোচিত ঘটনা বা দৃষ্টি আকর্ষণযোগ্য সমসাময়িক বিষয়ে আপনার মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাই, সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইলকরুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড