• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩০ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

বোসের ‘চিন্তন’ মরেনি; ছড়িয়ে গেছে কোটি বাঙালির অন্তরে   

  শব্দনীল

২৩ জানুয়ারি ২০২০, ১৬:০৩
সুভাষচন্দ্র বসু
নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু (ছবি : সংগৃহীত)

‘কোনো একটা চিন্তনের জন্য একজন মৃত্যুবরণ করতে পারেন। কিন্তু সেই চিন্তনের মৃত্যু হয় না। সেই চিন্তন একজনের মৃত্যুর পর হাজার জনের মধ্যে ছড়িয়ে যায়।’

কথাটি যিনি বলেছিলেন তিনি ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক কিংবদন্তি নেতা। জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন দুবার। ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতের পূর্ণ ও সত্বর স্বাধীনতার দাবি জানাতে গিয়ে এগারো বার হয়েছিলেন কারারুদ্ধ। তার কণ্ঠে ভেসে উঠেছিল ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব।’ বলছি নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর কথা।

আজ এই মানুষটির জন্মদিন।

তিনি ১৮৯৭ সালের ২৩ জানুয়ারি ভারতের ওডিশা রাজ্যের কটক শহরে (ওডিয়া বাজার) জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন কটক-প্রবাসী বিশিষ্ট বাঙালি আইনজীবী জানকীনাথ বসু ও প্রভাবতী দেবীর চৌদ্দ সন্তানের মধ্যে নবম। ছোটবেলা থেকেই সুভাষচন্দ্র, পড়াশোনার বিষয়ে ভীষণ মনোযোগী ছিলেন। তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় কটকের এক প্রোটেস্ট্যান্ড ইউরোপীয় স্কুল থেকে এবং তিনি ১৯০৯ সালে ভর্তি হন কটকের রাভেনশো কলেজিয়েট স্কুলে। কটকের রাভেনশো কলেজিয়েট স্কুলে পড়ার সময় তিনি প্রিন্সিপাল বেনিমধাব দাসের ব্যক্তিত্বের ওপর বিশেষভাবে প্রভাবিত হন। তারই সহযোগিতায় ছোট্ট সুভাষ, স্বামী বিবেকানন্দের বই পড়তে আগ্রহীও হয়ে পড়েন।

সুভাষচন্দ্র বোস অবশ্য পরবর্তীকালে তার লেখায় উল্লেখ করেছিলেন, স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও লেখা বই সুভাষকে একজন স্বাধীনতা সংগ্রামীতে পরিণত করেছিল এবং স্বামীজির লেখা বই পড়েই তার জীবনের আসল উদ্দেশ্য খুঁজে পেয়েছিল।

সুভাষচন্দ্র বসু ১৯১১ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় কলকাতা থেকে প্রথম স্থান অধিকার করেন ও ১৯১৮ সালে স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে দর্শনে সাম্মানিক সহ বি.এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপরে তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজউইলিয়াম হলে উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হন। উচ্চশিক্ষার সম্পূর্ণ হওয়ার পরে তিনি সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন এবং নিয়োগপত্র পেয়ে যান। কিন্তু বিপ্লব-সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সেই নিয়োগ প্রত্যাখ্যান করেন। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘কোনো সরকারের সমাপ্তি ঘোষণা করার সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা হলো তা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া।’

চাকরি প্রত্যাখ্যান করার পর তিনি ইংল্যান্ড থেকে ভারতে চলে আসেন এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগদান করেন। তার এই দলে যোগদান করার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল, ভারতকে যেভাবেই হোক ব্রিটিশদের হাত থেকে মুক্ত করা। ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল যখন অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকাণ্ড ও দমনমূলক রাওলাট আইন সমস্ত ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের বিক্ষুব্ধ করে তোলে। তখন তিনি ‘স্বরাজ’ নামক পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন এবং বঙ্গীয় প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির প্রচারের দায়িত্বে নিযুক্ত হন। ১৯২৪ সালে যখন কলকাতা পৌরসংস্থার মেয়র হন চিত্তরঞ্জন দাশ তখন তিনি চিত্তরঞ্জন দাশের অধীনে কাজ করতেন। এই চিত্তরঞ্জন দাশই ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসুর রাজনৈতিক গুরু।

রাজনৈতিক জীবনে সুভাষচন্দ্র বসু মোট ১১ বার গ্রেফতার হয়েছিলেন এবং তাকে ভারত ও রেঙ্গুনের বিভিন্ন জায়গায় রাখা হয়েছিল। ১৯৩০ সালে তাকে ইউরোপে নির্বাসিত করা হয়। ১৯৩৪ সালে তিনি ভিয়েনাযতে এমিলি সেচঙ্কলের সাথে পরিচিত হন এবং ১৯৩৭ সালে তাকে বিয়ে করেন।

সুভাষচন্দ্র বোসের হৃদয় জাতীয়তাবাদের ধারায় ভরা ছিল, তাই স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য তার ভিতর জাতীয়তাবাদী মনোভাব, ব্রিটিশদের কাছে খুব ভালো খবর ছিল না। তারা প্রত্যেকে সুভাষচন্দ্রের প্রতি সর্বদা সতর্ক থাকতেন। সাল ১৯৩০, যখন সুভাষকে সমগ্র ইউরোপ থেকে নির্বাসিত করা হয়, তখনো তিনি বাকি অন্যান্য দেশে থেকে নিজের দেশকে স্বাধীন করার কাজে তখনও লিপ্ত থাকেন। পরে, তিনি একবার নিজের দেশেও ফিরেছিলেন শুধুমাত্র তার বাবার অন্ত্যোষ্টিক্রিয়া করার জন্য। তারপর আবার আত্মগোপন করেন।

১৯৩৮ সালে ভারতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি আর ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয়বারের জন্য ত্রিপুরা অধিবেশনে কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। সুভাষচন্দ্র বসু এই নির্বাচনে জয়লাভ করলেও গান্ধীজির বিরোধিতার ফলস্বরূপ তাকে বলা হয় পদত্যাগপত্র দিতে; নাহলে কার্যনির্বাহী কমিটির সব সদস্য পদত্যাগ করবে। এইসব নানা কারণে তিনি অবশেষে নিজেই কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করেন এবং ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ নামক একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। তবে সেই সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায় আর সেই যুদ্ধে ভারতীয় সেনারা ব্রিটিশদের পক্ষে যুদ্ধে যোগ দেয়। ভারতবর্ষের এইভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করার ব্যাপারে সুভাষচন্দ্র বসু ভীষণভাবে ব্যথিত হন। তিনি সেই সময় গৃহবন্দি ছিলেন কিন্তু মনে মনে তখন তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন দেশত্যাগ করার। অবশেষে তার দলের একজন সদস্যকে নিয়ে তিনি, আফগানিস্তান ও সোভিয়েত ইউনিয়ন হয়ে জার্মানি পালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। সেখানে গিয়ে তিনি প্রথমে বার্লিনে ‘ভারতীয় মুক্ত কেন্দ্র’ গড়ে তোলেন, আর তারপর ভারতের স্বাধীনতার জন্য তিনি জার্মান নেতা এডলফ হিটলারের সাহায্য চান।

ভারতের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সাহায্যের ব্যাপারে এডলফ হিটলারের কোনো ইচ্ছা না থাকায়, তিনি তা বুঝতে পেরে খুব দুঃখ পান। এরপর ১৯৪৩ সালে তিনি অবশেষে জার্মানি ত্যাগ করেন এবং একটি সাবমেরিনে চেপে পোঁছে যান জাপানে, হিদেকি তোজোর সাহায্যের আশায়।

সেইসময় জাপানে রাসবিহারি বসু গড়ে তুলেছিলেন ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনী। ১৯৪৩ সালে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর হাতে তিনি সেই বাহিনীর দায়িত্ব তুলে দেন। নারী-পুরুষ মিলিয়ে এই বাহিনীতে মোট সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৮৫০০০ মতো। পরে অবশ্য এই বাহিনীর নাম বদলে ‘আজাদ হিন্দ’ করে দেওয়া হয়। সুভাষ চন্দ্র বসু আশা করেছিলেন, ব্রিটিশদের ওপর তার সৈন্যবাহিনীর হামলার খবর শুনে বিপুল সংখ্যক সৈন্য ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে হতাশ হয়ে সেখানে যোগ দেবে কিন্তু তা একদমই হয়নি। কারণ খুব সংখ্যক ভারতীয় সেনা সেই হামলার পর তার বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে যখন জাপান আত্মসমর্পণ করে আমেরিকার কাছে, তখন সেইসাথে তার জাতীয় সেনাবাহিনীও আত্মসমর্পণ করে নেয়। জাপানের এই ঘোরতর দুর্দশার পর নেতাজী, ১৮ আগস্ট ১৯৪৫ সালে জাপানের তাইহুকু বিমানবন্দর থেকে প্লেনে করে যাওয়ার সময় দুর্ঘটনার কবলে পড়েন এবং সেইসাথে মারা যান। যদিও তার এই মৃত্যুর সত্যতা সম্পর্কে আজও মানুষ অজানা। কেউ ঠিকভাবে জানেন না যে, সেই দিনটির পর নেতাজীর কি হলো। অনেক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই ঘটনা একদম ভুয়ো। নেতাজীর জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে উঁচুতলার কিছু ভারতীয় নেতারা এবং ইংরেজ সরকার মিলিতভাবে ষড়যন্ত্র করে তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুভাষচন্দ্রকে ‘দেশনায়ক’ আখ্যা দিয়ে তাসের দেশ নৃত্যনাট্যটি তাকে উৎসর্গ করেছিলেন তিনি। উৎসর্গপত্রে লেখেছিলেন, ‘স্বদেশের চিত্তে নূতন প্রাণ সঞ্চার করবার পূণ্যব্রত তুমি গ্রহণ করেছ, সেই কথা স্মরণ করে তোমার নামে ‘তাসের দেশ’ নাটিকা উৎসর্গ করলুম।’

চলমান আলোচিত ঘটনা বা দৃষ্টি আকর্ষণযোগ্য সমসাময়িক বিষয়ে আপনার মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাই, সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইলকরুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড