• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৬ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

নতুন আইন হলো, তবু কেন সড়কে মৃত্যুর মিছিল

  মীর আব্দুল আলীম

২৯ ডিসেম্বর ২০১৯, ২০:১০
সড়ক দুর্ঘটনা
সড়ক দুর্ঘটনা (ছবি : প্রতীকী)

সড়ক নিরাপদ করতে আইন হয়েছে। ভেবেছিলাম সড়ক এবার হয়তো নিরাপদ হবে। তবে তা হয়নি। সর্বশেষ চলতি মাসের ২৮ তারিখ ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুন্ডে ফৌজদারহাট বাইপাস সড়কে একই পরিবারের দুই মেয়েসহ বাবা নিহত হয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের যুগ্ম পরিচালক সাইফুজ্জামান পরিবার নিয়ে বান্দরবানে বেড়াতে গিয়ে ঢাকায় ফেরার পথে ওই দুর্ঘটনার শিকার হন।

এ দেশে কত শত সাইফুজ্জামানের মৃত্যু হচ্ছে। প্রতিদিন সড়কে মূল্যবান প্রাণ যাচ্ছে। রাজীবের হাত, কারও পা যাচ্ছে, মিশুক-মনির, সাইফুর রহমানদের জীবন যাচ্ছে। থামছে না সড়কে মৃত্যুর মিছিল। আমরা বিশেষ দু-একজনের জন্য আহ্ উহ্ করি। প্রতিদিন কত খালিদ, কত হৃদয় পঙ্গু হচ্ছে, জীবন দিচ্ছে তার খোঁজ কি রাখি? আমরা কেন মৃত্যুর মিছিল রোধ করছি না? কেবল আলোচিত ঘটনায় মন্ত্রী-এমপিরা ছুটে যায়, স্বজন কিংবা লাশের পাশে। আমরা মায়া কান্না করি; লাভ কী তাতে?

এ দেশে আইন হয় আইনের সঠিক প্রয়োগ হয় না কখনো। দুঃখজনক হলেও সত্য এ দেশে আইন নিয়ন্ত্রণ করেন সড়ক পরিবহন নেতারা। আরও কষ্টের কথা হলো- সড়ক পরিবহনের শীর্ষ নেতা সরকার দলেরই শীর্ষ পদের। সড়ক নিরাপদ করতে নয়া আইন হয়েছে। তা বাস্তবায়ন শুরু হয় ১ নভেম্বর ২০১৯ থেকে। শুরুতে তর্জন গর্জন শুনেছি। ভালো লেগেছে। পরে দেখলাম শ্রমিক নেতাদের দেনদরবারে হঠাৎ থমকে গেছে সরকার ও প্রশাসনের আইন প্রয়োগের কার্যক্রম।

সড়ক নিয়ে আন্দোলনে নামা নিরাপদ সড়ক চাই এর প্রতিষ্ঠাতা ইলিয়াস কাঞ্চন উল্টো শাজাহান খানের হুমকির মুখে পড়েন। থমকে গেছে সড়ক আন্দোলনও। তাই রাস্তায় আগের চেয়ে বেপরোয়া চালক। যা হবার তাই হচ্ছে সড়কে। মাঝে মাঝে আইন প্রয়োগের কথা উঠলে; বড় কোনো দুর্ঘটনায় সরকার মহলের হুঙ্কার শুনলে তৃপ্ত হই এই ভেবে যে এই বুঝি সড়ক নিরাপদ হচ্ছে। নিরাপদ সড়কের জন্য হাজারো হুঙ্কার আন্দোলন, ধর্মঘট, মিছিল, সমাবেশ কতকিছুই না হয়; সড়ক আর নিরাপদ হয় না।

সম্প্রতি উচ্চ আদালত ফিটনেসবিহীন গাড়ি সড়কে না চলতে নির্দেশনা দিয়েছেন। ফিটনেসবিহীন গাড়ি এখনো সড়কে চলছে। তবে ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযান চললে সড়কে গাড়ি সংখ্যা কমে যায়। এতে জনগণের ভোগান্তির সৃষ্টি হয় উল্লেখ করে সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, 'আমরা বিকল্প ব্যবস্থার বিষয়টি গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করছি।' এটা কিন্তু সরকারের উল্টো পথে হাঁটারই লক্ষণ। সরকার শিথিল হলে আইনের প্রয়োগ না হলে সড়কে মানুষ তো মরবেই।

সম্প্রতি উচ্চ আদালত ফিটনেসবিহীন গাড়িতে জ্বালানি সরবরাহ না করতে নির্দেশনা দিয়েছেন। জালানি পাম্পগুলোতে সাইনবোর্ডও লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে- 'ফিটনেস ছাড়া জ্বালানি সর্বরাহ করা হয় না।' সে নির্দেশ এখন অকার্যকর। সড়ক ও পরিবহনমন্ত্রী বললেন, হাইকোর্টের নির্দেশনায় ‘বাস্তবতার নিরিখে’ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তেল দেয়ার বিষয়টি জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের। পাম্প তো জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের, তারা এ আদেশ মানার প্রক্রিয়ায় কতটুকু এগিয়েছে, তা জানি না বলেছেন মন্ত্রী।

হাইকোর্ট যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, আমরা দেখেছি সিদ্ধান্ত দেওয়ার আগেও হেলমেট না থাকলে তেল নয়, যে ব্যবস্থা করা হয়েছিল, সেটি কার্যকর হয়েছে। কাজেই ফিটনেস বিহীন গাড়িতে তেল সরবরাহ না করার এ বিষয়টি জনস্বার্থে মেনে নেওয়া দরকার।

এবার নয়া ‘সড়ক আইন ২০১৯’ মনে আশা জাগে বড়; তবে মনে জোর পাইনি। আমাদের কত কিছুর জন্যই তো আইন আছে প্রয়োগ হয় কয়টা? সড়ক আইন ছিল আগেও এখনো আছে। প্রয়োগ হয় কি? নয়া আইনের প্রয়োগ নিয়েও মনে প্রশ্ন উঁকি দিয়েছে বহুবার। অসভ্য খুনে সড়ক কি আদৌ নিরাপদ হবে কখনো? মনে বড় সংশয়। সড়ক ঠিকই নিরাপদ হবে। কিছু কিছু ঘটনায় দেখেছি প্রধানমন্ত্রী নাড়া দিলে সব নড়ে চড়ে ওঠে। তিনি দৃষ্টি দিলে সব সহজে হয়ে যায়। এবারও তিনি সড়ক নিরাপদ করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। আন্দোলনের ভয়ে হয়তো সেই নির্দেশনা অকার্যকর হয়ে আছে। মনে প্রশ্ন জাগেই, আদৌ কি খুনে সড়ক আমাদের জন্য নিরাপদ হবে? থামবে কি সড়কে মৃত্যুর মিছিল?

সড়কে আইন মানছে না কেউ। আসলে সড়কে আইন মানতে বাধ্য করা হয় না। তাহলে কীভাবে সড়ক নৈরাজ্য থামবে? এ নিয়ে সরকার সংশ্লিষ্টদের ভাবনা কম। যারা সড়কে আইন মানানোর কাজ করেন তারাই আইন মানেন না। আমরা কি অন্ধ? আমরা কি কালা (কানে কম শুনি)? প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মরছে, প্রতিদিন সংবাদপত্রগুলো ফলাও করে সংবাদ ছাপছে।

এমন কোনো দিন নেই, যে দিন সড়ক দুর্ঘটনা হচ্ছে না। বিগত এরশাদ সরকারের আমলে সড়ক দুর্ঘটনা অস্বাভাবিক বেড়ে গেলে সরকার কঠোর আইন প্রণয়ন করেন। কিন্তু পরিবহন শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে পড়ে তা রহিত করতে বাধ্য হয় সরকার। এরপর থেকে বিভিন্ন সরকারকে পরিবহন শ্রমিকদের দাবি দাওয়ার কাছে প্রায় জিম্মি থাকতে দেখা যাচ্ছে। দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িত চালকদের বিচারের কাঠগড়ায় নিয়ে আসার ঘটনা এ দেশে বিরল। দেখা গেছে, প্রায় সব কটি দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেই চালকরা পার পেয়ে গেছেন।

এ দেশে সড়ক দুর্ঘটনা স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক নয়, তা হচ্ছে মানবসৃষ্ট কারণে। এই হিসেবে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতরা পরোক্ষভাবে হত্যারই শিকার। কিন্তু হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনার কাঙ্ক্ষিত উদ্যোগ নেই। ফলে সড়ক দুর্ঘটনা না কমে জ্যামিতিক হারে বেড়েই চলেছে।

সরকারি হিসাবে গত ১০ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মারা গেছে ৩৪ হাজার ৯১৮ জন। প্রতি বছর মারা যায় ৩ হাজার ৪৯১ জন। বেসরকারি হিসাবে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে ২০ হাজার ৩৪ জন। প্রতিদিন গড়ে মারা যাচ্ছে প্রায় ৫৫ জন। সরকারি তথ্য ও বেসরকারিভাবে প্রাপ্ত তথ্যের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান থাকার কারণ হলো, দুর্ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের ৬৭ ধরনের প্রশ্নের উত্তর সংগ্রহ করে প্রতিবেদন জমা দিতে হয়। এ ঝামেলার কারণে অনেক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর বিষয়টি যথাযথভাবে রেকর্ডভুক্ত হয় না। পুলিশের দেওয়া তথ্যানুযায়ী ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ২ হাজার ১৪০ জন। মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে ১ হাজার ১৮৬ এবং সামান্য আহত হয়েছে ১৫৭ জন। অন্য একটি প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী ২০১০ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৭২ হাজার ৭৪৮টি। মারা গেছে ৫২ হাজার ৬৮৪ জন। আহত ও পঙ্গু হয়েছে আরও কয়েক হাজার মানুষ।

২০১৯ সালে প্রকাশিত এক আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এশিয়া, ইউরোপ এবং অস্ট্রেলিয়ার ১৫টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার নেপালে বেশি, দ্বিতীয় বাংলাদেশে। সবচেয়ে কম হার যুক্তরাজ্যে। এ পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতি ১০ হাজার নিবন্ধিত যানবাহনের দুর্ঘটনায় নেপালে মারা যায় ৬৩ জন এবং বাংলাদেশে ৬০ জন। যুক্তরাজ্যে এ হার মাত্র ১ দশমিক ৪ শতাংশ।

সড়ক দুর্ঘটনাজনিত ক্ষয়ক্ষতির সাম্প্রতিক এক গবেষণা তথ্যে দেখা যায়, সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে ৭ হাজার কোটি টাকারও বেশি সম্পদহানি হয়। এই হার দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ দশমিক ৯৫ শতাংশের সমান। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির হার উন্নত দেশগুলোর তুলনায় শতকরা ৫০ ভাগ বেশি। অন্য এক গবেষণা জরিপ থেকে জানা যায়, ৪৮ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার জন্যে দায়ী যাত্রীবাহী বাস, ৩৭ শতাংশ দায়ী ট্রাক। দেশে সন্ত্রাস দমনে যদি বিশেষ বাহিনী গঠন করা যায়, তাহলে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে এ জাতীয় বাহিনী গঠন করা হচ্ছে না কেন? জানমাল রক্ষা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আইন না মানাই হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। সবাইকে আইন মানতে বাধ্য করতে হবে।

দুর্ঘটনার অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার, অতিরিক্ত যাত্রী এবং পণ্য পরিবহন, ট্রাফিক আইন না মানা, সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বে অবহেলা, চালকদের বেপরোয়া মনোভাব, অদক্ষতা ও অসতর্কতা, অরক্ষিত রেললাইন।

সড়ক দুর্ঘটনা রোধে পরিবহন মালিক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে সমন্বিত আন্তরিক, সচেতন, দৃঢ় ও দায়িত্বশীল ভূমিকা আশা করি।

লেখক- মীর আব্দুল আলীম, সাংবাদিক, গবেষক ও কলামিস্ট।

ওডি/এসএ

মতামত পাতায় প্রকাশিত লেখা লেখকের একান্ত মত। এর সঙ্গে পত্রিকার সম্পাদকীয় নীতিমালার কোন সম্পর্ক নেই।
চলমান আলোচিত ঘটনা বা দৃষ্টি আকর্ষণযোগ্য সমসাময়িক বিষয়ে আপনার মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাই, সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইলকরুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড