• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩২ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

দৈনিক অধিকার নবান্ন সংখ্যা-১৯

কবি

  জান্নাত লাবণ্য

০৮ মার্চ ২০২০, ১০:৪৩
গল্প
লাবণ্য মনে মনে বলল, ‘বিদায় হে কবি।’ (ছবি : সম্পাদিত)

২২ অক্টোবর ১৯৫৪, গভীর রাত। শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতাল থেকে বাড়িতে খবর এলো, রাত ১১টা ৩৫ মিনিটে জীবনানন্দ দাশ মারা গেছেন। লাবণ্য দাশ খবরটা শুনল। তারপর নিজের ঘরে গিয়ে ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে দিল। কিছুক্ষণ পরে সমরানন্দ গিয়ে বন্ধ দরজায় ধাক্কা দিল। ভেতর থেকে কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। সমরানন্দ এবার চিৎকার করে ডাকল, ‘মা, মা, দরজা খোলো।’ লাবণ্য দরজা খুলে দাঁড়াল। তাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন এই মাত্র ঘুম ভেঙে উঠে এসেছে। তার কণ্ঠে বিরক্তির প্রকাশ স্পষ্ট। লাবণ্য - কী হয়েছে? সমরানন্দ - মা, গাড়ি পাঠিয়েছে। তুমি হসপিটালে যাবে না? লাবণ্য- না। আমাকে আর বিরক্ত করো না। এই বলে সে সমরানন্দের মুখের ওপরই আবার ঘরের দরজা লাগিয়ে দিল। সমরানন্দ বন্ধ দরজার সামনে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাড়িয়ে থাকল। তারপর চলে গেল সেখান থেকে।

দরজা লাগিয়ে লাবণ্য বিছানায় শুয়ে পড়ল। হালকা ঠান্ডা পড়া শুরু হয়েছে। গায়ে পাতলা একটা কাঁথা জড়িয়ে নিল সে। চোখ বন্ধ করে কপালে হাত দিয়ে শুয়ে আছে। তাকে হঠাৎ দেখলে মনে হবে ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু সে ঘুমাচ্ছে না। নানারকম ভাবনায় ডুবে আছে তার অস্থির মনটা।

আগামীকাল শুটিং করাসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু আজ তিনি মারা গেলেন, সব পরিকল্পনা বদলাতে হবে মনে হয়। কেমন এলোমেলো নানা চিন্তা মাথায় ঘুরছে। আচ্ছা, আমাকে কী এখন বিধবার বেশ নিতে হবে? কিন্তু উনি তো তা চাইতেন না। বরং আমি যেন তার মৃত্যুর পরও এমনই থাকি, তিনি তো এটাই চাইতেন। লোকটা মাঝে মাঝেই মৃত্যু নিয়ে নানারকম কথা বলতেন। ‘মৃত্যুর পর অনেক প্রিয় মানুষের সাথে দেখা হবে, ভালোই হবে।’ আচ্ছা এখন কী সে তার প্রিয় মানুষদের দেখা পেয়েছেন? তিনি মারা গেলে আমি কী করব? এই প্রশ্নটা প্রায়ই করতেন আমাকে। তিনি কী দেখতে পাচ্ছেন আমি কী করছি?

একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল লাবণ্য। ১৯৩০ সালে ইডেন কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। কত স্বপ্ন ছিল দেশের জন্য কিছু করব, নিজের জন্য কিছু করব, বিখ্যাত নায়িকা অথবা গায়িকা হব। কিন্তু সব আশা ত্যাগ করে নিজের অমতেই সে বছরের ৯ মে তাকে বিয়ে করতে হলো। যার বাবা- মা নেই, জ্যাঠামশাইয়ের আশ্রয়ে থাকতে হয়, তার আর কি-ই বা করার ছিল। তবে সেই বিয়ের দিন লোকটার চোখে আমি ভরসাস্থল খুঁজে পেয়েছিলাম। দেখতে আমার পাশে অনেকটাই বেমানান ছিল। তবু কলকাতার কলেজের অধ্যাপক। জ্যাঠামশাইয় ভেবেছিলেন বেশ যোগ্য পাত্র তিনি আমার জন্য পেয়েছেন। কিন্তু বিয়ের দিন তার সাথে আসা বুদ্ধদেব বসুর প্রাণচাঞ্চল্যই বেশি ভালো লেগেছিল আমার।

দেয়ালের দিকে চোখ গেল লাবণ্যর। সেখানে একটা ছবি লাগানো। লাবণ্য বসে আছেন, মন্ঞ্জুশ্রী আর সমরানন্দ তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ছবিটিতে তিনি নেই। আসলে একই বাড়ির বাসিন্দা হলেও তিনি আমাদের জীবনে ছিলেন অনুপস্থিত। তিনি ছিলেন তার কবিতা নিয়ে। সংসার কীভাবে চলছে, ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যৎ কিংবা আমি কোনোটাকেই তিনি গুরুত্ব দেননি। শুধু মাত্র কবিতা রচনা ছাড়া। তিনি কবি এটাই ছিল তার বড় ধ্যান ও জ্ঞান।

তার কোনো ছবি আমার কাছে নেই। এমন কোনো আহামরি চেহারা তার ছিল না, যে ছবি তুলে ঝুলিয়ে রাখব। নিজের অজান্তেই ক্ষোভ প্রকাশ করে ঘোত জাতীয় একটা শব্দ বের হয়ে এলো লাবণ্যর মুখ থেকে।

এখনো এই বয়সে কত পুরুষ আমার একটু সঙ্গ পাওয়ার জন্য আকুতি প্রকাশ করে। আমার রূপের, গানের, অভিনয়ের কত প্রশংসা করে। কই এই মানুষটা তো কোনোদিন একটা ভালোবাসা বা মুগ্ধতার কথা আমাকে বলেননি। এত যে কবিতা নিয়ে পড়ে থাকতেন, আমাকে তো শোনাননি কোনো ভালোবাসার কবিতা। তিনি আজীবন কবিই হয়ে থাকলেন।

বুকের ভিতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠল। রাগ, অভিমান ও ক্রোধে দমটা যেন আটকে যাচ্ছে। বিছানায় উঠে বসল লাবণ্য। খাটের রেলিং এ বালিশ দিয়ে হেলান দিল সে।

বিয়ের পর বরিশাল গিয়ে থাকতে হলো। লোকটা বরিশাল, দিল্লি, কলকাতা যাওয়া আসার মধ্যে থাকত। চাকরির কোনো স্থায়িত্ব নেই, ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ব্যবসার চেষ্টা করেও ব্যর্থ। এর মাঝে ১৯৩১ সালে মন্ঞ্জুশ্রীর জন্ম হলো। কর্মসংস্থানের কোনো গতি করতে না পেরে ১৯৩৫ সালে বরিশালেই ফিরে এলেন তিনি। ব্রজমোহন কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগ দিলেন। এই চাকরি ভালোই চলছিল। ১৯৩৬ সালের নভেম্বরে পুত্র সমরানন্দের জন্ম হলো। সে সময়টা অন্ততপক্ষে টাকার সংকট ছিল না। কিন্তু কলকাতার টান তার ছাড়েনি। সুযোগ পেলেই ছুটে যেতেন কলকাতা।

সবকিছু এখনো ছবির মতো ভাসছে লাবণ্যর চোখে। দেশভাগের কিছু আগে কলেজ থেকে ছুটি নিয়ে তিনি চলে এলেন কলকাতা। ছুটি বাড়িয়ে সেবার কয়েক মাস কলকাতা থাকলেন। দুই সন্তান নিয়ে লাবণ্য বরিশালে কেমন ছিল এ নিয়ে কোনো ভাবনা তার ছিল বলে মনে হয় না।

অবশেষে দেশভাগের পর সবাইকে কলকাতায় আনলেন তিনি। লাবণ্য তখন ভেবেছিল, এবার হয়তো জীবনে স্থিরতা আসবে, শান্তি আসবে। লোকটা সবসময় পাশে থাকবে। কিন্তু অর্থনৈতিক সংকট যে কি যন্ত্রণাদায়ক তা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি হলো কলকাতায় এসে। পত্রিকার সম্পাদকের কাজ, বিভিন্ন কলেজে শিক্ষকতার কাজ কোনো কিছুতেই মানুষটা বেশিদিন স্থায়ী হতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত লাবণ্যকে একটি স্কুলের শিক্ষক হিসেবে যোগ দিতে হলো। কারণ সংসার আর চলে না। লোকটা মূলত টিউশনি করে যে টাকা পেত তা দিয়ে কীভাবে এই সংসার চলবে?

সংসার নিয়ে ভাবার অবকাশ তার ছিল কি! কবিতা নিয়েই ছিল তার জগৎ। পুরো সংসারের সকল দায়িত্ব বহন করতে হয়েছে লাবণ্যকে। এর বদলে কী পেয়েছে লাবণ্য অবহেলা ছাড়া? বিছানা থেকে উঠে টেবিলের কাছে এলো লাবণ্য। চেয়ার টেনে বসল। আবার কে যেন দরজায় ধাক্কা দিল। লাবণ্য- কে? ‘আমি। আবার গাড়ি পাঠিয়েছে।’ বাড়ির ঝি উত্তর দিল বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে। -চলে যেতে বল। আমি যাব না। দরজার ওপাশ থেকে আর কেউ কিছু বলল না। টেবিলের ওপর পানি ভরা জগ। গ্লাসে পানি ঢেলে নিয়ে পান করল লাবণ্য।

আর বেঁচে থেকেই বা কী হতো? সুস্থির জীবিকার অভাব তাকে আমৃত্যু কষ্ট দিয়েছে। ট্রামের দুর্ঘটনায় ভেঙে গিয়েছিল কণ্ঠা, ঊরু, পাঁজরের হাড়। শেষে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলেন। বেঁচে থকলেও কী করুণ ভাবেই না তাকে বাঁচতে হতো। ভগবান মৃত্যু দিয়ে আসলে তাকে বাঁচিয়ে দিলেন।

হঠাৎ মনটা নরম হয়ে এলো লাবণ্যর। সংসার জীবনে আমি বা সে দুজনেই অসুখী ছিলাম। লোকটা টাকার অভাববোধ নিয়ে জীবনটা পার করল। আর মৃত্যুর আগে শারীরিক চরম কষ্ট ভোগ করে গেল। না আমি তার সেবা যত্ন করতে হাসপাতালে অতটা যেতে পারিনি। কারণ আমার কোথাও গিয়ে দু-দণ্ড শান্তিতে বসার সুযোগ ছিল না। আমাকে সংসার চালনা নিয়ে যতটা ভাবতে হয়েছে, নিজেকে নিয়েও কী ততটা ভাবার অবকাশ পেয়েছি?

১৪ই অক্টোবর তিনি ট্রাম দুর্ঘটনার শিকার হলেন।। কলকাতায় এরকম ঘটনা ঘটার ইতিহাস নেই। হাতে ডাব নিয়ে রাস্তা পার হতে গিয়ে এই ঘটনা ঘটেছে। অনেকেই বলছে এটা কী দুর্ঘটনা না কি আত্মহত্যা? লাবণ্য নিজেও এ নিয়ে ভেবেছে। কিন্তু সেও দ্বিধান্বিত হয়েছে। সত্য কী তা এখন শুধু ভগবানই জানেন।

সেদিন হসপিটালে গিয়ে দেখি, অচিন্ত্য বাবু, প্রেমেন্দ্র বাবু, ভূমেন্দ্র গুহসহ আরও অনেকে তাকে ঘিরে আছে। মনের আক্ষেপটা আর দমন রাখতে পারিনি আমি। বলেই ফেললাম, ‘বাংলা সাহিত্যের জন্য হয়তো অনেক রেখে গেলেন। কিন্তু আমার জন্য কী রেখে গেলেন বলো তো।’

১৫ অক্টোবর থেকে তার পাশে বসে রাত জাগা, ওষুধ পত্তর খাইয়ে দেওয়া, কাপড় চোপড় পাল্টে দেওয়া, ঘুমের মাঝের প্রলাপ শুনে যাওয়ার কাজগুলো করেছিল ভূমেন্দ্র গুহ আর তার ডাক্তার বন্ধু বান্ধবরা। লাবণ্য যে হসপিটালে বেশি সময় দেননি, এ নিয়ে ঢের কথা হয়েছে, লাবণ্য তা ভালো করেই জানে। কিন্তু মন থেকে না আসলে কী কারও সেবা করা যায়? কে কী বলল তাতে লাবণ্যর কিছুই যায় আসে না।

দেয়ালের ঘড়ির দিকে তাকাল লাবণ্য। ঘড়িটা থেমে আছে। ব্যাটারি শেষ হয়ে গেছে বোধহয়। কয়টা বাজে এখন। চোখগুলোতে ব্যথা করছে। ঘুমানো দরকার।

চেয়ার থেকে উঠে জানালার কাছে আসল লাবণ্য। বাইরে কেমন যেন আলো আর আঁধারির খেলা। ভোর হতে বুঝি আর দেরি নেই। জানালার শিক ধরে দাঁড়াল লাবণ্য। দূরে অচেনা সুরে কোনো একটা পাখি ডেকে উঠল। সেই ডাক লাবণ্যকে মনে করিয়ে দিল একজন শান্ত, সর্বংসহা, কবির মুখ। মনটা কেমন যেন নরম হয়ে এলো লাবণ্যর।

কলকাতায় আসার পর মানুষটা আমাকে অবাধ স্বাধীনতা আর প্রশ্রয় দিয়েছিলেন। তার কারণেই আমি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পেরেছিলাম। বিয়ের দিন জ্যাঠামশাইকে দেওয়া কথা তিনি আজীবন পালন করেছেন, আমাকে তিনি কোনোদিন কোনো কারণে ক্ষুণ্ণ করেননি।

ভোরের আলোর ছটা চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে। জানালা দিয়ে প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে আছে লাবণ্য। তার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল পানি সকলের অগোচরে।

লাবণ্য মনে মনে বলল, ‘বিদায় হে কবি।’

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড