ওয়াহেদ সবুজ
‘গরু’ বানানটা কি অশুদ্ধ? হ্যাঁ। ‘গরু’ বানানটা শতভাগ অশুদ্ধ।
আধুনিক বানান অভিধানে কি আসলেই ‘গরু (অপ্র.)’ লেখা আছে? না, বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানের কোথাও এমনটি লেখা নেই। সেখানে ‘গোরু’ শব্দটির বানান হিসাবে একমাত্র ‘গোরু’ই লেখা আছে, ‘গরু’ শব্দটির অস্তিত্ব সেখানে নেই। দ্রষ্টব্য: বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান (সংস্করণ: এপ্রিল ২০১৮): পৃষ্ঠা নম্বর ৪১৮।
অভিধানে কি কখনও ‘ভুল’ বানান লেখা থাকে? হ্যাঁ, থাকে। ‘ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’-এ ‘ভুল’ বানান দেওয়া থাকে। কেননা ‘ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’ বানান শুদ্ধ করার জন্য নয়। এ অভিধানটির কাজ হলো- বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে মানুষ যে-সব শব্দ ব্যবহার করে এসেছেন/করছেন, সে শব্দগুলো মানুষ কোন অর্থে ব্যবহার করেছেন/করছেন- সেটা জানানো। তাই যে-সব ভুল/অশুদ্ধ শব্দ আমরা ব্যবহার করি, সেগুলোও অর্থসহ এ অভিধানে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ব্যবহৃত বাংলা শব্দগুলো ‘বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’-এর সর্বশেষ সংস্করণের (২০১৫) মুখবন্ধে এ অভিধান প্রণয়নের নীতিমালার মধ্যে এ সম্পর্কিত নির্দেশনা দেওয়া আছে। দ্রষ্টব্য: উক্ত অভিধানের পৃষ্ঠা ‘উনিশ’। প্রাসঙ্গিক পয়েন্টগুলো তুলে দিচ্ছি: ৩ নম্বর পয়েন্টে উল্লেখ: আধুনিক সাহিত্যে অপ্রচলিত প্রাচীন ও মধ্য বাংলায় ব্যবহৃত শব্দাবলির পেছনে প্রথম বন্ধনীর মধ্যে যথাক্রমে প্রা-বাং ও ম-বাং লিখতে হবে। অর্থাৎ এ অভিধানে অপ্রচলিত প্রাচীন ও মধ্য বাংলায় ব্যবহৃত শব্দ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ৪ নম্বর পয়েন্টে উল্লেখ: কোনো প্রচলিত শব্দ ব্যাকরণদুষ্ট বা বিরল প্রয়োগ হলে তার পেছনে প্রথম বন্ধনীর মধ্যে যথাক্রমে ‘অশু’ ও ‘বিরল’ লিখতে হবে। অর্থাৎ এ অভিধানে ‘ব্যাকরণিকভাবে অশুদ্ধ’ এমন শব্দও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ৫ নম্বর পয়েন্টে উল্লেখ: আঞ্চলিক বা অশিষ্ট শব্দ উদ্ধৃত চিহ্ন দ্বারা চিহ্নিত করতে হবে। অর্থাৎ এ অভিধানে আঞ্চলিক ও পরিহার্য শব্দ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এছাড়াও ‘ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’-এ বিভিন্ন শব্দের পাশে যে-সব সংকেত ব্যবহার করা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে: অপ্র: অপ্রপ্রয়োগ, অশি: অশিষ্ট, অশু: অশুদ্ধ, অশুপ্র: অশুদ্ধ কিন্তু প্রচলিত, শুঅপ্র: শুদ্ধ কিন্তু অপ্রচলিত। দ্রষ্টব্য: উক্ত অভিধানের পৃষ্ঠা নম্বর ‘বত্রিশ’ ও ‘তেত্রিশ’। অর্থাৎ এ অভিধানে অপ্রপ্রয়োগকৃত, অশুদ্ধ, অশুদ্ধ কিন্তু প্রচলিত সকল শব্দই অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
‘ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’-এ ‘গোরু/গরু’ বানান বিষয়ে কী নির্দেশনা আছে? এ অভিধানের ৩৪৬ নম্বর পৃষ্ঠায় রয়েছে ‘গরু ⇨ গোরু’। এখানে যে চিহ্নটি (⇨) ব্যবহার করা হয়েছে, সেটিকে বলা হয় ‘দ্রষ্টব্য চিহ্ন’। এ চিহ্নটি দ্বারা কোনোভাবেই ‘শব্দ দুটো একই’ বোঝায় না। ‘একই’ বোঝাতে অভিধানে সমান চিহ্ন (=) ব্যবহার করা হয়েছে। দ্রষ্টব্য: উক্ত অভিধানের পৃষ্ঠা নম্বর ‘বাইশ’। ‘দ্রষ্টব্য’ শব্দের অর্থ হলো ‘যা জানতে হবে এমন’। এর মানে হলো- ‘গরু’ বানানটির বিষয়ে জানতে হলে ‘গোরু’ বানানটি দেখুন। তো, ওই পৃষ্ঠার ওই স্থানে ‘গোরু/গরু’ নিয়ে আর কিছু লেখা নেই। এবার যাই ‘গোরু’ বানানে; ৩৭৪ নম্বর পৃষ্ঠায়। সেখানে শব্দ দুটো এভাবে লেখা: ‘গোরু, গরু (অপ্র.)’। ‘গরু’র পাশে যে ‘অপ্র’ লেখা, এর অর্থ কী? এর অর্থ ‘অপ্রচলিত’ নয়; এই ‘অপ্র’-এর অর্থ হলো ‘অপপ্রয়োগ’ (দ্রষ্টব্য: পৃ. বত্রিশ)। ‘অপপ্রয়োগ’ শব্দের অর্থ- ‘অশুদ্ধ প্রয়োগ’ (দ্রষ্টব্য: আধুনিক বাংলা অভিধান: পৃ. ৬১)। অর্থাৎ এখানে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে যে, ‘গরু’ বানানটি ‘অশুদ্ধ’।
বাংলা একাডেমি সম্প্রতি কোনো নতুন বানানরীতি প্রণয়ন করেছে? না। বাংলা একাডেমি ‘প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ সর্বশেষ প্রণয়ন করেছে ২০১২ সালে। তাছাড়া, ‘গোরু’ বানানটির সঙ্গে বানানরীতির কোনো সম্পর্কও নেই। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, ‘গোরু’ কোনো ‘নতুন’ প্রবর্তিত বানান নয়। বহু আগ থেকেই ছিল। এমনকি বাংলা একাডেমির ‘আধুনিক বাংলা অভিধান’-এ ২০১৬ সাল থেকে এ বানানটি রয়েছে। তারও ১ বছর আগ থেকে ‘ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’-এও রয়েছে। সুতরাং ‘একাডেমি নতুন বানানরীতি প্রণয়ন করেনি’-এর সঙ্গে ‘গোরু’ বানানের কোনো সম্পর্কই নেই; কেননা এ বানানটি ‘নতুন’ নয়, প্রায় ৬ বছর আগেই একাডেমি সেটি অভিধানের অন্তর্ভুক্ত করেছে।
একটি প্রশ্ন ও দুটো কথা। আমার আপন চাচাতো ভাই একজন প্রখ্যাত ডাক্তার। অপরদিকে, আমার এলাকার এক প্রতিবেশী ভাই আছেন, তিনি অত্যন্ত দক্ষ একজন দরজি। সামনেই ইদ। আমি একটা পাঞ্জাবি বানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এ পর্যায়ে একটু দ্বিধার মধ্যে পড়েছি। আমার ডাক্তার ভাই স্বাভাবিকভাবেই কাটাছেঁড়া করায় ও কাটা স্থান সেলাইয়ে দারুণ দক্ষ। তাছাড়া, তিনি আমার আপন চাচাতো ভাই; নিশ্চয় দরদ নিয়ে এবং কম পয়সায় আমার কাজ করে দেবেন। তো, পাঞ্জাবিটা কার কাছে বানাতে দেবো? ‘আপন চাচাতো’ ডাক্তার ভাইয়ের কাছে, না-কি প্রতিবেশী দরজি ভাইয়ের কাছে? আচ্ছা, আমার শরীরের কোথাও সেলাই প্রয়োজন হলে দরজি ভাইটার কাছে গেলে হয় না? তিনি তো দক্ষ সেলাইকারক! ভাই, কাপড় সেলাই করতে ডাক্তারের কাছে আর শরীরের ক্ষত সেলাই করতে দরজির কাছে গেলে কী হতে পারে- সে বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই।
আমি জানি, কষ্ট করে অভিধান ঘেঁটে সত্যতা যাচাই করতে যাওয়াটা সময় ও শ্রমসাপেক্ষ; ‘মানি না’ বলে দেওয়াটা অপেক্ষাকৃত সহজ বইকি! যারা কখনও অভিধানের ধারেকাছে দিয়ে যান না, তাদের কাছে ‘শুদ্ধ বানান ব্যবহার’ একটা ‘অপ্রয়োজনীয় কাজ’ হতেই পারে; যদিও ফেব্রুয়ারি মাস এলেই তাদের সকল ভোল পালটে যায়। নিজে যা খুশি করুন, সেটা আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার; অহেতুক মানুষকে বিভ্রান্ত করবেন না। বাংলা ভাষার ইতিহাস বর্ণনা করে আর আপনাদের সময় নষ্ট করতে চাই না। সবার জন্য ভালোবাসা!
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান নির্বাহী
বানান আন্দোলন
(মতামত বিভাগে লেখা সকল মন্তব্য লেখকের একান্ত ব্যাক্তিগত)
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড