রহমান মৃধা
আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা ইতিহাসের পণ্ডিত নই। আমি ওষুধ কোম্পানিতে ওষুধ তৈরি এবং এর ম্যানেজমেন্টের ওপর কাজ করেছি। দেশ-বিদেশ ঘুরতে ঘুরতে মাথায় পোকা ঢুকেছে। সে পোকা হলো অজানাকে জানা আর অচেনাকে চেনা। সে সঙ্গে নতুন যা কিছু দেখি তা সবার সঙ্গে শেয়ার করি।
আমার স্ত্রী মারিয়াও ঘুরতে পছন্দ করে। দুজনে মিলে মনের আনন্দে সময় পার করতে মজাও লাগে। আজ রাজবাড়ির আশপাশ দিয়ে ঘুরেছি। আমাদের বর্তমান রাজার নাম কার্ল গুস্তাভ (Carl Gustav xvi)। সুইডেনের প্রথম রাজার নাম অনেকের মতে এরিক সেগেরসেল হলেও (Erik Segersäll, 970–995) আসল রাজা ছিল তার ছেলে উলোফ স্কোটকোনুং (Olof Skötkonung)।
সুইডেনের বর্তমান রাজা কার্ল গুজতাভ হচ্ছেন ১৬ নম্বর রাজা। তার বড় মেয়ে ভিক্টোরিয়া হবেন কার্ল গুজতাভের উত্তরসূরি। কারণ ভিক্টোরিয়া বর্তমান রাজপরিবারের বড় সন্তান। আমার স্টকহোমের বাসা রাজার মেয়ের বাড়ি থেকে বেশি দূরে নয়।
এক্ষেত্রে প্রায়ই রাজবাড়ির আশপাশ দিয়ে চলাফেরা করি। রাজবাড়ির প্রচুর জায়গা দেখে ইচ্ছে হয় যদি সুযোগ থাকত তবে নানা ধরনের গার্ডেনিং করতাম। সুইডেনের ঠাণ্ডা আবহাওয়া গার্ডেনের জন্য উপযোগী নয় বিধায় স্পেনে কিছু জমিসহ একটি সামার হাউজ কেনার শখ হয়েছে। কারণ বাংলাদেশের ফলমূল ও শাকসবজি রোপণ করতে চাই অবসর সময়ে।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে মেয়ের কলেজ শেষ হয়নি। তাকে একা সুইডেনে রেখে যাওয়া ঠিক হবে না। তারপর মারিয়ার কাজ ফেলে সেও হুট করে কোথাও যেতে পারবে না। সেক্ষেত্রে মাথার মধ্যে ভাবনাটি ঘুরপাক খাচ্ছে। এদিকে কিছুদিন আগে শাশুড়ি মারা গেলেন কোভিড-১৯ এ। শ্বশুর তার সুইডেনের স্টকহোম এবং স্পেনের মালাগার বাসা দুইটি নিয়ে একটু ভাবনায় পড়েছেন কীভাবে একা দুই জায়গা সামলাবেন।
আমি আবার বাগান ছাড়া ঘরবাড়ি পছন্দ করি না। তারপর স্টকহোম ছেড়ে সামারে অন্য কোথাও গিয়ে থাকার কথাও ভাবতে পারি না। সামারে সুইডেনের চমৎকার ওয়েদার, প্রকৃতির যে মনোরম রূপ তা ছেড়ে অন্য কোথাও বসবাস করার চিন্তা মাথায় আসে না।
হঠাৎ দেখি রাজা কার্ল গুস্তাভ রাস্তায় হাঁটতে বেরিয়েছেন। সঙ্গে দুইজন সিভিল পোশাকধারী গোয়েন্দা পুলিশ। মুখোমুখি হতেই অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বললাম “শুভদিন প্রিয় রাজা আপনি কেমন আছেন? কী না মজা লাগছে হঠাৎ আপনাকে দেখে। এটা আমাদের সৌভাগ্য বলতে হয়” (Good dag Herr Konugen, hur mår ni? Det är vår äran att få se dig på gatan så här, vilken tur vi har)।
রাজা বললেন তোমরা কেমন আছো? উত্তরে বললাম, খুব ভালো। আরও বললাম, আমরাও কি দূরত্ব বজায় রেখে (কোভিড-১৯ এর কারণে) আপনার সঙ্গে হাঁটতে পারি? রাজা তার দুই দেহরক্ষীর দিকে একটুখানি তাকালেন, তারপর বললেন, ঠিক আছে। রাজার সঙ্গে হাঁটা একটু অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে, যদিও বহুবার এ রাস্তা দিয়ে হেঁটেছি।
কোভিড-১৯ এর আগে রাজার মেয়ে ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে একবার হঠাৎ এভাবেই দেখা হয়েছিল। সেদিন সঙ্গে ছিল আমার বড় ভাই প্রফেসর ড. মান্নান মৃধা। তিনিও বেশ অবাক হয়েছিলেন সেদিন যে, একই রাস্তায় রাজা এবং প্রজার চলাচল, চমৎকার।
যাইহোক আজ ড্রথনিংহোলম (Drottningholm) রাজপ্রাসাদের পাশ দিয়ে রাজার সঙ্গে হাঁটছি। এ কথা সে কথা, হঠাৎ রাজা বললেন, রহমান তুমি আমাদের দেশে এসে দেশের জন্য অনেককিছু করেছ। তোমাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে তোমার পছন্দের কিছু উপহার দিতে চাই। শুনে একটু অবাক হলাম, মারিয়া সঙ্গে সঙ্গে বললো, আমাদের কিছু লাগবে না। তবে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
আমি পড়লাম বিপদে, বউ কেন হঠাৎ কথা বলতে গেল! শেষে আমিও বললাম আমাদের কিছুই লাগবে না। তবে মনে মনে পানির ধারে ছোট্ট একটি বাড়ি এবং সামনে একটু জায়গা চাওয়ার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু তা আর বলা হলো না। শুধু বললাম, আমার অনেকদিনের শখ সুইডেনে বাংলাদেশের মাছ, ফলমূল থেকে শুরু করে শাকসবজি রোপণ করবো।
আমি যখন স্ট্রেংন্যাসে (Strängnäs, স্টকহোমের অদূরে ছোট্ট একটি শহর যেখানে আমি ছয় বছর বাস করেছি) ছিলাম, তখন বাড়িতে মাছ ছাড়া সবকিছুই চাষ করেছি। রাজা শুনে বেশ অবাক হলেন। বললেন বল কী? আমি ছোটবেলার স্মৃতিচারণ করলাম এবং বললাম বাংলাদেশের সেই মধুর ঘটনাগুলো যেমন পলো দিয়ে মাছ ধরা ইত্যাদি।
রাজা শুনে ভীষণভাবে আপ্লুত হয়ে বললেন, এটা তো একটি চমৎকার ভাবনা। তা আমার অনেক বাড়ি পানির ধারে বেশ জায়গা নিয়ে তৈরি। তোমাকে যেকোনো একটি দেবার ব্যবস্থা করবো। তোমার পছন্দ মতো একটি নিয়ে নিও। হঠাৎ অ্যালার্ম বেজে উঠল এবং সেইসঙ্গে বাজিয়ে দিল আমার ঘুম আর স্বপ্নের বারোটা!
সারাদিন ঘোরাঘুরির পর বেশ ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরি। ভ্রমণের সুন্দর অনুভূতিগুলো ঘুমের ঘোরে নতুন করে কালারফুল এবং আনন্দময় হয়ে ওঠে। যাইহোক, ঘুম থেকে উঠে রেডি হয়ে যেতে হবে মারিয়ার বাবার সঙ্গে দেখা করতে। তারপর আজ ঘুরতে যাব ড্রথনিংহোলমে। বলা যায় না রাজার সঙ্গে দেখা হতেও পারে আজ।
সুইডেনের রাস্তাঘাটে হলিউডের তারকাদেরও দেখা মেলে। অনেকে সারাজীবন হলিউডে বসবাস করেও একজন তারকাকে রাস্তায় হাঁটতে দেখেনি। অথচ সুইডেনে এটা কোন ব্যাপারই না। স্বাধীন এবং সত্যিকার গণতন্ত্রের দেশে এসব কোনো ঘটনা নয়।
মনে পড়ে গেল সামছুর রহমানের কবিতা ‘স্বাধীনতা তুমি রবি ঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান’-এর কথা। তিনি জানতেন স্বাধীনতা কী এবং কেমন হওয়া উচিত।
কোভিড-১৯ এর কারণে ছুটির দিনগুলো এবার একটু অন্যরকমভাবে কাটছে। বেশ মজা করে ঘুরছি আর সুইডেনকে নতুন করে হৃদয় দিয়ে দেখছি। একই সঙ্গে ভাবছি কি চমৎকার একটি দেশ; ধনী, গরিব, রাজা, প্রজা বলে কথা নেই সকলেই সব কিছু সমান ভাবে উপভোগ করছে। আহারে এমনটি যে কবে বাংলাদেশ!
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড