রহমান মৃধা
ছোটবেলা থেকেই গান বাজনা এবং অভিনয় করা ছিল অনেকটা নেশা। প্রাইমারী এবং হাইস্কুলে পড়াকালীন সব ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছি। স্বাধীনতার রাতের অনুষ্ঠানে গান বাজনা এবং নাটকে অংশগ্রহণ করেছি। তার জন্য রাতজেগে রিহার্সাল দিতে হয়েছে।
লেখা পড়ার চেয়ে বিনোদন জগতের প্রতি আগ্রহ ছিল বেশি। যার কারণে গান বাজনা এবং অভিনয় করতেই ভালো লাগত। ক্লাস এইটে সবে উঠেছি, চিত্রজগতে নায়কের ছোটবেলার ভূমিকায় আমি অভিনয় করব।
লেখাপড়া করি গ্রামের স্কুলে অথচ এত বড় স্বপ্ন মনে এবং কিভাবে সে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়া যায় সেটাই তখন ধ্যানে, গ্যানে এবং মনে। কারও সঙ্গে বিষয়টি শেয়ার করিনি। রাতের আঁধারে টাকা এবং বেশ কিছু সোনার গয়না নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। ভোর রাত তাই খেয়া পারাপার বন্ধ। নবগঙ্গা নদীর এপারে আমার গ্রাম নহাটা, যেতে হবে নদীর ওপারের গ্রাম বাটাজোড়ে।
নদীর ঘাটে ছোট ছোট নৌকা বাঁধা। মাঝিরা শীতের রাতে কাঁথার তলে দিব্বি ঘুমে মগ্ন। এক মাঝি চাচাকে বললাম আমাকে নদীর ওপারে পৌঁছে দেও বিনিময়ে দশটাকা দেব। খেয়া পারাপারে লাগে মাত্র চার আনা। মাঝির ঘুম ভেঙ্গে গেল তৎক্ষণাত, দশটাকা কমপক্ষে দুই থেকে তিনদিনের ইনকাম! মাঝিচাচা আমাকে নদীর ওপারে পৌঁছে দিল।
বাটাজোড় থেকে প্রথম বাস সকাল ছয়টার দিকে ছাড়ে, আমি সেই বাসে করে রওনা দেব। বাসে উঠে চুপচাপ বসে আছি ভয়ে, যাতে করে পরিচিত কেও দেখে না ফেলে। বাটাজোড় থেকে মাগুরার দূরত্ব ১৪ মাইল। তখনকার সময় বাটাজোড় থেকে মাগুরা যেতে বাসে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা সময় লাগত। রাস্তার যে অবস্থা তা এ যুগে বর্ণনা করলে অনেকে বুঝবে না। বাসের অবস্থা ছিল আরও শোচনীয়। বাস দশ পনের মিটার চলে আবার বন্ধ হয়, হেলপার কম পক্ষে তিন থেকে চারজন, ইঞ্জিন গরমের কারণে ঘন ঘন পানি ঢালে বাসের ইঞ্জিনে আর পেছন থেকে গাড়ি ঠেলে প্রতিবার, ইঞ্জিন স্টার্ট দেয়ার জন্য।
এই করতে করতে ঘণ্টা খানেক পর এসে পৌঁছলাম শত্রুজিৎপুর। ড্রাইভার সাহেব চা, বিস্কুট এবং পান এসব খাবার শেষ করে আবার বাস স্টার্ট দেয়ার কাজ শুরু করলেন। বেশ ঠাণ্ডা, বৃষ্টি অনেকদিন না হওয়ার কারণে বাসের মধ্যে যে পরিমান ধুলো ঢুকেছে তাতে আমার চেহারার পরিবর্তন হয়েছে এত যে পরিচিত কেও বাসে থাকলেও চেনার আর উপায় নাই।
শত্রুজিৎপুর থেকে বাস মোড় নিল বিনোদপুরের দিকে। সে গ্রামটি পড়েছে একটু বিদঘুটে জায়গায়। রাস্তা উঁচুনিচু ভাঙ্গা, মাঝে মধ্যে গর্ত, সবাইকে বাস থেকে নেমে তা ঠেলা, পরে দৌড়ে আবার বাসে ওঠা এই করতে করতে ঘণ্টা দুই পরে মাগুরা পৌঁছলাম।
এখন মাগুরা থেকে বিআরটিসির বাসে করে ফরিদপুর যেতে হবে। বাস হঠাৎ থেমে গেল। ভেতরে জায়গা নেই। আমাকে এবং আমার ট্রাংকসহ ছাদের ওপর তুলে দিল, এবার লেও ঠেলা। বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছি, ভাইবোন ফেলে, টাকা পয়সা সোনা গয়না চুরি করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশান্তর, মনটা যে খারাপ লাগছে বা মনে ভয় কাজ করছে তার কিছুই অনুভব করার সুযোগ নেই। পুরো জার্নি আমার সমস্ত চিন্তা চেতনাকে ব্লক করে ফেলেছে।
মাগুরা থেকে সবে এসেছি কামারখালি, ফেরি পার হতে হবে। কিছুক্ষণ পর ফেরি পার শুরু হলো। পাশ দিয়ে আমার বয়সি এক ছেলে এসে বলতে লাগল ঝাল মুড়ি লাগবে, ঝাল মুড়ি। তার ঝালমুড়ি বানানোর ধরণ দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম, যেমন ঝাকাঝাকি তারপর কিছুটা বাদ্যযন্ত্রের শব্দ, পরে কাগজ মুড়িয়ে কাপের মত করে ঝাল মুড়ি হাতে ধরিয়ে দিল মাত্র চার আনার বিনিময়ে।
এ সময় দুপুর হয়ে গেছে, ঝাল মুড়ি তো না মনে হলো কোন অমৃত খাবার খেলাম। জীবনে এমন সুস্বাদু খাবার খেয়েছি বলে মনে পড়েনি তখন! কামারখালি পার হয়ে মধুখালী এলাম।
বাস থেমে গেল। রাস্তার পাশে রান্না করে সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছে নানা ধরনের মজাদার খাবার, দেখতে চমৎকার লাগছে। ড্রাইভার সাহেব যাত্রীদের বললেন গরম ভাত সঙ্গে টাটকা মাছের ঝোল দিয়ে কিছু খেলে খেয়ে নিন জলদি করে। খিদে লেগেছে, এক প্লেট ভাত আর বোয়াল মাছের পেটি দুইটাকা দিয়ে খেয়ে নিলাম। সবার খাবার শেষ হলে মধুখালী থেকে বাস ছেড়ে দিল।
কিছুক্ষণ পরে ফরিদপুরে এসে হাজির। নতুন বাস নিতে হবে ফরিদপুর- গোয়ালন্দ। গোয়ালন্দ ঘাটে পৌছে ফেরি করে প্রথমে আরিচা, পরে আরিচা ঢাকা যেতে হবে। ফেরিতে ঢুকে দেখি পদ্মা নদীর ইলিশ ভাজি এবং কাঁচকলা দিনে ইলিশ রান্না করেছে, অনেকেই বসে খাচ্ছে, আমিও বললাম, দিন ইলিশ ভাজি এবং কাঁচকলার তরকারি সঙ্গে এক প্লেট ভাত। খেলাম প্রথম তাজা ইলিশ, পদ্মা নদী থেকে ধরেই রান্না করেছে তার ঝোল এবং ভাজি, আহ কি মজা!
আমি তখনও উপলব্ধি করতে পারছি না যে আমি বাড়ি থেকে পালিয়েছি। ক্লাস এইটের ছাত্র কত হবে বয়স, বড়জোর ১৫। ফেরি থেমে গেল আরিচায়, ডাকছে, আরিচা ঢাকা নন স্টপ। বেশ, এই প্রথম শুনলাম ননস্টপ। জিজ্ঞেস করলাম ভাই মানে, বললো সরাসরি মতিঝিল গিয়ে বাস থামবে। উঠে পড়লাম বাসে। বাস একের পর এক গ্রাম, পরে শহর পার হয়ে সাভার স্মৃসৌধের কাছে এসেছে। পাশ দিয়ে বাস চলে গেল আর আমি চেয়ে চেয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখলাম।
স্বাধীন বাংলায় বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছি বটে, তবে এতো আমার নিজের দেশ, এরা সবাই তো আমার দেশের মানুষ। মায়া মমতায় ঘেরা ভাইবোন বন্ধু-বান্ধবীদের কথাও তখন মনের মধ্যে একটু জায়গা করে নিয়েছিল ক্ষনিকের তরে। হঠাৎ গণভবন এবং ঢাকা রেসেডেন্সিয়াল মডেল স্কুল পার হয়ে বাস সংসদ ভবন ছেড়ে ঢাকা কলেজ, নিউমার্কেট, বাইতুল মোকারম, সচিবালয় ছেড়ে বিকেল পাঁচটার দিকে মতিঝিল এসে হাজির হলো।
মনে পড়ে গেল সদ্যমুক্তি পাওয়া অশিক্ষিত ছবির গানের কিছু কলি। ঢাকা শহর আইসা আমার আশা ফুরাইছে/ আরে লাল লাল নীল নীল বাত্তি দেইখ্যা নয়ন জুড়াইছে/ ঢাকা শহর আইসা আমার আশা ফুরাইছে...। ‘অশিক্ষিত’ সিনেমায় গানটি গেয়েছিলেন জনপ্রিয় দুই কণ্ঠশিল্পী খন্দকার ফারুক আহমেদ এবং শাম্মী আখতার। আর অভিনয় করেছিলেন নায়করাজ রাজ্জাক এবং অঞ্জনা। এ গান তখন ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মুখে মুখে, এ গান দানা বাঁধে আমার মনে। ঢাকা শহর এসেছি ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে। সারা দেশ থেকে রোজ ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ এসে এ শহর ভরেছে। আমিও তাদের মাঝে একজন।
বয়স আমার বেশি না। কি সাহস আর কি স্বপ্ন যা পূরণ করতে একা চলে এসেছি, এই অচেনা অজানা শহরে। এখন কি হবে? কোথায় যাব, কোথায় থাকব, কোথায় ঘুমাব! আমার জীবনের সব কিছু অন্ধকার তবে শহরে শুধু লাল লাল নীল নীল ‘বাত্তি জলতাছে’।
সারা পথে এসব চিন্তা মাথায় ঢোকেনি, কি করি হঠাৎ মনে পড়ে গেল দূর সম্পর্কের এক দাদা মতিঝিল রেলওয়েতে চাকুরী করেন শুনেছি। একজন রিকশাওয়ালাকে বললাম,চাচা আমাকে রেলওয়ে স্টেশনে নিয়ে চলুন। রিকশাওয়ালা বললেন ঠিকানা? আমি বললাম স্টেশন চলুন আগে পরে ঠিকানা জানা যাবে। ভাগ্য ভালো বলতে হবে, কারণ স্টেশনে এসে দাদার পরিচয় দিতেই তাঁর বাসার ঠিকানা পেয়ে গেলাম। চলে গেলাম সেখানে।
দাদা আমাকে দেখে খুশির চেয়ে ভিতু হয়েছেন বেশি, শুনে একা একা বাড়ি থেকে পালিয়েছি, সর্বনাশ! দাদাকে বলেছি বাড়ি খবর দিলে আপনার কাছ থেকেও কিন্তু পালাব। দাদা রাজি হলো, বেশ চলছে আমার দিনকাল।
বাবা পুলিশের এসবিতে চাকুরি শেষ করে সবে বাড়িতে এসেছেন। তিনি আমার নিঁখোজ সংবাদ গোয়েন্দা পুলিশের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন, একইসঙ্গে ঢাকা শহরে এসে নিজেও খোঁজ খবর চালিয়ে আমার সন্ধান বের করেন। কান্নার মাঝে বলছেন, তোমার মা প্রায় মৃত্যশয্যায়, কিভাবে তুমি এমনটি করতে পারলে ইত্যাদি’। মাকে টেলিগ্রাম করে দিলেন সঙ্গে সঙ্গে যে আমার সন্ধান পাওয়া গেছে চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।
পরেরদিন সকালে বাবা নিয়ে গেলেন আমাকে এফডিসিতে। পরিচয় করিয়ে দিলেন নানা ধরণের উচ্চ পদস্ত কর্মকর্তা থেকে শুরু করে কিছু অভিনেতাদের সঙ্গে। তারা চিত্র জগৎ এবং তার নিয়ম কানুন সম্পর্কে সব জানালেন।
পরে গেলাম বিএএফ অফিসার্স মেসে, দেখলাম পাইলটদের লাইফস্টাইল। পিজি হাসপাতাল, সচিবালয়, গণভবণ সব কিছু ঘুরিয়ে দেখালেন। নানা ধরনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরিচয় এবং তাদের মূল্যবান বানী শোনা এবং জানা হলো।
ঢাকা ছেড়ে বাড়ি ফেরার পথে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আবার ঢাকায় আসব ফিরে। বাড়িতে এসে নহাটা হাইস্কুল ছেড়ে গ্ঙ্গারামপুর হাইস্কুলে দুইবছর পড়ালেখা করি। পরে ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ থেকে এইচ এস সি শেষ করে ১৯৮৫ সালে দেশ ছেড়ে উচ্চশিক্ষার্থে সুইডেন পাড়ি দেই।
তারপর থেকে চলছে জীবন তার আপন গতিতে। জীবন চলার পথে অনেক কিছু ঘটে বা ঘটতে পারে। অনেক সময় দেখা যায় ভুলের মাঝে নতুন শিক্ষা বা নতুন কিছু জানার সৌভাগ্য হয় এবং যা পুরো জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। আমার বাড়ি থেকে পালানো ছিল জীবনের এক লেসন লার্ন্ড ( lesson learned) যা আমার জন্য ছিল এক শিক্ষনীয় বিষয়।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড