রহমান মৃধা
মনে হচ্ছে সুশিক্ষার ওপর লেখালেখি করার এক চমৎকার সময় এটা। আজকের লেখার বিষয়বস্তু হবে কিছুটা ভিন্ন ধরনের।
এ খুবই প্রয়োজন বিশ্বব্যাপী চলাচল, বেঁচে থাকা, ব্যবসা-বাণিজ্য করা, বিভিন্ন জাতির মধ্যে ভালোবাসার সেতু তৈরি করে সৌজন্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ বজায় রাখা এবং মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য।
আমাকে দিয়ে শুরু করি। এইচএসসি পাস করে উচ্চশিক্ষায় বিদেশ যাত্রা করি সুইডেনে। সুইডেনের বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্ডার গ্র্যাজুয়েট পড়তে তখন (১৯৮৪ সাল) প্রয়োজন এইচএসসি বা বিএসসি পাস সঙ্গে TOEFL বা IELTS স্কোর ৫০০ কমপক্ষে।
এর সঙ্গে ৪০ হাজার সুইডিস ক্রোনার প্রতি বছর ব্যাংকে থাকতে হবে। প্রথম ছয় মাস ভাষা শিখতে হবে এবং আমার ক্ষেত্রে সুইডিস ভাষা শেখার মাধ্যম হবে ইংরেজি।
এক বছরের মধ্যে শিখতে হবে সুইডিস ভাষা এবং তারপর এই সুইডিস ভাষাতে করতে হবে লেখাপড়া। নতুন জীবন শুরু হবে এই নতুন ভাষার মধ্য দিয়ে।
১৯৮৫-১৯৯০ এই পাঁচ বছর সময়ের মধ্যে অঙ্ক, রসায়ন,পদার্থবিজ্ঞান, কম্পিউটার এগুলো পড়তে হয়েছিল সুইডিস ভাষাতে। বুঝে মুখস্থ করে নয়।
তারপর চাকরি করা, বিয়ে করা, সামাজিকতা বজায় রাখা, সবই হয়েছে সম্ভব এই সুইডিস ভাষাকে মাধ্যম করে। সুইডিস ভাষা শিখার উদ্দেশ্য ছিল একটাই তা হলো এই ভাষার মাধ্যমে সব কিছু জানতে হবে এবং শিক্ষাগ্রহণ করতে হবে।
যেমন “জল পড়ে পাতা নড়ে”, পাতার ওপর যে দেশেই জল পড়ুক না কেন, পাতা নড়বেই, এ এক ইউনিভার্সাল ট্রুথ, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ভাষার ভিন্নতা রয়েছে সত্যি কিন্তু সামগ্রী এক এবং অভিন্ন।
অন্যান্য ভাষার মতো আরবি ভাষা শেখারও একটি গুরুত্ব রয়েছে বিশেষ করে ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী আমাদের জন্য.
কারণ পবিত্র কুরআন শরিফ আরবি ভাষাতে নাজিল হয়েছে। তাই আমাদের জন্য এ ভাষা শেখা বা বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ তাতে কারো কোনো সন্দেহ নেই বা থাকার কথা নয়। আমার ভাবনা থেকে এই বিষয়ে কিছু কথা বলতে চাই।
৫৭০ সালে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্ম, ৬১০ সাল থেকে তাঁর ওপর কোরআন শরিফ নাজিল হতে শুরু হয় এবং তখন থেকে মুসলিমরা রাজ্যবিজয় ও ইসলাম প্রচারের জন্য দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়েন।
তখন থেকে শুরু হয় সারা মুসলিম বিশ্বে আরবি পড়া, মুখস্থ করা এবং শেখা। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ২০১৮ সাল এখনও আমি জানি না কত জন বাংলাদেশি মুসলিম পবিত্র কোরআন শরিফ পড়তে পারে, বুঝে।
মুখস্থ বিদ্যা হিসেবে কোরআন শরিফের পরিচিতি এত বেশি যা পৃথিবীর অন্য কনো গ্রন্থের ক্ষেত্রে আছে বলে আমার জানা নেই।
তবে এই পবিত্র কোরআন শরিফ বোঝার জন্য মুষ্টিমেয় লোক তাদের মতো করে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন যুগ যুগ ধরে কিন্তু কেন?
জানা এবং বোঝার জন্যেই নিশ্চিত ছাত্ররা মাদ্রাসা বা বিভিন্ন ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছে। অথচ তাদের শিক্ষা হচ্ছে কী, তেমনভাবে যেমনটি হয়েছিল আমার ক্ষেত্রে আমি যখন পড়েছিলাম সুইডেনে?
আমার প্রশ্ন কেন শুধু ছেলেরা মাদ্রাসাতে পড়ছে? কেন খুবই কমসংখ্যক মেয়েরা পড়ছে সেখানে? তাদেরও তো সমপরিমাণ অধিকার রয়েছে ধর্মীয় শিক্ষাগ্রহণ করার?
এসেছিলাম সুইডেনে শিক্ষাগ্রহণ করতে, তাদের ভাষায় তাদের কথা বুঝতে, শিখতে, মুখস্থ করতে নয়।
আজ বাংলাদেশের একটা ভিডিও ক্লিপ দেখলাম যেখানে মসজিদের আশপাশে পাবলিক টয়লেটের ব্যবস্থা রয়েছে এবং তার পাশে দেয়ালে বাংলাতে লেখা রয়েছে “এখানে প্রস্রাব করা নিষেধ” সত্ত্বেও বেশির ভাগ লোক প্রস্রাব করছে দেয়ালের আশপাশে।
আমাদের মাননীয় ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সেখানে নতুন এক ইনোভেটিভ চিন্তার উদয় হয়েছে, তারা বাংলায় ওই লেখাটা মুছে সেখানে আরবিতে লিখে দিয়েছে একই কথা।
এখন কেউ আর প্রস্রাব করছে না দেয়ালে। কারণ আরবি লেখা দেখেই সবাই প্রস্রাব না করে চলে যাচ্ছে। এটা একটি বড় সাফল্য বলে কর্তৃপক্ষ মনে করছেন।
আমার ভাবনা, যদি সবাই বুঝত লেখাটার মানে কী এবং মানে জানার পরেও মানুষ কি প্রস্রাব করত সেখানে?
নিজের ভাষা বা নীতিবোধ ও অস্তিত্বকে অবজ্ঞা করে অন্যের ভাষা বা অস্তিত্বের ওপর শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা। জানি না এ বিষয়ে কোনো ধর্মে বা সমাজে তেমন কিছু বর্ণিত আছে কিনা!
শুধু আরবি লিখা দেখে অনেকেই প্রস্রাব থেকে বিরত হলো অথচ একই কথা লেখা ছিল মাতৃভাষাতে তা সত্ত্বেও সবাই সেখানে প্রস্রাব করেছে।
জেনেশুনে অন্যায় কাজ করা আর না জেনে অন্যায় কাজ না করা। ভয়, রেসপেক্ট, না নীতি ও মূল্যবোধের অবনতি? বাংলাদেশে যে পরিমাণ মাদ্রাসা বা ধর্ম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে সেখানে কী শিক্ষা হচ্ছে?
কীভাবে শিক্ষা প্রদান করা হচ্ছে? তা আমি জানি না, তাই প্রশ্ন সেখানে কি তেমন করে আরবি ভাষা শেখানো হয়, যেমনটি আমাকে সুইডিস বিশ্ববিদ্যালয় শিখিয়েছিল?
এক বছরের শিক্ষা আমাকে পুরো সুইডিস ভাষা শিখতে সাহায্য করেছিল। যেভাবে সাধারণ সুইডিস নাগরিকরা জীবনযাপন করে সুইডিস ভাষার সঙ্গে, ঠিক সেভাবে শিক্ষা দিয়েছিল।
তা যদি হয় তবে নিশ্চিত যারা আরবি লাইনে পড়াশোনা করছে তারা সবকিছু বুঝে এবং জেনে শিক্ষাগ্রহণ করছে এবং সব সাবজেক্টই তারা আরবিতে পড়ছে।
আর তা যদি না হয় তবে আমার প্রশ্ন শুধু আরবি ভাষা শেখার জন্য তো আলাদা স্কুল-কলেজ থাকার কথা নয়? আরবি ভাষা শিক্ষার পদ্ধতি তো সাধারণত অন্য ভাষার মতোই হওয়ার কথা?
ব্যতিক্রম হতে পারে যদি কেউ ধর্ম নিয়ে গবেষণা করে বা ধর্মীয় প্রফেশনের সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে চায় অথবা যদি আরবিতে সব সাবজেক্টই পড়ানো হয় যেমন অঙ্ক থেকে শুরু করে রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান ইত্যাদি ইত্যাদি!
আরবিতে পড়াশোনার মধ্য দিয়ে যদি অর্থ বোঝানো বা শেখানোর পদ্ধতি না জানা থাকে তাহলে সে শিক্ষাঙ্গনগুলোতে দ্রুত কার্যকর সুশিক্ষার ব্যবস্থা চালু করতে হবে, তা নাহলে এ শিক্ষা জাতির জন্য উপযোগী হবে না।
হবে না ধর্ম শিক্ষার প্রতিফলন, হবে না তার মূল উদ্দেশ্য সফল। না বুঝে বা মুখস্থ করে পড়লে কি হয়, এবার সে বিষয়ে কিছু লিখি।
আমাদের মন একটি চলমান অনুভুতি যাকে এক জায়গায় ধরে রাখা কঠিন যদি মুহূর্তটি আনন্দময় না হয় বা বিশাল প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম না হয় মনের ওপর।
একটি উদাহরণ দিতে চাই। আমরা যখন নামাজ পড়ি পাঁচ ওয়াক্ত, নামাজের সঙ্গে কতগুলো সুরা মুখস্থ পাঠ করি, ভাবুন নামাজের মধ্যের সময় মনের মধ্যে কত ধরনের কথা উদয় হয়।
কীভাবে আমাদের মন দেশ-বিদেশ বা দৈনন্দিন জীবনের অনেক স্মৃতিচারণ করে? মনকে এক জায়গাতে ধরে রাখা বিরাট কঠিন ব্যাপার।
“হেয়ার অ্যান্ড নাও কনসেপ্টের মধ্য দিয়ে”, মনকে কন্ট্রোলে রাখতে হলে দরকার কলুষতামুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত এবং দুশ্চিন্তামুক্ত মন রাখা এবং অবস্থার সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করার কৌশল তৈরি করা। এই কৌশল তৈরি করতে হলে দরকার প্রশিক্ষণের।
যেহেতু সুশিক্ষার জন্য সংগ্রাম তাই এই প্রশিক্ষণ পেতে হলে জানতে হবে, জানতে হলে শিখতে হবে, শিখতে হলে মন দিয়ে পড়তে হবে এবং বুঝতে হবে, সঙ্গে “হেয়ার অ্যান্ড নাও কনসেপ্ট” ব্যবহার করতে হবে।
সোনার বাংলা পেতে হলে ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধ নয়, (এ শুধু সমাজে ঘৃণা এবং প্রতিশোধমূলক আচরণ সৃষ্টি করবে, বাড়বে অরাজকতা, অবনতি হবে গণতন্ত্রের), দরকার সুশিক্ষার।
একই সঙ্গে সুস্থ পরিচালনার, ম্যানেজমেন্ট বাই থ্রেট্স নয় দরকার ম্যানেজমেন্ট বাই অবজেক্টিভস এবং তার জন্য প্রয়োজন বিশেষায়িত শিক্ষা প্রশিক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয়ের।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড