• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩০ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

হায় নেশা!

  মীর আব্দুল আলীম

২৯ মে ২০২০, ২১:৫৬
মীর আব্দুল আলীম
মীর আব্দুল আলীম

করোনা সংকটে প্রয়োজন ছাড়া ঘরেই থাকার কথা কিন্তু মানুষ ঘরেথাকছে না। অপ্রয়োজনেও ঘর থেকে বের হয়ে আড্ডা দিচ্ছে; যত্রতত্র ঘুরাফেরা করছে অসাবধানী মানুষ। এমনকি নেশার টেবিলও জমছে বেশ। এ অবস্থায় বিষাক্ত নেশা সেবনে মানুষ মরছে। ঈদের ছুটির মধ্যে নেশা করতে বিষাক্ত ‘স্পিরিট’ খেয়ে রংপুর ও দিনাজপুরে মোট ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে রংপুরে তিন দিনে মোট ১০ জন এবং ২৭ মে দিনাজপুরের বিরামেপুরে ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।

কোভিট করোনাও নেশাগ্রস্তদের দমাতে পারেনি। অনেক ব্যবসা থমকে গেলেও মাদক ব্যবসায়ীরা যে সক্রিয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ইয়াবা, ফেন্সিডিল, হেরোইন আর মদ্যপান করে মানুষ কেবল অসুস্থ আর বিকারগ্রস্ত হচ্ছে না, ঘটছে মানুষের জীবনহানীও। বিষাক্ত মদ্যপানে মানুষের মৃত্যুর খবর আমরা প্রায়সই পাচ্ছি। দেশে বিষাক্ত মদ্যপানে মানুষ মরছে। আবার নেশাগ্রস্তরা নেশার ঘোরে মানুষ হত্যা করছে। এমনটাই চলছে দেশে। মদকের নেশায় এদেশের হাজার হাজার পরিবার আজ পথে বসেছে।

প্রশ্ন হলো বিষাক্ত মদ পানে মানুষ মারা যাবার ঘটনা ঘটছে; সরকারের সংশ্লিষ্টরা কি করছে? রংপুরের মাদকের আসরের কথা জানতো এলাকাবাসী। পুলিশকে ম্যানেজ করেই নাকি তারা এ আসর বাসাতো। দেশের সর্বত্রই এ অবস্থা চলছে। এ মুহুর্তে দিন তারিখ আর স্থান মনে নেই, সম্প্র্রতি একই পত্রিকায় পাব্যত্য কোন জেলায় এক ব্যক্তি মদের নেশায় নিজের স্ত্রী আর কন্যাকে হত্যা করেছে বলে সংবাদপত্রে দেখেছি। স্ত্রী কন্যাকে হত্যা করে তাঁর ছোট ছেলেটিকেও গলাতেও কোপ বসিয়ে দিয়েছিল ঐ নেশাগ্রস্ত বাবা। মুমুর্ষ অবস্থায় হাসপাতালে থাকা ঐ সন্তানের ভাগ্যে পরবর্তিতে কি ঘটেছে তা আর পরে জানতে পারিনি। এমন অসংখ্য ঘটনার জন্ম দিচ্ছে নেশাগ্রস্ত মানুষ।

মাদক আর মাদকাসক্ত মানুষ আমাদের সত্যিই ভাবিয়ে তুলেছে। এদের কর্মকান্ডে আমরা; আমাদের দেশ প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তবুও দেশ থেকে কেন মাদক নিয়ন্ত্রণ করা হয় না? প্রশ্ন হলো, যারা মাদক নিয়ন্ত্রণ করবেন কী করছেন তারা? দু/চারজন চুনোপুটিকে ক্রসফায়ারের আওতায় আনলেই মাদক রোধ হবে এমনটা না। মাদকের মূলউৎপাটন করতে হবে। গডফাদারদের ধরে আইনের আওতায় আনতে হবে। মাদক পাচার, ব্যবসা ও ব্যবহারকারীর ক্রমপ্রসার রোধকল্পে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পর্যায়ে নানারকম কার্যক্রম দেখা গেলেও তেমন কোনো ইতিবাচক ফল মিলছে না। মাদক শুধু একজন ব্যক্তি কিংবা একটি পরিবারের জন্যই অভিশাপ বয়ে আনে না, দেশ-জাতির জন্যও ভয়াবহ পরিণাম ডেকে আনছে। নানারকম প্রাণঘাতী রোগব্যাধি বিস্তারের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও খারাপ করে তুলছে। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতায় দেশের অভ্যন্তরে মাদকের বিকিকিনি এবং বিভিন্ন সীমান্তপথে দেশের অভ্যন্তরে মাদকের অনুপ্রবেশ নিয়ে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সংশ্লিষ্টতার অভিযোগও দীর্ঘদিনের।

দেশের প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় মাদকদ্রব্য বিকিকিনির বিষয়টি বলতে গেলে ওপেন সিক্রেট। বিভিন্ন সময়ে পুলিশি অভিযানে মাদকদ্রব্য আটক ও জড়িতদের আটকের কথা শোনা গেলেও মাদক ব্যবসার নেপথ্যে থাকা গডফাদারদের আটক করা হয়েছে কিংবা দৃষ্টান্তম‚লক শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে এমন কথা শোনা যায় না। ফলে মাদকবিরোধী নানা অভিযানের কিছুদিন যেতে না যেতেই আবারো নতুন করে মাদক ব্যবসার প্রসার ঘটে। মাদক ব্যবসায়ীদের প্রধান টার্গেট হচ্ছে তরুণ সমাজ। দেশের তরুণ সমাজ মাদকের ভয়াবহ প্রভাবে বিপথগামী হচ্ছে। মাদকের নীল ছোবলে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে আমাদের আগামী প্রজন্ম। যা একটি দেশের ভবিষ্যতের জন্য ভয়াবহ দুঃসংবাদ। সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার প্রকট রূপের পেছনে মাদক অন্যতম বড় একটি উপসর্গ হয়ে দেখা দিয়েছে। এর মতো উদ্বেগজনক ঘটনা আর কী হতে পারে?

২০১৭ এর শেষের দিকে, লায়ন্স ক্লাবের বাংলাদেশ দলের সাথে মিয়ানমার সফরের অভিজ্ঞতা আমাকে বেশ ব্যথিত করে। বাংলাদেশ ঘেঁষা সীমান্তে মিয়ানমারে অসংখ্য ইয়াবা কারখানা গড়ে উঠেছে। সে সব কারখানায় কোটি কোটি পিস ইয়াবা তৈরি হচ্ছে। অবাক করা কথা, মিয়ানমারের মানুষ, সেখানকার যুবসমাজ খুব একটা ইয়াবা আসক্ত নয়। কোনো কোনো এলাকায় তো ইয়াবা কী- অধিবাসীরা জানেনই না। মুলত বাংলাদেশিদের জন্যই সেখানে ইয়াবা কারখানা গড়ে উঠেছে। যতদুর জানতে পারি, তাতে নাকি এ ব্যাপারে সে দেশের সরকারের মৌন সম্মতিও আছে। মিয়ানমার সীমান্তে ইয়াবা কারখানার কথা আমরা জানি, আমাদের সরকারও জানে, কিন্তু’ ইয়াবা চোরাচালান রোধ হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না? মিয়ানমার ইয়াবা তৈরি করে প্রতিদিন আমাদের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে, তাতে আমাদের যুবসমাজ ইয়াবা আসক্ত হয়ে ধ্বংসে নিপতিত হচ্ছে। কী করছি আমরা? আমাদের সরকারও কী করতে পারছে? এতে সরকারের সম্মতি আছে এ কথা বলার সুযোগ নেই, তবে সরকারে কর্তাবাবুদের ম্যানেজ হয়ে যাওয়ার কারণে মাদককারবারিরা প্রতিদিন দেশে মাদকে সয়লাব করে দিচ্ছে। মাদক তথা ইয়াবা ব্যবসা নির্বিঘ্ন হচ্ছে তা বলছি না। মাদক কারবারিরা ধরাও পড়ছে মাঝে-মধ্যে। যে দিন এ লেখাটি লিখছি- ২৫ আগস্ট কক্সবাজারের টেকনাফে ১ লাখ পিস ইয়াবা বড়ি উদ্ধার করেছে বিজিবি। তবে এ সময় কাউকে আটক করতে পারেনি। ১ লাখ পিস ইয়াবা সে কি সহজ কথা? ১ লাখ লোক আসক্ত হতে পারবে এ ইয়াবায়। দামও তো কম নয়। বাজারম‚ল্যে কম করে হলেও ৫ কোটি টাকা। এত টাকার মাদক ধরা পড়লো আর কাউকে গ্রেপ্তার করা গেলো না এটা প্রশ্ন সামনে আসে বৈকি! এই তো হচ্ছে বেশিরভাগ সময়। যারা মাঝে-মধ্যে ধরা পড়ে তারা কেবল চুনোপুঁটি। আবার ওদের গডফাদারদের বদান্যতায় সহজেই ছাড়া পেয়ে যায়। দেশের প্রতিটি সীমান্তেই এমন হচ্ছে। ভারতের সীমান্তেও অসংখ্য ফেনসিডিলের কারখানা আছে। সেখানেও এই একই অবস্থা। পার্শ্ববর্তী দেশগুলো আমাদেরও দেশে মাদকের বাজার তৈরি করে নিয়েছে। এ জন্যই হয়তো দেশ মাদকে সয়লাব হচ্ছে। মাদক ব্যবসার সাথে দেশের অনেক রাঘববোয়াল জড়িত। তাই ওদের টিকিটিও ছোঁয় না কেউ। যা হওয়ার তাই হচ্ছে দেশে। আমরা দেশবাসী দুর্ভাগা বলেই আমাদের যুবসমাজ সহজে মাদক হাতের নাগালে পাচ্ছে। এ সংক্রান্ত আইনের তেমন শাসন সক্রিয় নয় বলে আমাদের সন্তানরা দিন দিন অধঃপতনে নিপতিত হচ্ছে।

মাদক সেবনের কুফল সম্পর্কে মহাসমারোহে আলোচনা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম হয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে বিপুল অর্থ ব্যয় করা হয়। বিভিন্ন এনজিও মাদক সেবন নিরুৎসাহিত করতে বিভিন্ন কর্মস‚চি গ্রহণ করে। মাদক পাচার, বহন ও ব্যবহারের বিভিন্ন শাস্তি রয়েছে। তবু মাদক ব্যবহার কমেনি। ফেনসিডিল, গাঁজা, হেরোইন, ইয়াবা, প্যাথেডিনের ব্যবসা রমরমা। নারী, পুরুষ উভয় শ্রেণির মধ্যে মাদক সেবন প্রবণতা বাড়ছে। ডিশ এন্টেনার যুগে বিদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসন এ দেশের কোমলমতি ছাত্রছাত্রীকে সমকামী, নেশাগ্রস্ত ও পশুপাখি সহযোগে বাস করার মানসিকতা তৈরি করছে। ঘুমের ওষুধ, হেরোইন, গাঁজা, এমনকি কুকুর মারার ইনজেকশন সেবন করছে মাদকসেবীরা। বিষ শরীরে ঢুকিয়ে নেশা করার মতো অভ্যাস গড়ে উঠছে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে। এ ব্যাপারে প্রশাসন নির্বিকার। কাজের কাজ কিছুই করে না। করবেই বা কেন? মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন জানে এ সব। জানে কোথায় মাদকদ্রব্য বিক্রি হয়, কোথা থেকে আসে এসব আর কারাই বা বিক্রি করে তা। এর সবই তাদের নখদর্পণে। যদিও এ সব ধরার দায়িত্ব তাদের। কিন্তু মাদক ব্যবসায়ী গডফাদারদের ধরা তো দ‚রের কথা, সং¤িøষ্টরা এর পাড় ঘেঁষেও দাঁড়াতে রাজি নয়। সময়মতো মাসোহারা পেলেই তারা তুষ্ট। নিজেদের উদরপূর্তি হলেই হলো। নগদ পেলে তো সবার মুখেই কুলুপ এঁটে থাকে; তখন চোখ হয় অন্ধ। আর এ সুযোগে নেশার রাজ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে গোটা দেশের যুবসমাজ। এগুলোকে ঘিরে পারিবারিক ও সামাজিক শান্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ঘটছে সহিংস ঘটনা। বেড়েছে চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি। তবে মাদক বিক্রেতাদের যে পুলিশ একেবারেই ধরছে না তা নয়। মাঝে মাঝে মাদকসহ ২/৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হলেও মাদক বিক্রেতারা আইনের ফাঁক-ফোকরে আবারও জেল থেকে বেরিয়ে এসে পুনরায় ব্যবসা পরিচালনা করছে।

মাদকের ভয়াবহ আগ্রাসন শুধু নগর-মহানগরেই সীমাবদ্ধ নেই, গ্রামবাংলা পর্যন্ত মাদক এখন সহজলভ্য। হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় মাদক। তবে মাঝে-মধ্যে মাদকদ্রব্য বহনের দায়ে কেউ কেউ ধরা পড়লেও ম‚ল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকে। দৃশ্যের আড়ালে এই যে অদৃশ্য মহাশক্তিধর চক্রটির জন্যই মাদকের ক্রমবিস্তার রোধ হয়ে উঠেছে অসম্ভব।আমরা মনে করি মাদক সংশ্লিষ্ট চুনোপুঁটি থেকে রাঘব-বোয়াল পর্যন্তপ্রত্যেকের ব্যাপারেই আইন প্রয়োগে কঠোরতা দেখাতে হবে। আইনের কঠোর প্রয়োগই মাদকের ভয়াবহ বিস্তার রোধে সহায়ক হতে পারে।

মাদক আমাদের সমাজকে কীভাবে কুঁরে কুঁরে খাচ্ছে তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। এ সমস্যা সমাজ ও রাষ্ট্রের। দেশের উদীয়মান যুবসমাজ যদি সমাজ বৈশিষ্ট্যের বিরূপতার শিকার হয় তাহলে দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। দেশকে রক্ষা করতে হলে সংশ্লিষ্টদের অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করতে হবে। পরিস্থিতি উত্তরণে মাদকাসক্তি, যৌনাচার এবং পর্নোগ্রাফি প্রতিরোধে সুচিন্তিত ও সমন্বিত কর্মপন্থা গ্রহণ করা দরকার। একটি প্রজন্ম ধ্বংস হওয়ার আগে আমাদের সবার দায়িত্ব হবে দেশ থেকে মাদক নির্মুল করা। আমরা বিশ্বাস করি রাষ্ট্রের কাছে মাদক সিন্ডিকেট মোটেও শক্তিশালী নয়। রাষ্ট্র চাইলে দেশের মাদক প্রসারতা কমবে। আর রাষ্ট্র তা সহসাই করবে এ প্রত্যাশা রইলো।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গবেষক, [email protected]

চলমান আলোচিত ঘটনা বা দৃষ্টি আকর্ষণযোগ্য সমসাময়িক বিষয়ে আপনার মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাই, সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইলকরুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড