আব্দুল জব্বার
চুলায় পুইশাক ভাজি উঠিয়ে লিখতে বসেছি- চুলার আগুনে পুড়ে পুড়ে যেমন শাক সিদ্ধ হচ্ছে ঠিক তখন লিবিয়ায় মাফিয়াদের গুলিতে নিহত ২৬ বাংলাদেশিসহ মোট ৩০ অভিবাসী পরিবারও তাদের স্বজন হারানোর শোকে পুড়ে পুড়ে ঝলসে যাচ্ছে। আসলে গোটা বাংলাদেশ তথা বিশ্ববাসীর মনকেই জ্বালিয়ে দিয়েছে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা।
একটা বহুল প্রচলিত প্রবাদ আছে এ রকম, নিচ দিয়ে অনেক গেলেও সয়, উপর দিয়ে একটু গেলেই সমস্যা। আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, পরিবারের সব থেকে ডানপিটে, চতুর আর মিশুক মনা ছেলে কে আমাদের দেশের বাবা-মা'রা বিদেশ প্রেরণ করেন। কারণ তারা পড়াশুনা করতে চায় না, ক্রিকেট খেলায় পটু হয়ে থাকে, অন্যের গাছের আম পেড়ে খায়, সকল বাধা ছিন্ন করে প্রেমিকাকে নিজের করে নিতে চায়। সমাজের প্রচলিত বাধা ডিঙিয়ে নিজের স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করতে চায়, নাহলে মাদকাসক্তির দিকে পা বাড়ায়।
সমাজ, আশেপাশের মানুষের কুট উক্তি সহ্য করতে না পেরে পরিবার থেকে সবার চোখের আড়াল করার সিদ্ধান্ত নেয়। যা করে করুক বিদেশ গিয়ে করুক কেউ দেখবেও না ছেলেকে নিয়ে কষ্টদায়ক কথাও শুনতে হবে না। একবার ভেবে দেখে না আমাদের মাঝে থেকেই যেখানে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা দায় সেখানে বাধ বাধাহীন অচিন দেশে কি করে তাকে আটকে রাখা যাবে? একটা কথা মেনে নিতে হবে পৃথিবীর সকল দেশের নিয়ম কানুন এক রকম না। বিদেশের মাটিতে চাইলেই সব কিছু সবসময় করা সম্ভব না। তারপরও 'খারাপ কাজের টাকা ভূতে যোগায়' বলে একটা কথা আছে। আমাদের দেশে যেগুলোকে খারাপ কাজ ধরা হয় সে সমস্ত কাজ ওসব দেশে নিত্য কাজের মধ্যেই পড়ে।
যে ছেলে ৫০০০০ টাকা নিজের ভালো লাগার কাজের জন্য চেয়ে পরিবার থেকে পায় না সেই ছেলেকে বিদেশ পাঠাতে জমি জমা, সহায় সম্বল বিক্রি করেতেও দ্বিধা করে না। যে মানুষ দেশে প্লেট ধুয়ে ভাত খায় না সে বিদেশ গিয়ে ময়লা ড্রেন কীভাবে পরিষ্কার করবে? স্বল্প শিক্ষিত, কারিগরি জ্ঞান না থাকায় এসব শ্রমিকদের কি অমানবিক জীবন যাপন করতে হয় সেটা আমরা সবাই জানি। এত এত টাকা খরচ করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যেই শ্রম যেই কাজ করে অন্য দেশের জন্য সে শ্রম নিজের মায়ের দেশে করলে বিদেশের থেকে অনেক ভালো কিছু করা সম্ভব।
দালালদের দেখানো লোভের ফাঁদে পড়ে, লোভের বশবর্তী হয়ে প্রতিবছর কত কত পরিবার তাদের সর্বত্র হারাচ্ছে, প্রিয়জনের মৃত্যু শোকে কত মা-বাবা পাথর হচ্ছে সেটা আমরা নিয়মিত দেখে আবার নিয়মিত ভুলে যাই। সরকারি নিয়মনীতি না মেনে স্বল্প টাকায় বিদেশ যাওয়ার লোভে অবৈধ ভাবে সাগর পথে বিদেশ যেতে কি পরিমাণ মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছে সেটা বলার অপেক্ষাই রাখে না। বিদেশ কে আমাদের দেশের মানুষ যতটা সহজ মনে করে বিদেশ গিয়ে দেখে তার আসল চিত্র। কতটা কঠিন ভিনদেশী মাটির সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়া সেটা হয়তো যে যায় সেই বুঝতে পারে ভালো। হোক বিশ্বের সব থেকে ধনী রাষ্ট্র কিংবা সব থেকে গরীব, যোগ্যতা ছাড়া সব দেশেই আপনাকে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হবে৷ বনে-জঙ্গলে, পাহাড়ে-গুহায় কতোটা মানবেতর জীবনযাপন করে আমাদের দেশের শ্রমিকেরা সেটাও অনেক পুরাতন ইস্যু। বিভিন্ন মিডিয়ায় এ সমস্ত চিত্র স্বচক্ষে দেখেও দালালদের খপ্পরে পরে জীবন বলী দিচ্ছে অসহায় মানুষ সেটা ভেবে খুব কষ্ট লাগে।
আমরা আমাদের কে বোঝা ভাবি, কখনো ভাবি না পৃথিবীতে মানুষের চেয়ে দামি কোন সম্পদ নেই৷ আমাদের দেশে জনসংখ্যা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি মানে আমরা অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক ধনী, সম্পদশালী। সরকারের দোষ সবসময় দিলে চলবে না। আমরা যদি আমাদের কে পরিবর্তন করাতে না পারি তাহলে শুধু সরকারের একার পক্ষে এমন সমস্যার সমাধান করা কখনোই সম্ভব না।
সংবাদপত্রে খবর দেখলাম- গৃহযুদ্ধ-কবলিত দেশ লিবিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় মিজদা শহরে গত বৃহস্পতিবার ২৬ বাংলাদেশিসহ ৩০ অভিবাসীকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় নিহত হন মাদারীপুরের ১১ জন। আহত হন ৫ জন। নিহতদের মধ্যে একজন আসাদুল। তিনি রাজৈর উপজেলার রাজেন্দ্র দারাদিয়া এলাকার সিদ্দিক আকনের ছেলে। এক টগবগে তরুণ আসাদুল সন্ত্রাসীদের হাতে জিম্মি হয়ে দশ লাখ টাকা দিতে না পারায় জীবন হারিয়েছেন। টাকার জন্য বাড়িতে কথাও বলেছিলেন। ৪ লাখ টাকা খরচ করে মাত্র কিছুদিন আগে পাড়ি জমিয়েছেন লিবিয়া। পরিবার থেকে হঠাৎ করে কিভাবে দশ লাখ টাকা জোগাড় করবে?
আমরা সাধারণত সিনেমা, নাটকে মাফিয়াদের কর্মকাণ্ড দেখি। একবার ভাবুন, আমাদের আসাদুলের কথা - একটি পরিবারের সব থেকে আদুরে ছোট ছেলের কথা। যে দেখেছে বাস্তবের মাফিয়াদের আগ্রাসন, পাশবিক হিংস্রতা, কিছু টাকার জন্য কত সহজে ওরা একজন দরদী মায়ের বুক খালি করতে পারে সেটা। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে আসাদুল আকন এর কোন শাক খুব পছন্দের ছিলো...?
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড