খালিদ ফেরদৌস
মনে পড়ে প্রয়াত মেয়র আনিসুল হককে? বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় মেয়র যিনি ৩০ নভেম্বর, ২০১৭ তারিখ সবাইকে কাঁদিয়ে, নীরব অভিমানে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন ওপারে। শনিবার ৩০ নভেম্বর তার দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয়েছে খুব সাদামাটাভাবে, যা আরও ভাব গাম্ভীর্যের সাথে পালন করা যেত।
বলার বা স্মরণ করার লোক না থাকলে বাংলাদেশের মানুষ তাকে ছোট করতে করতে পাশের বাড়ির অখ্যাত মানুষ বানিয়ে ফেলে। আমরা বাংলার বাঘ একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, জেনারেল উসমানী, নওয়াব সলিমুল্লাহসহ অনেককে অতি ক্ষুদ্র করে ফেলেছি। অথচ বাংলাদেশের স্বাধিকার, অধিকার, স্বাধীনতায় অভাবনীয় ভূমিকা রয়েছে তাদের।
একটা মহল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ছোট করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে। আর একটি মহল তাকে অতিরঞ্জিতভাবে সবজায়গায় প্রচার করতে গিয়ে তাকে পক্ষান্তরে ছোট করে ফেলছে। কিছু জেনারেল উসমানী, জিয়াউর রহমানসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধাদেরও দলীয় স্বার্থে ছোট করার প্রচেষ্টা চলছে। কিন্তু কীর্তিমানের মৃত্যু নেই এই কথাটা সবার জানা এবং মানা উচিত।
আবার ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়রের প্রস্থানের মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয়েছিল বাঙালি জাতি কীভাবে তিলকে তাল শুধু নয় একটা আস্ত তাল গাছ বানিয়ে ফেলতে পারে। তাঁর সম্পর্কে অনলাইন মিডিয়াতে নানা কুৎসা অপপ্রচার চালানো হয়েছিল, তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন, তিনি আত্মগোপনে আছেন, তিনি লন্ডন থেকে আর ফিরবেন না, আরও কত কী! তিনি ফিরেছিলেন তবে বাংলাদেশ বিমানের একটা ফ্লাইটে মৃত হয়ে। অসংখ্য মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে। বলতে কষ্ট হয়, দেশের ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা ভুয়া নিউজ পোর্টালগুলো খাদিজাকে সাতবার মৃত ঘোষণা করেছিল, বরিশাল সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র শওকত হোসেন হিরণকে কয়েকবার মৃত ঘোষণা করেছিল মরার আগেই, আনিসুল হককে মেরেছিল অনেকবার।
শুধু মৃত্যুর ক্ষেত্রে নয় সমাজ ও রাষ্ট্রিক অনেক জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এমন আজগুবি, বানোয়াট, মিথ্যা ও গুজব নির্ভর সংবাদ পরিবেশিত হচ্ছে যা আমাদের অগ্রগতি ও পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়াকে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এদের একটা বিহিত হওয়া উচিত। ভুয়া ও বানোয়াট নিউজ দিলে তাদের নিবন্ধন বাতিলসহ অর্থদণ্ড-কারাদণ্ড হওয়া সময়ের দাবি।
যা হোক, প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের সর্বশেষ মেয়র জীবন তাকে কিংবদন্তি বানিয়ে দিয়েছে। তিনি একমাত্র ব্যক্তি যার মৃত্যুতে দল-মত নির্বিশেষে সকলে দারুণভাবে মর্মাহত হয়েছিলেন। জানাজায় অংশগ্রহণসহ পরিবারের সদস্যদের সমবেদনা ও শোক জানাতে বিএনপির উচ্চপর্যায়ের নেতৃবৃন্দসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা তাঁর বাসায় যান। যা সাম্প্রতিক কালে কোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে কম দেখা গেছে। অবশ্য আরেক সাবেক মেয়র, গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকার মৃত্যুতে সকল দলের নেতা-কর্মীদের শোকাভিভূত হতে দেখা যায়। জাতীয় সংসদ ভবন প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত তার জানাজায় আওয়ামী লীগসহ ছোট-বড় সব দলের উচ্চপদস্থ নেতা-কর্মীদের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। তিনি দীর্ঘদিন আমেরিকা প্রবাসী হয়ে ক্যানসার রোগে ভুগছিলেন।
অন্যদিকে, আনিসুল হক তিন মাস ইংল্যান্ডের লন্ডনের একটি হাসপাতালে মস্তিষ্কের প্রদাহজনিত রোগ সেরিব্রাল ভাস্কুলাইটিসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়েছিলেন। তিনি যোদ্ধা, তিনি সংগ্রামদীপ্ত পথচারী বলেই হয়তো এত দিন জীবন-মৃত্যুর মধ্যখানে টিকে ছিলেন। আমরা যারা মৃত্যু পূর্বক্ষণে তার সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য করেছি তারা হয়তো মরার আগেই মরে যেতাম।
তিনি খোদ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ও আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং নির্বাচনে জয়লাভ করেছিলেন। এ যেন মহাকাব্যিক আখ্যান- ‘‘উন্নয়নের পথে এলেন, দেখলেন এবং জয় করলে’’। আনিসুল হক আপনি একদিন গল্প শুনিয়েছিলেন, যারা অবৈধভাবে রাস্তা দখল করবে, তাঁদের প্রথমদিন হাতে ধরব, পরের দিন বলব, স্যার, এটা সরকারি জায়গা, ছেড়ে দিন। তৃতীয় দিন পায়ে ধরব, বলব, স্যার এটা সরকারি জায়গা, জনগণের জায়গা ছেড়ে দিন। চতুর্থ দিন গিয়ে যদি দেখি জায়গা ছাড়েননি, তবে বুলডোজার চালিয়ে দেব। আমরা জনগণ ভেবেছিলাম এমন চটকদার, মিষ্টি কথা সবাই বলে। কত দেখলাম! পরেরদিন দৈনিক পত্রিকায় বুলডোজারসহ বড় বড় করে লেখা মেয়রের পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী গুলশান-১-এ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ। আনন্দে মন ভরে গেল। চোখে-মুখে পরিতৃপ্তি। তাঁর অকালপ্রয়াণে কী আমাদের চোখ আবার কখনো আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে না? সেই সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ। কারণ তার উত্তরসূরি হিসেবে যিনি মেয়র হয়েছে তিনি চোখের পড়ার মতো কোনো কাজ করে দেখাতে পারেনি। অথচ আনিসুল হক প্রায় প্রতিদিন নগরবাসীর জন্য নতুন আশা ও স্বপ্ন এবং চোখে পড়ার মতো কর্মকাণ্ড নিয়ে হাজির হতেন। এই জন্য বলা যায় আনিসুল হক যুগে যুগে একজনই হয়।
তিনি স্বপ্নজয়ের লম্বা সিঁড়িতে পা রেখেছিলেন, সফলতার সাথে এগিয়েছিলেন বেশকিছু ধাপ। স্থবির হয়ে পড়া রাজধানীর গতিও দিয়েছিলেন খানিকটা। কিন্তু এই অবেলায় তাঁর এই যাত্রা থেমে যাওয়াটা কেউ মেনে নিতে পারছে না। কে জানত তিনি আমাদের ছেড়ে নীরব অভিমানে চলে যাবেন। পেশিশক্তির নোংরা রাজনীতিতে গা ভাসাননি, নষ্ট রাজনীতির আঁচড় গায়ে দাগ কাটতে দেননি। বরং রাজনীতির নামে যারা অপরাজনীতি করেছেন তাঁদের জন্যও ইতিবাচক উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলেন আনিসুল হক।
তার অকালে চলে যাওয়াতে কেঁদেছে নগরবাসী, কেঁদেছে তাঁর মোহাম্মদী গ্রুপের হাজার হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী, কেঁদেছে অরাজনৈতিক-রাজনৈতিক মঞ্চের মানুষেরা। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে প্রবেশ করেই তাঁর উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের নিদর্শন দেখে প্রত্যেকটা মানুষ বেদনাতুর হয়ে যায় এখন। এমনকি যারা আওয়ামী লীগকে মনে-প্রাণে অপছন্দ করে তাঁরাও দারুণভাবে শোকাহত।
হুমকি-ভয়কে তুচ্ছ জ্ঞান করে উন্নয়নের মাঠ প্রসারিত করার নাম আনিসুল হক। যে দলের সমর্থনপুষ্ট হয়ে মেয়র নির্বাচনে জিতলেন, উন্নয়ন-অগ্রগতির প্রশ্নে সেই দলের মানুষেরাই পথ রুদ্ধ করে দেয়। অবরুদ্ধ হলেন। তাকে মেয়র করা আওয়ামী লীগের ভুল ছিল এমন কথাও শুনতে হয়েছে তাকে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও এমন কথার স্রোতে বিদ্ধ হয়েছেন। তবে তিনি নিরাশ হননি। সব প্রতিবন্ধকতা, রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে নগরবাসীকে স্বস্তি দিতে চেয়েছিলেন। সততা ও সাহসিকতায় তেজগাঁও বাসস্যান্ড উচ্ছেদ করে সাতরাস্তা থেকে তেজগাঁও রেলক্রসিং পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণ, গাবতলীতে অবৈধ পার্কিং বন্ধ করা এবং দূতাবাস পাড়ায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা তার যুগান্তকারী কার্যক্রম বলে সর্বজনবিদিত।
মোদ্দাকথা, চৌকশ উপস্থাপক, উদ্যমী ব্যবসায়ী, প্রজ্ঞাবান নেতা আনিসুল হকের মহান লক্ষ্য ছিল প্রাণের ঢাকা শহরকে তিলোত্তমা নগরীতে রূপান্তর করা। কিন্তু নাগরিকদের অফুরন্ত অপেক্ষায় রেখে আশাহত অসংখ্য জাগ্রত স্বপ্ন ও পাহাড়সম প্রত্যাশা অপূর্ণ রেখে মৃত্যুর কাছে হেরে গিয়ে চিরতরে চলে গেলেন বাগ্মী, হাস্যময়ী, সজ্জন ব্যক্তি আনিসুল হক। কিন্তু মৃত্যুই মানবজীবনের শেষ কথা নয়। তিনি চিরঞ্জীব, তিনি কিংবদন্তি হয়ে বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে। কারণ নিজ অবস্থানে এত সফল মানুষ বাংলাদেশ খুব একটা দেখেনি। জয়তু মেয়র আনিসুল হক। ওপারে আপনি ভালো থাকুন অনন্তকাল।
লেখক-এম. ফিল গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড