অধিকার ডেস্ক
'করোনাভাইরাস' নামটির উৎপত্তি লাতিন শব্দ করোনা থেকে যার অর্থ 'মুকুট' বা 'হার'। ভাইরাসটিতে অগ্রভাগ সদৃশ গজাল আছে, যাকে ' স্পাইক' বলা হয়। এর কারণে ভাইরাসটিকে অনেকটা মুকুট (Crown) এর মত দেখায়। ‘কভিড-১৯’ হচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (World Health Organization) থেকে অফিসিয়ালি দেওয়া করোনা ভাইরাস ডিজিজ-২০১৯ এর নাম। এখন পর্যন্ত ৩৫টি দেশ মিলে হাজারের বেশি জিনগত বৈশিষ্ট্য উন্মোচন করেছে এবং বিভিন্ন দেশে মানুষকে আক্রান্ত করা ভাইরাসটির আটটি ধরণ খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, নতুন এ ভাইরাস টির জন্ম হয়েছে উহান শহরে অবস্থিত দক্ষিণ চীন সাগরের সামুদ্রিক খাবারের কোনো এক উৎস অথবা বাদুড় থেকে। চীনের উহান শহরে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্রথম এ ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে। এরপর পর্যায়ক্রমে চীনের অন্যান্য শহরে এমনকি বিশ্বের অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। এ পর্যন্ত বিশ্বের ২০৫ টি দেশে কোরোনার এই ভাইরাসে সংক্রমিত রোগী সনাক্ত করা হয়েছে। মহাদেশ অনুযায়ী সংক্রমণের হার বিবেচনা করলে এখন পর্যন্ত ইউরোপ ও দক্ষিণ আমেরিকাতে করোনার প্রকোপ বেশি তুলনামূলকভাবে অন্যান্য মহাদেশ থেকে যেমন দক্ষিণ' এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা। জন হপকিনস ইউনিভার্সিটির তথ্য অনুসারে নতুন করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে ২০২০ সালের ৩ এপ্রিল পর্যন্ত বিশ্ব জুড়ে মোট আক্রান্তের সংখ্যা মিলিয়ন ছাড়িয়েছে, প্রাণ হারিয়েছেন অর্ধ লক্ষেরও বেশি মানুষ।
বৈশিষ্ট্য করোনাভাইরাস এনভেলপড ভাইরাস গোত্রের সদস্য। এনভেলপড ভাইরাস বলতে আমরা বুঝি যেসব ভাইরাস এ প্রোটিনের তৈরি একটা তৈলাক্ত আবরণ থাকে, যাকে আমরা বলি লিপিড বাইলেয়ার। করোনাভাইরাসে সাধারণত স্পাইক (এস), এনভেলপ (ই), মেমব্রেন (এম) এবং নিউক্লিওক্যাপসিড (এন) নামক চার ধরনের প্রোটিন দেখা যায়। নিউক্লিওক্যাপসিড সর্পিলাকৃতির। এর জিনোমের আকার সাধারণত ২৭ থেকে ৩৪ কিলো বেস-পেয়ার যা আরএনএ ভাইরাসের মধ্যে সর্ববৃহৎ বলে ধরা হয়।
যেভাবে ছড়ায় এ ভাইরাস সর্ব প্রথম করোনা ভাইরাস সংক্রমিত প্রাণীর সাথে মানুষের সংস্পর্শে এই ভাইরাস ছড়ায় বলে ধারণা করা হয়। এরপর সংক্রমিত প্রাণী থেকে পর্যায়ক্রমে মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়ে মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গের মাধ্যমে যেমন নাক, মুখ ইত্যাদি। ভাইরাস টি অতি দ্রুত সময়ে নাসারন্ধ্র দিয়ে ঢুকে একটি পর্যায়ে মানব কোষ এ নিজের জেনেটিক উপকরণ প্রবেশ করায় এবং পরবর্তীতে দেহের স্বাভাবিক কার্যক্রম নষ্ট করে ফেলে। ভাইরাসটির একটি বৈশিষ্ট্য হলো এটি মানুষের নাসারন্ধ্র দিয়ে প্রবেশ করার সাথে সাথে মানবদেহের কোষকে নিজের দখলে নিয়ে বংশ বিস্তার করা শুরু করে এবং অল্প সময়ের মধ্যে কয়েক লাখ সংস্করণ করে ফেলে এবং আক্রমণের তীব্রতা বাড়াতে থাকে। ভাইরাসটি সংখ্যায় ক্রমান্বয়ে বাড়তে বাড়তে একটা সময় ফুসফুসে ঢুকে ফুসফুসকে ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেলে যার ফলে রোগী কে স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়ার জন্য ভেন্টিলেটর দরকার হয়। কোনো একটা সময় দেখা যায় পরিস্থিতি কঠিন হয়ে যায় সেসময় ভেন্টিলেটর দিয়েও কাজ হয় না এবং রোগী মারা যায়। শুধু ফুসফুস নয়, এই ভাইরাস মলনালি পর্যন্ত পৌঁছে বিপাক প্রক্রিয়ায় নিয়জিত কোষ গুলাকে ক্ষতিগ্রস্ত করার মাধ্যমে বিপাক প্রক্রিয়াতেও বাধাগ্রস্ত করতে পারে। আবার রক্তনালিতে প্রবেশের মাধ্যমে হার্ট, কিডনি, লিভার, মস্তিস্ক কেও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। করোনা আক্রান্ত কিছু রোগীর মাঝে মস্তিস্ক জনিত রোগ দেখা দিচ্ছে।
মানুষ থেকে মানুষে এই ভাইরাসটি বিভিন্নভাবে ছড়াতে পারে। যেমন আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশির মাধ্যমে অথবা ভাইরাস আছে, এমন বস্তুতে হাত রেখে পরে সে হাত নিজের শরীরে স্পর্শ করলে। হাত না ধুয়ে মুখ, নাক বা চোখে স্পর্শ করলে। বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, প্রতি একজন আক্রান্ত ব্যক্তি হতে চারজন ব্যক্তিতে ভাইরাসটি সংক্রমিত হচ্ছে। যদিও বিশ্বজুড়ে সংক্রমণের হার কমানোর জন্য এই হার কে এক এ নামিয়ে আনার প্রাণান্তর চেষ্টা করা হচ্ছে। আবার আমরা দেখছি যে একটি নিৰ্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিভিন্ন দেশে আক্রান্ত রোগী বা করোনা ভাইরাস রোগীর সংখ্যা আনুপাতিক হারে বাড়তে থাকে। এটাকে আমরা এক্সপোনেন্সিয়াল গ্রোথ হিসেবে জানি । এতে করে একটা দেশের জনগোষ্ঠীর বিশাল অংশ আক্রান্ত হতে পারে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে করণীয় এটি একটি নতুন আবিষ্কৃত ভাইরাস হওয়াতে এখন পর্যন্ত এই ভাইরাসের কার্যকরী ভ্যাকসিন তৈরী হয়নি। সেজন্য একজন সুস্থ ব্যক্তি নিজেকে রোগাক্রান্ত ব্যক্তি থেকে নিরাপদ রাখতে ঘরে থাকা, সোসাল ডিসট্যান্স মেনে চলা, নিরাপদ খাদ্য গ্রহণ, সাবান দিয়ে হাত ধোয়া ইত্যাদি মেনে চলে নিজেকে সংক্রমণ থেকে দূরে রাখতে পারে। এর সাথে আমাদের এটাও নিশ্চিত করতে হবে আক্রান্ত রোগীকে কোয়ারেন্টাইন এবং আইসোলেশান করা হয় যেন এই ভাইরাসটি বিস্তার লাভ করতে না পারে। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন ইতোমধ্যে তাদের কোভিড-১৯-এর ভ্যাকসিন বা টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ (ক্লিনিকাল ট্রায়াল) শুরু করেছে। তাছাড়া অস্ট্রেলিয়া প্রাক্-ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা শুরু করতে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে করোনা ভাইরাস দক্ষিণ এশিয়াতে করোনা ভাইরাস এর বর্তমান অবস্থান তুলনামূলকভাবে বেশ দুর্বল। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) এর তথ্য মতে ২০২০ সালের ৪ এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশ এ আক্রান্তের সংখ্যা ৭০ জন এবং মৃতের সংখ্যা ৮ জন। যদিও প্রথম দিকে শুধুমাত্র আইইডিসিআর থেকে করোনা সনাক্তকরণ করা হত, এখন আইইডিসিআর এর পাশাপাশি বর্তমানে দেশের সর্ববৃহৎ সরকারি চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে বিনামূল্যে সকাল ৮টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত রোগীদের পরীক্ষা করা যাচ্ছে এবং এতে তিন থেকে চার ঘণ্টার মধ্যেই করোনা ভাইরাস সনাক্তের পরীক্ষার ফলাফল জানা যাবে। এর মধ্যে ঢাকা মেডিকেল এ ২৪ ঘণ্টা টেলিমেডিসিন সেবা পাওয়া যাচ্ছে। তাছাড়া আইইডিসিআর এর অধীনে ঢাকা এবং ঢাকার বাইরেও করোনা ভাইরাস সনাক্ত করণের জন্য ল্যাব স্থাপন করা হচ্ছে। অচিরেই এসব ল্যাব এ পরীক্ষা শুরু হবে এবং বেশিসংখ্যক মানুষকে মানসম্পন্ন সেবা প্রদান করা যাবে। যেহেতু করোনা ভাইরাস সনাক্তকরণ পদ্ধতি অনেক ব্যয়বহুল সেহেতু করোনা ভাইরাসের জীবাণু সনাক্ত করতে হলে রিঅ্যাজেন্ট এবং ইকুইপমেন্ট এর খরচ কিভাবে কমানো যায় এটা চিন্তা করতে হবে। সঠিক পদ্ধতিতে পরীক্ষা, ,তত্ত্বাবধান এবং তথ্যের সংরক্ষণ ও সুষ্ঠ বিতরণ এখন আমাদের একটি মুখ্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়াবে সামনের দিনগুলোতে।
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে অণুজীববিজ্ঞান পড়া কতটা গুরুত্বপূর্ণ: বর্তমান প্রেক্ষাপটে অণুজীববিজ্ঞান পড়ার এটাই আদর্শ সময়। করোনা ভাইরাস এর মতো মরণব্যাধি জীবাণু সনাক্তকরণ এবং উপযুক্ত প্রতিষেধক তৈরির জন্য অণুজীববিজ্ঞান পড়াটা অনেকাংশেই আবশ্যক। করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কারের ক্ষেত্রে বিশ্বের বিভিন্ন চিকিৎসকদের সঙ্গে অণুজীববিজ্ঞানীরাই তাদের মেধা এবং প্রচেষ্টা দেয়ার সাথে সাথে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের ভূমিকা: বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকটি সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অণুজীববিজ্ঞান বিভাগ আছে। করোনা ভাইরাস সনাক্তকরণ এবং প্রতিষেধক তৈরির জন্য বিশ্বের অন্যান্য সব দেশ এর মতো আমাদের দেশের অণুজীববিজ্ঞান বিভাগগুলি গবেষণায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির অণুজীববিজ্ঞান বিভাগ তাদের শিক্ষার্থীদেরকে মানসম্মত শিক্ষা দিয়ে আসছে। ইতিমধ্যেই করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত তথ্যাদি বিভাগের শিক্ষক এবং শিক্ষিকা বৃন্দ ছাত্র ছাত্রীদের সামনে তুলে ধরছে এবং সভা, সেমিনার এর আয়োজন এর পাশাপাশি অসংখ্য দেশি, বিদেশী জার্নাল এ তাদের গবেষণা নিয়মিত প্রকাশ করছে। তারা প্রতিনিয়ত জনসচেতনতামূলক কাজে সচেষ্ট থেকে নিজেদের আত্মনিবেদন করছে।
লেখক:
মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান
প্রভাষক
মাইক্রোবায়োলজি ডিপার্টমেন্ট
স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ ।
এবং
মোঃ আফতাব উদ্দিন
সহকারী অধ্যাপক
মাইক্রোবায়োলজি ডিপার্টমেন্ট
স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড