• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৭ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

দৈনিক অধিকার নবান্ন সংখ্যা-১৯

নতুন ধানের গন্ধহীন নবান্ন

  মৌ কর্মকার

০২ মার্চ ২০২০, ১৩:০৬
প্রচ্ছদ
যে উৎসবে নেই নতুন ধানের মৌ মৌ করা গন্ধ (ছবি : সম্পাদিত)

সকালে শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, সন্ধ্যায় একক কিংবা দলীয় সংগীত ও নৃত্য, একক আবৃত্তি, নাটক অথবা র‍্যাম্প শো। দুপুরে সেজে ওঠে নবান্ন উৎসবের পিঠার স্টলগুলো। সাজানো হয় খড়ের তৈরি ছোট ছোট কুটির। সেখানে বিক্রি হয় লবঙ্গ লতিকা, পাকন, নকশি পাকন, ডিমচিতই, দুধচিতই, ঝালপোয়া, মালপোয়া, ভাজা পুলি, তালের পিঠা, গুড়ের ভাপা, ম্যারা পিঠা, খেজুরের গুড়ের পিঠা, বিবিখানা, ধানাপোরা, মালাই রোল পুরিসহ আরও বিচিত্র রকমের পিঠা। মাঠের এক কোণে বসে বায়স্কোপ, বসানো হয় নাগরদোলা। উৎসব প্রাঙ্গণের কোন এক কোণে রাখা থাকে ঢেঁকি ও ধান। চাইলেই ঢেঁকিতে পা দিয়ে ধান ভানে উৎসবে মেতে উঠা মানুষগুলো। একই সাথে, ঢেঁকিতে পা দিয়ে সেলফি তুলে আধুনিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করা হয়। ক্যাপশনে লেখা থাকে ‘আমাদের ঐতিহ্য, নবান্ন উৎসব’। কিন্তু এগুলোই কি আমাদের ঐতিহ্য, বাঙালির চিরচেনা নবান্ন উৎসব? যে উৎসবে নেই নতুন ধানের মৌ মৌ করা গন্ধ। যে ঐতিহ্যে নেই জীবনের সেই সহজ-সরল শান্তিময় ভাব। যে ঐতিহ্য শুধু মিশে আছে ব্যানার, পোস্টার, পত্রিকার কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পাতায় পাতায়।

হেমন্তে নতুন ফসল ঘরে তোলার সময় নবান্ন উৎসব পালন করা হয়। অভাবের কার্তিককে পেছনে ফেলে নতুন ফসলের গন্ধ নিয়ে আসে অগ্রহায়ণ। শুরু হয় নতুন ধান ঘরে তোলার উৎসব। তবে বর্তমানে ফসল রূপণ কিংবা ফসল ঘরে তোলার নিদিষ্ট সময় গুলোতেই এসেছে পরিবর্তন। পরিবর্তন এসেছে জীবন ও মননে। যেখানে নেই প্রাণের কষ্ট, নেই হৃদয়ের আনন্দের সুর।

বাংলার কৃষকের প্রধান খাদ্যশস্য ছিল আমন ধান। বর্তমানে আমনের জায়গা দখল করেছে আউশ-আমন-বোরো ধান। বিভিন্ন জাতের উচ্চ ফলনশীল ধান বাজারে আসায় নতুন ধানের গন্ধ হারিয়ে গেছে।

স্বল্প সময়ে বিভিন্ন ধরণের ধান উৎপন্ন হওয়ার কারণে প্রাণহীন হয়ে পড়েছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী নতুন ধানের এই উৎসব। কৃষকের মনে এখন আর নেই সেই প্রাণের স্পন্দন। ধানের বীজ থেকে শুরু করে চাল উৎপাদন পর্যন্ত সব কাজই সম্পূর্ণ করা হচ্ছে যান্ত্রিক পদ্ধতি ব্যবহার করার মাধ্যমে।

গরু দিয়ে ধান মাড়াই, ধান থেকে ঢেঁকির মাধ্যমে চাল উৎপাদন, সেই চাল থেকে পিঠেপুলি তৈরি। এখন সেই কষ্টও নেই, কষ্টের সেই আনন্দও নেই। নেই ধানের সেই মুগ্ধ করা গন্ধ। শুধু আছে উৎসব ও আনন্দের জোয়ার। আছে রাইস মিলে চাল ভানার শব্দ, ভ্যান গাড়িতে ইঞ্জিন নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধান ভানা ও মাড়াই করার দৃশ্য। এভাবেই যেন চলমান থাকে সংস্কৃতি। পরিবর্তনে পরিবর্তনে এগিয়ে চলে জীবন।

নবান্নে পিঠার ঋতুতে পিঠা তৈরির সংস্কৃতি ও চর্চার আদি অবস্থা এখন আর আগের মতো নেই। তবে এই কথাও ভাবার কোনো অবকাশ নেই যে, বিভিন্ন উপলক্ষ ও নির্দিষ্ট সময়ে পিঠা খাওয়া কিংবা তৈরি হয় না। পিঠা খাওয়া কিংবা তৈরি করা উভয়ই হয় শুধু context এ এসেছে কিছু পরিবর্তন। অতীতে গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে তৈরি হতো পিঠা এখন তৈরি হয় স্টলে-স্টলে, রাস্তার অলিতে গলিতে, রাস্তার মোড়ে দেখা মেলে পিঠার দোকান। তবে, ব্যস্ত রাস্তায় মানুষের গোল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, ধোঁয়া ওঠা গরম ভাপা কিংবা চিতই পিঠা খাওয়ার দৃশ্য বাঙালিয়ানার কথাই মনে করিয়ে দেয়। কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতার সাথে তাল মিলিয়ে এখন আর বলতে ইচ্ছে করে না, হ্যাঁ, ধান এভাবেই টাকা হয়ে যায় হেমন্তে। আর টাকা আসা মানেই উৎসব। এজন্য এইসময় সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে মেলা হয়, যাত্রা হয়। উৎসবকে কেন্দ্র করে লাঠিখেলা, হা-ডু-ডু, ষাঁড়ের লড়াই, নৌকাবাইচসহ বিভিন্ন খেলাধুলার আয়োজন করা হয়। খোলা মাঠে বসে বাউল গানের আসর। যেগুলোর সম্মিলিত নামই তো নবান্ন।

এখন আর বলা হয়ে ওঠে না, গ্রামে গ্রামে নতুন ধান উঠছে। ঘরে ঘরে শুরু হয়েছে নবান্ন উৎসব। নতুন ধানের, নতুন চালের পিঠা-পুলিতে ম-ম করছে অগ্রহণের সকাল। শীতজুড়েই চলবে এই পিঠা-পুলির ধুম। দাদি, নানী কিংবা মায়েরা হাতের যত্নে বানাবেন চিতই, দুধচিতই, ভাপা, পুলি, চাঁদপুলি, পাটিসাপটা, পাক্কনসহ তেলেভাজা, নার‌কে‌ল, গুঁড়ের কিংবা খেজু‌রের রসের কত না বাহারি স্বাদের পিঠা। এখন আর নবান্নে মানুষ ছুটে চলে না বাড়ির পথে। বাড়ির পথ ভুলে মানুষ ছুটে চলে স্টলে স্টলে। মানুষ স্টলের পিঠায় খুঁজে চলে দাদি, নানী কিংবা মায়ের হাতের স্বাদ।

শীত সকালে গ্রামের গৃহস্থ ঘরের নারীর ঢেঁকিতে ভানা নতুন চালের গুঁড়া দিয়ে মাটির চুলায় হরেক রকমের পিঠা তৈরি সেই ধুম এখন নেমে এসেছে রাস্তায়। সেগুলো মুখে দিয়েই শুরু হয় গৃহস্থ পরিবারের সদস্যদের নতুন দিনগুলো। অর্থাৎ এখন গৃহস্থদের দেখা যায় রাস্তায় আর গৃহস্থ ঘরের সেই নারীরা পেটের দায়ে মাটির চুলা আর পিঠা তৈরির সরঞ্জাম নিয়ে বসে যান ফুটপাতে। খেটে খাওয়া মানুষগু‌লো শী‌তের মৌসুম আসার সঙ্গে সঙ্গে সকালে ও সন্ধ্যায় বাহারি পিঠা আর ভর্তার পসরা সা‌জি‌য়ে বসেন। নিজের বাড়িতে শী‌তের সময় পিঠা খাওয়ার আনন্দঘন মুহূর্তগু‌লো এখন আর কারো মনে বেদনা জাগায় না। বাসার পাশেই, শহরের পথে পথে, মোড়ে মোড়ে মৌসুমি পিঠার পসরা বসে শীতজুড়ে। রাস্তার পাশে কিংবা ফুটপাতে দাঁড়িয়ে পিঠা খাওয়া এখন রাজধানীর অতি পরিচিত দৃশ্য। কর্মজীবী মানুষ চলতি পথে কিংবা সন্ধ্যার আড্ডায় নাশতাটা সেরে ফেলেন শীতের পিঠা দিয়েই। শিক্ষার্থীরা বন্ধুসমেত চলে আসে কাছে-দূরের পছন্দের পিঠা দোকানগুলোতে। এ যেন বাঙালি জীবনের প্রতীকী রূপেরই প্রকাশ। প্রতীকী জীবন, প্রতীকী নবান্ন উৎসব।

আরও পড়ুন : নবান্ন মানে নতুন অন্ন তবু অগ্রহায়ণ আসে, আসে নবান্ন উৎসব। শীতলতায় ছুঁয়ে যায় দেহখানি। ভোরে প্রকৃতিতে কুয়াশার চাদর, শিশিরে সিক্ত ঘাস-পত্রপল্লব জানান দেয় শীতের আগমনী বার্তার। চোখের সামনে ভেসে উঠে হাতে হাতে ধোঁয়া ওঠা চিতই-ভাপা পিঠার দৃশ্য। কিন্তু আমাদের চোখগুলো যে বাঁধা আছে ভিনদেশী চাকচিক্য সংস্কৃতির কালো চাদরের ভাঁজে। আমরা ভুলে গেছি, সকল দেশের মানুষেরই নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে, যা তাদের নিজস্ব পরিচয় বহন করে। আধুনিকতা মানেই নিজেদের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে অন্যের সংস্কৃতির দিকে চালিত হওয়া নয়। নিজস্ব সংস্কৃতিগুলোকেও আধুনিক রূপদান করার মাধ্যমে আধুনিক জীবনযাপন করা যায়।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড