রহমান মৃথা
বিশ্বের সর্বত্রই কম বেশি মাদকদ্রব্য বিক্রি হচ্ছে বড় ধরণের কন্ট্রোল ছাড়া। ব্যতিক্রম আছে কিছু কিছু দেশে যেখানে অফিসিয়ালি হয়তো মাদকের কেনাবেচা নেই তবে গোপনে সেটাও সম্ভব।
ইউরোপের সুইডেনে মাদকদ্রব্য বিক্রি করা হয় এক বিশেষ দোকানে যাকে বলা হয় সিস্টেমবোলাগ (Systembolag)। এ দোকান সুইডিশ কর্তৃপক্ষ নিয়ন্ত্রণ করে। ক্যানাবিস (cannabis), হাসিস (hashish), মারিজুয়ানা (marijuana), ইয়াবা বা হেরোইনের মতো বিষাক্ত ড্রাগসে সারাবিশ্ব ছড়িয়ে গেছে এবং এর ব্যবহারও হচ্ছে নিয়ম এবং অনিয়মের মধ্য দিয়ে।
যে সমস্ত মাদক বা ড্রাগস শরীরে আসক্তিকর তার চাহিদা মার্কেটে বেশি। একারণে ধরা খেলে কঠিন শাস্তি সত্ত্বেও মানুষ জীবনের রিস্ক নিয়ে এসব কেনাবেচা করে।
অন্যদিকে ওষুধের ক্ষেত্রে কিছুটা রেস্ট্রিকশন থাকা সত্ত্বেও বিশ্বের অনেক দেশ রয়েছে, যেখানে যে কেউ যেকোনো ওষুধ বিক্রি করতে এবং কিনতে পারে, বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। এখানে ওষুধ বিক্রি করার লাইসেন্স জোগাড় করার জন্য তেমন কঠিন নিয়ম-কানুনের প্রয়োজন পড়ে বলে মনে হয় না।
সুইডেনে খুব কম ওষুধ রয়েছে যা ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া কেনা সম্ভব। এখন প্রযুক্তির যুগ, গুগলে সার্চ করলে যেকোনো বিষয়ে জানার সুযোগ রয়েছে। আমি যদি আমার শরীরের সিম্পটমকে গুগলে লিখে সার্চ করি তবে আমার শরীরের উপসর্গ মোতাবেক একটি ওষুধের নাম পেয়ে যাবো।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে উপসর্গের সঙ্গে ওষুধের মিল পাওয়া গেলেও আমার অন্যান্য রোগ আছে কিনা জানা দরকার। আমি অন্য কোনো ওষুধ সেবন করি কিনা এবং মিক্সআপের কারণে কী ধরণের সাইড ইফেক্ট হতে পারে এসব বিষয়ে আমার যথেষ্ট জ্ঞান রয়েছে। এসত্ত্বেও আমি ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করি।
বাংলাদেশে অতীতে দেখেছি ডাক্তারের কাছে গেলে এটুজেড ওষুধ লিখে দেন। যদি একটি ওষুধে কাজ না হয় তো অন্যটিতে হবে বা একটির প্রতিক্রিয়া অন্যটির ওপর চাপিয়ে দিতে ডাক্তাররা বেশ পারদর্শী। বর্তমানে সেটার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এটুজেড টেস্ট।
যার কারণে শরীরের নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ ডাক্তারের শিক্ষা এবং বাস্তব অভিজ্ঞতা মিলে যে প্রেসক্রিপশন দেয়া হয়, এর ফলে কার বাপের সাধ্য প্রশ্ন করা যে ওষুধ ঠিক দেয়া হয়েছে কিনা?
বিশ্বে যে পরিমাণ লোক এবার করোনা রোগের কারণে মারা গেছে তার মধ্যে সুইডেন একমাত্র দেশ যে দেশ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোভিড-১৯ চিকিৎসায় কোনো অজানা ওষুধ ব্যবহার করেনি। যার কারণে অনেক রোগীর জীবননাশ হয়েছে।
বাংলাদেশের মত হয়তো অনেক দেশ রয়েছে যেখানে দেদারছে সব ধরনের সম্ভাব্য ওষুধের ব্যবহার চলেছে বা চলছে করোনা রোগীদের ওপর। সবকিছু জানার পর মনে প্রশ্ন জাগছে, ভবিষ্যতে আদৌ ডাক্তারের কাছে রোগীর যাবার দরকার হবে কী? কারণ গুগলে ঢুকে রোগের বর্ণনা দিলেই তো ওষুধের নাম চলে আসছে।
আজ বাংলাদেশের একটি খবরে ডেক্সামেথাসন এবং এর ব্যবহার সম্পর্কে জানতে চাইলে ডাক্তার এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, আমি শুরু থেকে আমার রোগীদের জন্য এটি ব্যবহার করে আসছি। ওষুধটি কার্যকর। তিনি আরও বলেন, আমি কোনো গবেষণা করিনি। তবে আমার পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, যে রোগীদের এটি দিয়েছি, তারা ভালো হয়েছেন।
এটা যদি একজন বিশেষজ্ঞের মতামত হয় তাহলে একজন ডাক্তার এবং গুগলের থেকে তথ্য সংগ্রহকারীর মধ্যে কি কোনো তফাৎ রয়েছে? এতে এটাই প্রমাণিত হয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা পর্যবেক্ষণ ছাড়াই আমরা যার যা খুশি করতে পারি।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বিজ্ঞানীদের উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, ডেক্সামেথাসন ওষুধটিই করোনার চিকিৎসায় গুরুতর অসুস্থদের জীবন রক্ষা করতে সক্ষম হচ্ছে। সুইডেন এবং বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক এই গবেষণা চালিয়েছেন।
হাসপাতালে ভর্তি হওয়া প্রায় ২ হাজার করোনা রোগীর দেহে ডেক্সামেথাসন পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করা হয়েছিল। মূলত করোনায় আক্রান্ত যেসব রোগীর ভেন্টিলেশন ও অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়, সেসব রোগীর জীবন বাঁচাতে ডেক্সামেথাসন অত্যন্ত কার্যকর বলে দেখা যাচ্ছে এবং ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ভেন্টিলেশনে থাকা রোগীদের ক্ষেত্রে মৃত্যুঝুঁকি ৪০ শতাংশ থেকে ২৮ শতাংশে নেমে এসেছে।
আর যেসব রোগীর অক্সিজেন গ্রহণের প্রয়োজন তাদের মৃত্যুঝুঁকি ২৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে নেমেছে। তার মানে ক্রিটিক্যাল সিচুয়েশনে ওষুধটি ব্যবহৃত হচ্ছে।
বাংলাদেশে যার যেভাবে খুশি সেইভাবে চিকিৎসা দিচ্ছেন। ডাক্তার এবিএম আবদুল্লাহ বলেছেন, ডেক্সামেথাসন একটি স্টেরয়েড ওষুধ। প্রয়োজন অনুযায়ী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত অনেক রোগীর ক্ষেত্রে তিনি এই ওষুধ ব্যবহার করছেন।
আমার প্রশ্ন যদি বিবিসি থেকে কোনো গ্রহণযোগ্য রিপোর্ট না পাওয়া যেত তাহলে কি তিনি তার স্বীকারোক্তিতে বা কোথাও ডকুমেন্ট হিসেবে এ কথাটি বলতেন?
আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি চিকিৎসকরা অবশ্যই ওষুধের গাইডলাইন ফলো করে প্রেসক্রিপশন দিবেন। চিকিৎসকদের যে কোনো রোগের ক্ষেত্রে অবশ্যই ডকুমেন্টসহ সব নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে। তা না হলে ওষুধের গুণগত মান ধরে রাখা সম্ভব হবে না।
আর ডাক্তারের ওপর রোগীর আস্থা বিলীন হয়ে যাবে। যার ফলে ভবিষ্যতে মানুষ গুগলের সাহায্যে তাদের চিকিৎসার দায়ভার নিজেরা নিবে। এমতাবস্থায় আমি বলতে চাই, ওষুধ তৈরি এবং তার ব্যবহারে সবাইকে cGMP (current good manufacturing practice) এবং cTUP (current treatment and users practice)-র ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
সবশেষে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা ভুলে গেলে চলবে না। সেটা হচ্ছে কোভিড-১৯ ছাড়াই প্রতিদিন পৃথিবীতে দেড় লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে বিভিন্ন কারণে। যদি সব ফোকাস কোভিড-১৯ এর ওপর চলতে থাকে তবে প্রায় ১৪ কোটি মানুষ মরবে না খেয়ে এবং নানা রোগের কারণে (ইউএন-এর মতে)।
এটা করোনার তুলনায় বহুগুণ বেশি। আমরা যাই করি বা বলি না কেন– মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য। এটা যেমন মনে রাখতে হবে, ঠিক তেমনি মনে রাখতে হবে– চিকিৎসার মূল উদ্দেশ্য রোগীর রোগ মুক্ত করা।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড