• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্বের দার্শনিক ও সামাজিক ভিত্তি

  সিদ্ধার্থ শংকর জোয়ার্দ্দার

১০ জুলাই ২০২০, ১৮:২১
সিদ্ধার্থ শংকর জোয়ার্দ্দার
সিদ্ধার্থ শংকর জোয়ার্দ্দার (ছবি : সংগৃহীত)

দ্যা লাইব্রেরী অব কংগ্রেসের ভাষ্য মতে ১৯০৫ সালটা ছিল ল্যাটিন ভাষায় “অ্যানাস মিরাবিলিস” অর্থাৎ অলৌকিক বছর, যে বছরে আইনস্টাইন জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ.ডি শেষ করেন এবং বিজ্ঞানের ওপর চারটা গবেষণাপত্র লেখেন যার থেকে জন্ম নেয় পদার্থবিজ্ঞানের কালজয়ী কিছু আবিষ্কার। মাত্র ২৬ বছর বয়সে Annalen der Physik নামে এক জার্নালে ঐ গবেষণাপত্রগুলো যখন প্রকাশিত হয় তখন আইনস্টাইন ছিলেন সামান্য এক পেটেন্ট অফিসের কেরানী। চারটা গবেষণা পত্রের প্রথমটা ছিল ফটো-ইলেকট্রিক ইফেক্টের ওপর, যার ফলাফল হিসেবে হাল আমলে আমরা পেয়েছি সৌরশক্তির ব্যবহার; দ্বিতীয়টা ব্রাউনিয়ান গতি সংক্রান্ত যা থেকে আমরা বুঝি জলের ওপর যে ধুলোর মতো এক ধরণের অতি ক্ষুদ্র ডাস্ট এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ায়, সেটা অতি সূক্ষ্ম চলমান আণবিক কণিকার তৈরি, যার ফলশ্রুতিতে ঐ ডাস্টগুলো সামনে পেছনে দোল খায়।

আইনস্টাইনের তৃতীয় গবেষণাপত্রটি ছিল সবচেয়ে কালজয়ী সৃষ্টি যা থেকে জন্ম নিয়েছে থিওরি অব রিলেটিভিটি বা আপেক্ষিকতত্ব। এর শিরোনাম ছিল On the Electrodynamics of Moving Bodies যেটা দেখিয়েছে কীভাবে বিভিন্ন গতিতে চলমান দর্শকের কাছে বস্তুর দৈর্ঘ, ভর আর সময়ের প্রচলিত ধারণাগুলো ভেঙে পড়ে। আলোর বেগে চলোমান বস্তুর সাথে কম গতিশীল বস্তুর এসব রাশিগুলোর পরিমাপে কীভাবে পার্থক্য সৃষ্টি হয়, কতটুকুইবা পার্থক্য হয়। সকল অবস্থায় আলোর গতি ধ্রুবক, এটাও আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতত্বের ফলাফল। এর দুটি প্রধান উপপাদ্য ছিল, ১) সমবেগে চলমান সকল পর্যবেক্ষকের সাপেক্ষে পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মাবলী অভিন্ন, ২) শূন্য মাধ্যমে আলোর গতিবেগ সমস্ত পর্যবেক্ষকের সাপেক্ষে একই এবং তা আলোর উৎসের ও পর্যবেক্ষকের গতির সাথে নিরপেক্ষ।

আইনস্টাইনের এই বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদের ১০ বছর পর স্থান কাল নিয়ে নিউটনের ধারণাকে পাশ কাটিয়ে নতুন এক বিশ্ব-জাগতিক ধারণার জন্ম হয় যা সাধারণ আপেক্ষিকতত্ব নামে পরিচিত। এখানে স্থান কালের পরমত্ব শেষ হয়ে শুরু হয় এক নতুন বাস্তবতা। সাথে সাথে ইউক্লিডের জ্যামিতি বিদায় নিয়ে তৈরি হয় নন-ইউক্লিডিয়ান জ্যামিতি।স্থান কালের ত্রিমাত্রিক বাস্তবতা থেকে স্থান-কালের চতুর্মাত্রিক এক নতুন বিশ্বে পৌছায় মানুষ। কাল হয়ে পড়ে স্থানের অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী। এ যেন সেই কবিতার মতো, “যে কাল পেছনে ছিল, যে কাল সম্মুখে ফিরে আসে”। চতুর্থ পত্রটি ছিল বস্তুর জড়তা ও শক্তির সম্পর্ক বিষয়ক যা থেকে তিনি বস্তুর ভর আর শক্তি সংক্রান্ত কালজয়ী সমীকরণ E = mc2 আবিস্কার করেন। তিনি দেখান শক্তি হলো ভরের সাথে আলোর বেগের বর্গের সমানুপাতিক। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আইনস্টাইনের নতুন দার্শনিক পদার্থবিজ্ঞানের সামাজিক বাস্তবতা কী ছিল? বিশ শতকের শুরুতে পদার্থবিজ্ঞান আর দর্শনে কী পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো যার দরুন এই নতুন দার্শনিক পদার্থবিজ্ঞান জন্ম নিল?

একটা কথা স্মরণ করতে হবে, নতুন এই পদার্থবিজ্ঞান দর্শনের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে, তাই এটাকে বিজ্ঞান কিম্বা বিজ্ঞানের দর্শন বললে বেশি একটা বেমানান হবে না। তবে আগেই মনে করিয়ে দিই, আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতত্ব পদার্থবিজ্ঞানের অতি দুর্বোধ্য বিষয়ের একটা। যেটা আইনস্টাইন নিজেই স্বীকার করেছেন। আইনস্টাইনের একজন বাওগ্রাফার মি গরডোও গ্যাব্রেন্ডাইন লিখেছেন, একবার এক আমেরিকান সাংবাদিক এই মহান পদার্থবিজ্ঞানীকে জিজ্ঞেস করেছিলো, “স্যার, একটা লাইনে আপনি আপনার আপেক্ষিকতত্ব বলুন তো?” আইনস্টাইন উত্তর দিয়েছিলেন, আপেক্ষিক তত্বের ছোট্ট একটা সংজ্ঞা দিতে গেলে অন্তত তিন দিন লাগবে। তিনি এটাও বলেছিলেন গণিত আর পদার্থবিজ্ঞানের ওপর পোক্ত ধারণা না থাকলে আপেক্ষিকতত্ব বোঝা একেবারে অসম্ভব। আসলে অধিকংশ মানুষের কাছে আপেক্ষিকতত্ব ভীষণ রহস্যময়। আইনস্টাইনের পাঠকের অবস্থা অনেকটা বিখ্যাত লেখক মার্ক টয়েনের মতো, মার্ক টয়েন নাকি একবার গণিতের একটা বই হাতে নিয়ে আদ্যপান্ত পড়ে বলেছিলেন, আমি এই বইটার আগামাথা একটা শব্দও বুঝিনি। আসলে মানুষের কাণ্ডজ্ঞানের নেটওয়ার্কের ভেতর যেসব বিষয় আছে আপেক্ষিকতত্ব তার সাথে বেশি একটা খাপ খায় না। এক যুগ আগে, আমি আমার এক সহকর্মীর সাথে টাইম ডাইলেশন( T= T0/ √1- v2/C2 ) নিয়ে আলাপ করতে গিয়ে আইনস্টাইনের টুইন প্যারাডক্স নিয়ে কথা বললে আমাকে নির্ঘাত পাগল সাব্যস্ত করলো। বিষয়টা মোটেও অস্বাভাবিক না, কারণ আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতত্ব ভীষণ পরিমাণে সম্প্রত্যয়গত ব্যাপার। যেটা মেনে নিতে বহু এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিসিস্ট অনেক তালবাহানা করেছে। মনে রাখা দরকার আইনস্টাইন সম্পর্কে বড্ড বিশ্রী ধরণের মিথ্যে কথা আর গল্পসল্প সাজিয়ে অনেক বাওগ্রাফার বই লিখেছেন। এটা তাঁর জীবদ্দশায়ই ঘটেছে। ১৯৪৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ম্যাক্স ব্রড নামে এক লেখককে তিনি লিখেছিলেন, “বাজারে তাঁর সম্পর্কে গল্প বানিয়ে কল্পকাহিনী সাজিয়ে এতো বাজে সব লেখা বানানো হয়েছে যে সেগুলোর প্রতি যদি নজর দেই তাহলে সেইসব ফালতু বিষয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার কবরে যেতে হবে”। এর কারণ হিসেবে অনুমান করা যায় আইনস্টাইনের তত্বগুলো এতো দুর্বোধ্য আর আকর্ষণীয় ছিল যে আপামর জনতা সেসব নিয়ে গল্প গোগ্রাসে গিলতো। সত্য মিথ্যা পাকিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা সহজ হয়ে উঠেছিলো এজন্য যে তিনি বহু শতাব্দী ধরে গড়ে ওঠা নিউটনের পবিত্র মসনদে সরসরি ঢিল ছুঁড়েছিলেন। যেমন ওয়াল্টার আইজাকাটন “আইনস্টাইনঃ হিজ লাইফ এন্ড ইউনিভার্স” বইয়ে লিখছেন আইনস্টাইন নাকি তাঁর সার্বিয়ান এক বন্ধুর কাছে একসময় বলেছিলেন, তাঁর সমস্ত গাণিতিক সমস্যাগুলো তাঁর স্ত্রী মিলেভা ম্যারিক্স সমাধান করে দিতেন। খুব সঙ্গত কারণেই তাঁর আপেক্ষিক তত্ব নিয়েও অনেক নিম্নমানের গল্প বানানো হয়েছে, গাণিতিক দুর্বোধ্যতা আর আপাত অসম্ভব্যতার জন্য অনেকে এই সুযোগ গ্রহণ করেছেন।

তবে এদিক থেকে বলা যায় খুব নাম করা দার্শনিক ও যৌক্তিক অভিজ্ঞতাবাদী ফিলিপ ফ্রাঙ্ক “আইনস্টাইনঃ হিজ লাইফ এন্ড টাইমস” নামে ১৯৪৭ সালে জার্মান ভাষায় একটা বই লিখেছিলেন যেটা অত্যন্ত তথ্যপূর্ণ আর সুখপাঠ্য। তাছাড়া মরিজ শ্লিক নামে আরেকজন জার্মান দার্শনিক(যিনি পরবর্তীতে ১৯৩৩ সালে এক ছাত্রের গুলিতে নিহত হন) অতি উঁচু মানের একটা বই লিখেছিলেন “স্পেস টাইম ইন কনটেম্পোরারি ফিজিক্স” নামে। আপেক্ষিক তত্ব্বের দাশনিক ভিত্তি নিয়ে এর থেকে চমৎকার বই আর হয়না। এসব বই থেকে আপেক্ষিক তত্ব্বের একটা দার্শনিক অবস্থান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। শ্লিক পুরোমাত্রায় পদার্থবিজ্ঞানী হলেও দর্শন জগতে ছিলেন সমধিক পরিচিত। তিনি আইনস্টাইনের সাথে খুব বেশি জড়িয়ে ছিলেন নানাকাজে বিশেষকরে আপেক্ষিক তত্বের দার্শনিক অবস্থান পরিষ্কার করতে তিনি ভীষণ পরিশ্রম করেন। স্থান কাল বিষয়ের সাথে মানুষের মনস্ত্বাত্বিক গাঁটছড়া নিয়ে তিনি দীর্ঘ আলোচনা করেন। তিনি এটা দেখান যেহেতু এ দুটো সরাসরি মানুষের অভিজ্ঞতাসঞ্জাত বিষয় তাই অভিজ্ঞতাপূর্ব পরম বা চরম ধারণার কোন জায়গা নেই। আদতে জগতটা “চেতনার রঙ্গে রঙ্গিন”।

১৮৭৯ সালের ১৪ মার্চ জার্মানির উলমের স্বাবিয়ান শহরের বেভারিয়াতে আইনস্টাইনের জন্ম হয়। অতি সাদামাটা একটা পরিবারে তাঁর জন্ম এবং মা বাবার কোন জ্ঞাতিই তেমন কোন বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের সাথে সংযুক্ত ছিলনা। তাঁর জন্মের পর পরই পরিবারটা মিউনিখে স্থানান্তরিত হয়। মিউনিখ ছিল সে সময়ের জার্মানির রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। আইনস্টাইনের বাবা হারমেন আইনস্টাইনের ছিলেন ছোট্ট একটা ইলেক্ট্রোক্যামিকাল ফ্যাক্টরি্র মালিক। খুব অসফল একজন ব্যবসায়ী হলেও তাঁর জীবন ছিল আনন্দে ভরপুর। মিউনিখে এমন এক সামাজিক পরিবেশে তিনি বড় হন যেখানে সেনাবাহিনির লোকেরা নিয়মিত প্যারেড করতো, এর থেকে তাঁর মনের ওপর দুই ধরণের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতোঃ এক, মানুষের তৈরি আইন কানুনের ওপর বিতৃষ্ণা; অন্যদিকে প্রকৃতির গভীরে যে বিরাট নিয়মের জগত আছে তার প্রতি শ্রদ্ধা। ধর্মীয় আচরণ তাঁকে টানতে পারেনি বরং মনে হয়েছে এসব বাধ্যবাধকতা মানুষকে তার স্বাধীনতা থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। জুরিখ পলিটেকনিক থেকে পাশ করার পর তিনি কোন প্রাতিষ্ঠানিক পদ গ্রহণ করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন, যার ফলে চাকরি নেন সুইস পেটেন্ট অফিসে। সেখানে বসেই তিনি ইতিহাস রচনা করেন পদার্থবিজ্ঞানের। আইনস্টাইন বেশ একটা নিসংগ জীবন পছন্দ করতেন। নাজি অত্যাচার এবং বর্ণ বৈষম্যের অভিজ্ঞতা ছিল এ সময় তার কাছে অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। তাঁর সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিসিস্ট ফিলিপ লেনার্ড যিনি কিছুতেই আপেক্ষিকতত্বকে মেনে নিতে পারেননি। তাঁর চিন্তা ভাবনা ছিল সিমেটিক ও সোশ্যালিস্ট চিন্তার ঘোরতর বিরোধী। ঠিক এ সময় জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী রথেনিউ খুন হয়। রথেনিউ সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ চুক্তি করেছিলো। রথেনিউ-এর এই মৃত্যুর পর জাতীয় শোক দিবস পালন করার জন্য বলা হলে লেনার্ড অস্বীকৃতি জানান। এর প্রেক্ষিতে কিছু সোশ্যালিস্ট তাঁকে নদীতে ফেলে দেয়ার জন্য হুমকি দেয়। এই ঘটনাটা আইনস্টাইনের থেওরি বিরোধিতা করার সম্পর্ক আছে। লেনার্ডের আপেক্ষিক তত্ব বিরোধিতা করার প্রধান কারণ হলো আপেক্ষিকতত্ব মানুষের কাণ্ডজ্ঞান বিরোধী। লেনার্ড হিটালারের লোক জোনকে বোঝাতে সক্ষম হন যে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতত্ব সোভিয়েত ইউনিয়নের একটা কারসাজী। বলশেভিক পদার্থবিজ্ঞান ঐ দেশে ঢোকানোর একটা অপচেষ্টা। ১৯৩৩ সালে তিনি বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক থাকার সময় হিটলারের কারণে জার্মান ছেড়ে চলে যান। পরবর্তীতে তিনি জার্মান নাগরিত্ব ছেড়ে আমেরিকা আসেন এবং পরবর্তীতে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় থিওরিটিক্যাল ফিজিক্সের অধ্যাপক পদ গ্রহণ করে ১৯৪০ সালে আমেরিকার নাগরিত্ব গ্রহণ করেন।

১৯৪৯ সালে আইনস্টাইন তাঁর Autobiographical Notes এ লিখেছেন দু’জন ভীষণ নামকরা দার্শনিক ডেভিড হিউম আর আর্নেস্ট মাখের দর্শন তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের চিন্তার ওপর প্রভাব ফেলেছিল। তিনি বড় কৃতজ্ঞচিত্তে এ দুজন দার্শনিকের অবদান স্বীকার করেন। আইনস্টাইন যখন স্কুলের ছাত্র তখন এ দু’জনের অভজ্ঞতাবাদী চিন্তা তাঁকে মারাত্মক প্রভাবিত করেছিলো। হিউম আর মাখ ছিলেন পুরদস্তুর অভিজ্ঞতাবাদী যারা নিজের অভিজ্ঞতার বাইরে কোন জ্ঞান আছে সেটা গ্রহণ করতেন না। অভিজ্ঞতা ছাড়া কোন ধারণা হতে পারেনা, এটাই ছিল তাঁদের সাফ কথা। মাখ ১৮৯৫ সালে ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্ডাক্টিভ সায়েন্সের অধ্যাপক নিযুক্ত হলে তিনি অভিজ্ঞতা ভিত্তিক দর্শনকে বেগবান করার কাজে নিমগ্ন থাকেন। ১৯২০ এর দশকে “ভিয়েনা সার্কেল” নামে যে দার্শনিক বলয় গড়ে ওঠে তার তাত্বিক গুরু ছিলেন মাখ। ১৯০০ সালের শুরুর দিকে একটা মারাত্মক স্ট্রোক হলে ঐ পদে আসেন পদার্থবিজ্ঞানী লুডভিগ বোল্টজম্যান। খুব নামকরা এই অধ্যাপক কিন্তু সেসময়য় স্থান, কাল, সংবেদন ইত্যাদি নিয়ে তাঁর পূর্ববর্তী দার্শনিকদের তুলধুনা করেন। বিশেষ করে অ্যাপ্রাওরি দর্শন ছিল তার কাছে অবাস্তব বিষয়। অ্যাপ্রাওরি মানে যা আমরা অভিজ্ঞতা ছাড়াই জানি। সেক্ষেত্রে সর্বকালের সেরা দার্শনিকদের অন্যতম জার্মানের ইমানুয়েল কান্ট তাঁর কাছে হয়ে পড়েন অচ্ছুৎ।

উল্লেখ্য নিউটনের পদার্থবিজ্ঞানের সাথে কান্টশিয়ান দর্শনের খুব দোস্তি। আমাদের স্মরণ আছে নিউটনের পদার্থবিজ্ঞানে স্থান কাল পরম। কোন স্থানকে ব্যাখ্যা করতে হলে অন্যকিছুর সহযোগিতা ছাড়াই করা সম্ভব। কালের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। অর্থাৎ স্থান কাল পুরোপুরি অভিজ্ঞতাপূর্ব বাস্তবতা। তাছাড়া নিউটনের স্থানের সাথে কালের গাঁটছড়া ছিল না কোনভাবেই। যেমন দূরের কোন একটা নক্ষত্র যদি ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে নিউটনের পদার্থবিজ্ঞান বলছে, আমরা সেটা সাথে সাথেই জানতে পারবো। কিন্তু আইনস্টাইন বললেন না, ঐ নক্ষত্র থেকে আমাদের কাছে আলো আসতে যতো সময় লাগে ততক্ষণ পর আমরা ওর মৃত্যুর খবর টের পাবো। একারণে আগে যেমন স্থান কাল ছিল দুটো ভিন্ন বাস্তবতা এখন সেটা আইনস্টাইনের কাছে সেটা হয়ে গেল স্থান-কাল। স্থানের তিন মাত্রা আর কালের এক, দু’টো মিলে তাই নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গিতে দাঁড়ালো চারমাত্রিক মহাবিশ্ব। স্থান কালকে বলে দিল, “আমি তোমারি সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ সুরের বাঁধনে”। এই সুর ধ্বনিত হয়ে চলেছে আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত, যেন “বিশ্ব বীণার তারে, বিশ্বজন মহিছে”।

হিউম আর মাখের দর্শন ভেতর দিয়ে নিউটনিয়ন ব্যাখ্যা মুল্য হারাল। এঁদের ধারণার সাথে শতভাগ মিল না হলেও আইনস্টাইন স্বীকার করেছেন তাঁদের আবদানের কথা। মরিজ শ্লিকের কাছে ১৯১৫ সালে একটা চিঠিতে তিনি লেখেন, “Your exposition is also quite right that positivism suggested rel. theory, without requiring it. Also you have correctly seen that this line of thought was of great influence on my efforts and indeed E. Mach and still much more Hume, whose treatise on understanding I studied with eagerness and admiration shortly before finding relativity theory”।

এটা স্বীকার করতেই হবে বিশেষ আপেক্ষিক তত্ব আমাদের অভিজ্ঞতাজাত। ১৮৯৮ সাল থেকে ১৯০৫ সাল অবধি ৭ বছর নিরন্তর পরিশ্রম শেষে আইনস্টাইন এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন। তিনি আরও লেখেন ৭ বছর ক্রমাগত ব্যর্থতা শেষে নিরন্তর পরিশ্রমের পর স্থান কাল সংক্রান্ত এক নতুন ধারনায় পৌঁছলাম যে এ দুটো রাশি অভিজ্ঞতার বাইরে দাঁড়াতে পারে না। যুগপততার (simultaneity) ধারণাকে আরও সমৃদ্ধ করলে অবশেষে তাঁর কাছে ধরা দিল বিশেষ আপেক্ষিক তত্ব। নিউটনের গতির সূত্র কম গতিশীল বস্তুর ক্ষেত্রে ভীষণ কার্যকর, কিছুতেই নড়চড় হবার না, কিন্তু গণ্ডগোল হয় যখন আলোর গতিতে চলমান কোনোকিছু নিয়ে আমরা ভাবি। আইনস্টাইন দেখালেন, এসময় নিউটনের সূত্রের কনো কার্যকারিতা থাকেনা। বস্তুর দৈর্ঘ, ভর আর সময়ের ধারণা একেবারে পাল্টে যায়। যেমন ধরুন, একটা L দৈর্ঘের বস্তুকে আপনি পাঠালেন আলোর গতিতে। তাহলে এর দৈর্ঘ সঙ্কুচিত হবে। কতটুকু হবে সেটা হিসেব কষে বললেন, L= L0 √1- v2/C2( এখানে L হচ্ছে দৈর্ঘ, V হচ্ছে বেগ আর C হচ্ছে আলোর বেগ)। এটার নাম দিলেন লেন্থ কন্টাকশান। ঠিক এভাবে সময়ের ধারনাও পাল্টে যাবে। আলোর গতিতে ভ্রমণরত একজনের সাথে স্থির কাঠামোর ওপর চলমান কোন মানুষের সময় হবে আকাশ পাতাল হেরফের। দুই যমজ ভায়ের একজন আলোর যানে ঘুরে আসলে হয়তো দেখবে তার সহদর চুলদাড়ি পেকে বুড়ো হয়ে গেছে। এই তাত্বিক ধারণার নাম দিয়েছেন আইনস্টাইন টাইম ডাইলেশান, T= T0/ √1- v2/C2 । ঠিক এরকম ভাবে ভরের খেত্রেও দেখা যাবে খুব তারতম্যঃ M= m0 / 1- v2/C2 ।

১৯১৯ সালে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতত্ত্বের প্রমাণ হয় হাতেনাতে। স্থান কালের বক্রতার কারণে আলোকরশ্মি যে বেঁকে যায় এই ভবিষ্যৎবাণী খেটে যায় পুরোপুরি। সেই থেকে পদার্থবিজ্ঞানে তাঁর অবস্থান দাঁড়ায় হিমালয়ের সমান। লিউস ফিউয়ার তাঁর এক প্রবন্ধে লিখেছেন আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদের জ্ঞানতাত্বিক ভিত্তি হলো আত্মগত ভাববাদ। আত্মগত ভাববাদ হচ্ছে আমাদের চেতনা বা মনের ওপর বস্তু জগতের অবস্থান। অনেক সোভিয়েত বিজ্ঞানী এর প্রেক্ষিতে আপেক্ষিকতত্বকে বস্তুবাদ বিরোধী দর্শন হিসেবে বাতিল করে দেন। তবে ফিলিপ ফ্রাংক বলেন, যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদের সাথে আপেক্ষিকতত্বের সবচেয়ে বেশি মিল পাওয়া যায়। এর যে শব্দার্থিক ব্যাখ্যা সেটা প্রত্যক্ষবাদের মূল স্পিরিটের সাথে সংগতিপূর্ণ। ভাষার যৌক্তিক বিশ্লেষণের ভেতর দিয়ে আমরা যেভাবে অর্থপূর্ণ আর অর্থহীনতা যাচাই করি সম্ভবত আপেক্ষিকতত্ব আমাদের চিন্তার এরকম যুক্তিপূর্ণ ও ধারণাগত বিশ্লেষণ। এটা ভাববাদ হোক আর বস্তুবাদ হোক সেটা থেকেও বড় কথা হচ্ছে মানুষের চিন্তা জগতে এটা একটা রেভুলুশন, এবং বিজ্ঞানের জগতে একটা অন্যতম প্যারাডাইম শিফটিং।

১৯২১ সালে নোবেল প্রাপ্তির শত বছর পূর্ণ হচ্ছে এ বছর। এই একশো বছরে বিজ্ঞান এগিয়েছে অভাবনীয় রকম, নতুন নতুন আবিষ্কারে মানুষ হয়তো আজ অনেক সত্যের কাছাকাছি। এর হাত ধরে একদিন এগিয়ে যাবে এই বিশ্বজগৎকে জানার আরও নতুন নতুন উপায়, অবগুণ্ঠিত রহস্য হয়তো আরও বেশি মানুষের চিন্তার দোরগোড়ায় পৌঁছুবে। সেদিনও আইনস্টাইন থাকবে আমাদের অতি আপন, বিজ্ঞান-দর্শন ভাবনার এক অম্লান সঙ্গী।

সিদ্ধার্থ শংকর জোয়ার্দ্দার, অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

চলমান আলোচিত ঘটনা বা দৃষ্টি আকর্ষণযোগ্য সমসাময়িক বিষয়ে আপনার মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাই, সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইলকরুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড