মীর আব্দুল আলীম
রাজধানীর ৪৫/এ নিউ ইস্কাটন দিলু রোডে একটি পাঁচ তলা ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মর্মান্তিকভাবে তিনজন অগ্নিদ্বগ্ধ হয়ে মারা গেছেন। পাঁচ তলা ভবনটিতে দগ্ধ, ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আরও পাঁচজন। প্রায়ই এভাবে রাজধানীতে অগ্নিকাণ্ডে মানুষ অঙ্গার হচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে?
আগুনের কি সেই সাধ্য আছে, নিজ থেকে লেগে গিয়ে সব কিছু জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে একাকার করে দেবে? এমনকি শত স্বপ্নের জীবনটাকে? আমরাই জ্বালাই বা আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা করি। কখনো কেমিক্যাল দিয়ে, কখনো গ্যাস দিয়ে, বিদ্যুৎ দিয়ে অথবা ছোট্ট ভুলের মাধ্যমে। অনাকাঙ্ক্ষিত অগ্নি দুর্ঘটনায় হতাহতের হেডলাইন হবে। ধামাচাপায় হবে তদন্ত কমিটি গঠন। একজনের বোকামির কারণে অন্যজনের নামে ফলশূন্য মামলা। ব্যস। মানুষ চুপ। রাষ্ট্র চুপ। অপেক্ষা! এই তো চলছে।
অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ সংক্রান্ত আইন ও বিধিমালা থাকলেও তা মানছেন না সিংহভাগ ভবন মালিক। আইন লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মেয়াদে কারা ও অর্থদণ্ডসহ প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিলের মতো শাস্তির বিধানও রয়েছে। তারপরেও কাজ হচ্ছে না। আবাসিক এলাকা থেকে কেমিক্যাল গোডাউন সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে না। যারা কেমিক্যাল ব্যবসা করেন তারা অনেক প্রভাবশালী। তাই শত কিছুর পরও পুরান ঢাকার কেমিক্যাল গোডাউন রয়েই গেছে। রাজধানীর রামপুরা বনশ্রী নিরেট আবাসিক এলাকা হলেও এখানেও গাড়ে উঠছে অসংখ্য কেমিক্যাল গোডাউন। দাহ্য কেমিক্যাল গোডাউনের ব্যাপারে প্রতিবাদ করায় তিন দিন আগে বনশ্রী ডি ব্লকের ৮/৪ সড়কের কেমিক্যাল গোডাউন মালিক চড়াও হন রেডিয়েন্ট কৃষ্ণচূড়ার বাসিন্দাদের ওপর। এ কেমিক্যাল গোডাউনের কারণে স্থানীয় শতাধিক পরিবার জীবনের নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে। এভাবে রাজধানী জুড়েই দাহ্য কেমিক্যাল গোডাউন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে গোটা রাজধানী জুড়ে। এসব কেমিক্যালই আগুন ছড়িয়ে মানুষ অঙ্গার হচ্ছে।
অবাক দেশ, অবাক জাতি। ভুলে যাওয়ার ব্যাপারে আমরাই সেরা। কংক্রিটের বন (ঢাকা শহর) বানালাম আমরা। অনিয়মের সাম্রাজ্য গড়লাম। প্রতি পদে পদে বোকামির চিহ্ন রাখলাম। এখন ফলভোগে সময় চিৎকার-চেঁচামেচি করব, এটাও মূর্খতা ছাড়া কিছুই না। ভাবনাটা আগেই করার দরকার ছিল। অপেক্ষা করুন আপনার-আমার ব্যর্থতার দালানটা (শহর) পরবর্তী প্রজন্ম, বা উত্তরসূরিরা স্মৃতি হিসেবেও রাখবে না। যদি বড় আকারের ভূমিকম্প হয়, আর! গ্যাস লাইন, বিদ্যুৎ লাইন চালু থাকে, তবে উদ্ধার কাজ শুরুর পূর্বেই পরিত্যক্ত ঘোষণা করতে হবে মানুষ সমেত পুরো শহরটাকে!! কী অবাক কথা! রাজধানী ঢাকায় ভবন নির্মাণে আইন মানা হয় না, অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা থাকে না; থাকে না বিকল্প সিঁড়িও। আগুন লাগলে নিয়ন্ত্রণের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতিরও অভাব আছে। সবখানেই সমস্যা! তাহলে বাঁচার উপায় কী? আগে অসভ্যতার আগুন নেভাতে হবে। অসভ্যতার আগুন নেভায় সাধ্য কার? এর আগে বনানীর যে বহুতল ভবনে আগুন লেগেছে সেখানে অগ্নিনির্বাপণের কোনো ব্যবস্থা ছিল না, ছিল না বিকল্প সিঁড়িও। ভবনটির অনুমোদন ছিল ১৮ তলা, নকশা না মেনে করা হয় ২৩ তলা। ২৩ তলায় আগুন নেভায় এমন যন্ত্রপাতি এবং লোকবলও কম ফায়ার সার্ভিসের। তাহলে মানুষ পুড়ে অঙ্গার হওয়ার আগে আগুন নেভায় সাধ্য কার? সবখানেই অসভ্যতার ছোঁয়া তাহলে আগুনে পুড়ে মানুষ তো মরবেই! ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীর ৪৩/১ নবাবকাটরায় পাঁচ তলা বাড়িতে স্মরণকালের অন্যতম ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় হারাতে হয় ১২৩ জনকে। আহত হয় কয়েকশ মানুষ। আপনজন হারিয়ে নিঃস্ব হতে হয় অনেক পরিবারকে। মূলত কেমিক্যাল গোডাউনের আগুনেই সব স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়। গোডাউনের অতি দাহ্য রাসায়নিক পদার্থের কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। সম্পদের সঙ্গে মানুষও অঙ্গার হয়। কেমিক্যাল গোডাউন ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় যেখানে সেখানে হলে মানুষ তো পুড়ে মরবেই।
গত বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পুরান ঢাকার চকবাজারে আগুন লাগে। এ আগুনে শতাধিক মানুষ পুড়ে মরে। ঘনবসতিপূর্ণ রাজধানীর চকবাজার এলাকা। কেমিক্যালের গোডাউনে ঢাঁসা পুরো এলাকা। আগুন লাগলে তো মানুষ মরবেই। পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় প্রায় চার হাজার কেমিক্যাল গোডাউন, কারখানা রয়েছে। এসব গোডাউন ও কারখানায় বিস্ফোরক ও দাহ্য পদার্থ থাকায় আবাসিক এলাকার জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এগুলো সরনোর কথা। উচ্চ আদালতেরও নির্দেশ ছিল। কে সরাবেন? কে শোনবে কার কথা? যারা কেমিক্যাল গোডাউনগুলো সরানোর কাজ করবেন তারা তো নগদি নারায়ণ পেয়ে বিলাসী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তাই যা হওয়ার তাই হয়। এমন হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। প্রশ্ন হলো অগ্নি নিরাপত্তা নিয়ে এত উদাসীনতা কেন? বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগ মানুষের নিরাপত্তার দিকটি বিবেচনায় নিয়ে প্রতিটি ভবনে অগ্নি নিরাপত্তার কিছু বিধিমালা নির্ধারণ করে দিলেও তার কোনো প্রয়োগ নেই ভবনগুলোতে। ঢাকার বেশিরভাগ বহুতল ভবনে যথাযথ অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা না থাকায় যে কোনো মুহূর্তে ভয়াবহ দুর্যোগের আশঙ্কায় থাকে নগরবাসী। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগের সাম্প্রতিক জরিপে ঢাকার জনবহুল ভবন বিশেষ করে হাসপাতাল, শপিং মল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ দুই হাজার ৬১২টি ভবনের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা খতিয়ে দেখে। সেখানে মাত্র ৭৪টি ভবন ছাড়া বাকি সবকটি ভবন, অর্থাৎ দুই হাজার ৫৩৮টি ভবন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে জরিপে উঠে আসে। ঢাকার অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত বনানীতে কেনাকাটার জন্য বেশ জনপ্রিয় বনানী সুপার মার্কেট। অগ্নিদুর্ঘটনার হাত থেকে নিরাপদ ও কার্যকর ব্যবস্থার নাম ফায়ার হাইড্রেন্ট। বিশ্বের প্রায় সব শহরে অগ্নি দুর্ঘটনা রোধে এই ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু অপরিকল্পিত এই ঢাকা নগরীতে আজও ফায়ার হাইড্রেন্ট ব্যবস্থা গড়ে তোলার কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। নিমতলী এবং চকবাজারের ঘটনায় দেখা গেছে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা সরু অলিগলি পেরিয়ে দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারলেও প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহের অভাবে দ্রুত সময়ের মধ্যে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেননি। ফলে আগুনের ব্যাপ্তি আর ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফায়ার হাইড্রেন্ট হচ্ছে পানির একটি সংযোগ উৎস। যা পানির প্রধান উৎসের সঙ্গে যুক্ত থাকে। যে কোনো জরুরি প্রয়োজনে এই উৎস থেকে পানি ব্যবহার করা যায়। এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এর সঙ্গে লম্বা পাইপ যুক্ত করে ইচ্ছে মতো যে কোনো দূরত্বে পানি সরবরাহ করা যায়। তারা বলেন, আগুন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় বহু আগে থেকেই ফায়ার হাইড্রেন্ট ব্যবহার হয়ে আসছে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই। এটি মূলত রাস্তার ধারে স্থাপন করা এক ধরনের পানির কল। যা থেকে জরুরি পানি সরবরাহ করা যায়। যতদূর জানি, ঢাকার মানুষের জন্য প্রথম সাপ্লাই পানির ব্যবস্থা করে ঢাকার নবাব পবিবার। তখন পুরান ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ফায়ার হাইড্রেন্টের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। সেই ফায়ার হাইড্রেন্টে অগ্নি দুর্ঘটনা রোধে ব্যবহার না হলেও সাধারণ মানুষ গোসল খাওয়া দাওয়াসহ বিভিন্ন কাজেই সেই ফায়ার হাইড্রেন্ট থেকে পানি ব্যবহার করত। পরবর্তীকালে এসব পানির উৎস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অথচ এগুলো আজও চালু থাকলে প্রয়োজনীয় পানি পেতে বেগ পেতে হতো না।
শুধু ফায়ার হাইড্রেন্ট নয়, ঢাকায় এক সময় প্রচুর পরিমাণে পুকুর ডোবাসহ নানা ধরনের জলায়শও ছিল। এসব থেকে অগ্নি দুর্ঘটনারোধে সহজেই পানি পাওয়া যেত। কিন্তু কর্তৃপক্ষের চরম গাফিলতির কারণে এগুলো ভরাট, দখল হয়ে গেছে। আজ উদ্ধারের কোনো ব্যবস্থা নেই। উন্মুক্ত এসব জলাশয় বন্ধ করে দেয়ার কারণ আগুনের হাত থেকে রেহাই পেতে বা দ্রুত আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রয়োজনীয় পানি পাওয়া যায় না। দূর থেকে গাড়ি ভরে পানি এনে আগুন নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এ কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
রাজধানী ঢাকার অধিকাংশ বহুতল ভবনে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই। নেই ঠিকঠাক জরুরি নির্গমন ব্যবস্থাও। সংশ্লিষ্ট আইন ও নীতিমালা অনুসরণ না কওে তৈরি হওয়া ভবনগুলো পরিণত হয়েছে মৃত্যুফাঁদে! ফায়ার সার্ভিস বিভিন্ন সময়ে এ নিয়ে ভবন মালিকদের নোটিশ দিলেও ব্যবস্থা গ্রহণ করেন না ভবন মালিকরা। এমনকি নোটিশের জবাবও দেন না। ভবন নির্মাণ ও সম্প্রসারণে নিয়ম না মানা এবং অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ সংক্রান্ত আইন ও বিধিমালা না মানার ফলে বারবার মানুষের জীবন বিপন্ন হচ্ছে। অগ্নিকাণ্ডের ফলে প্রাণহানি, আহত হওয়ার ঘটনা ও সম্পদের ক্ষতি বেড়েই চলেছে। বছরে কয়েকশ মানুষের প্রাণ যাচ্ছে অগ্নিকাণ্ডে।
অগ্নিকাণ্ডে প্রতিরোধ ও প্রতিকারে ভবন থেকে বেরিয়ে আসার পথ এবং আগুন নেভানোর ব্যবস্থাপনা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ আগুন লাগলে মানুষ যাতে বেরিয়ে আসতে পারে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রশস্ত সিঁড়ি এবং এক ভবন থেকে আরেক ভবনের প্রয়োজনীয় দূরত্ব রক্ষা করা জরুরি।
অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা বলতে লোকজন সাধারণত বুঝে ভবনে ফায়ার এক্সটিংগুইশার থাকা। কিন্তু এটি যথেষ্ট নয়। বহুতল ভবনে আগুন নির্বাপণ ও জরুরি নির্গমনে কয়েকটি বিষয় মেনে চলা জরুরি। এগুলো হলো- রাইজার স্থাপন, স্বয়ংক্রিয় স্প্রিং কলার, আন্ডারগ্রাউন্ড পানির রিজার্ভ, ফায়ার ফাইটিং পাম্প হাউস, স্মোক ও হিট ডিটেকশন সিস্টেম স্থাপন ও ফায়ার লিফট নির্মাণ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও আমাদের অল্প কিছু ভবনেই এ নিয়ম মানা হয়। ফলে নিয়মিত বিরতিতেই অগ্নিকাণ্ডে হতাহত ও সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে। অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ সংক্রান্ত আইন ও বিধিমালা থাকলেও তা মানছেন না সিংহভাগ ভবন মালিক। আইন লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মেয়াদে কারা ও অর্থদণ্ডসহ প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিলের মতো শাস্তির বিধানও রয়েছে। তারপরেও কাজ হচ্ছে না। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সীমাবদ্ধতাসহ নানা কারণে এই আইনের প্রয়োগ নেই। নামমাত্র অনুমোদন নিয়ে বা না নিয়েই গড়ে উঠছে বহুতল ভবন, মার্কেটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। অনিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনার কারণে নিয়ম না মানা ভবন মালিকদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। ফলে একদিকে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি বাড়ছে, অন্যদিকে অগ্নিকাণ্ডের পর নির্বাপণ ব্যবস্থা ও ভবন থেকে জরুরি নির্গমন ব্যবস্থা আরও অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এসব অসঙ্গতি দূর করে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিষ্ট ও গবেষক।
ওডি/এসএইচএস
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড