অধিকার ডেস্ক
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র শহীদ শেখ রাসেলের ৫৫তম জন্মদিন শুক্রবার (১৮ অক্টোবর)। ১৯৬৪ সালের এই দিনে ঐতিহাসিক ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন শেখ রাসেল। তার জন্মের পর বঙ্গবন্ধু পরিবারে যেন আনন্দের ঝড় নামে।
রাসেলের বড় বোন বঙ্গবন্ধু পরিবারের জীবিত সদস্য শেখ রেহানা রাসেলকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন, “মা বলতেন, লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে থেক, তাহলে তোমাকে একটা ছোট্ট বাবু এনে দেব। মার কথামতো লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে থাকার চেষ্টা করতাম। গভীর আগ্রহ নিয়ে বসে থাকতাম কখন মা আমাকে একটা বাবু এনে দেবে। রাসেলের জন্ম হয় অনেক রাতে। আমি ঘুমিয়েছিলাম। আমার মেজফুফু ঘুম ভাঙিয়ে বললেন, জলদি ওঠ, তোমার ভাই হয়েছে। জন্মের পরে ওকে আমার মনে হয়েছিল একটা পুতুল। কী সুন্দর হাসে, আবার কাঁদেও। রাসেল একটু একটু করে বড় হয়ে ওঠে। মা ও আব্বা নাম রাখলেন রাসেল। স্কুলের নাম ছিল শেখ রিসালউদ্দীন। হাসু আপা ওকে কোলে করে কত গান শোনাত, কত কবিতা শোনাত। কামাল ভাই আর জামাল ভাইও কোলে নিত। আমিও নিতাম। ভয়ও করতাম যদি পড়ে যায়। যদি ব্যথা পায়। ওর খুব কষ্ট হবে।”
ছোটবেলা থেকেই শেখ রাসেল ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ ও রাজনৈতিকভাবেও দক্ষ। প্রয়াত সংসদ সদস্য, সাংবাদিক এবং শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী বেবি মওদুদের লেখনীর মাধ্যমে জানা যায়, “রাসেল একদিন মাকে জিজ্ঞেস করে, ‘মা আব্বার কাছে যাবে না?’ মা কোনো উত্তর দেন না। শুধু তাকে বুকের কাছে টেনে আদর করেন। রাসেল আবার জিজ্ঞেস করে, ‘মা, আব্বার নাকি ফাঁসি হবে। ফাঁসি কি মা?’ মা বলেন, “কে বলেছে তোমাকে এ কথা?’ রাসেল উত্তর দেয়, ‘সেদিন কাকা আর দুলাভাই, কামাল ভাই বলছিল, আমি শুনেছি মা।” এমন রাজনৈতিক সচেতন ছিল শেখ রাসেল এবং কারাগারে বাবার সাথে সাক্ষাতের সময় জয় বাংলা বলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিল এবং বাবার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে মাঝে মধ্যে ঝাঁঝালো উক্তি প্রদান করতেন। সামাজিকভাবে ও সে বিশেষ বন্ধুমহল গড়ে তুলেছিল। বাড়ির আশেপাশে অনেকের সাথে সে খেলাধুলা করত এবং বিকালে স্কুল হতে ফেরত এসে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিত।
তবে রাসেলের ছোটকাল কেটেছে বাবা ছাড়া। কারণ তার বাবা রাজনৈতিক বন্দি হয়ে কারাগারে ছিলেন দীর্ঘদিন। বাবাকে দেখতে না পেয়ে মা ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে আব্বা বলে সম্বোধন করতেন রাসেল। ‘কারাগারে রোজনামচা’ বইয়ে শেখ মুজিব অসংখ্যবার রাসেলের কথা তুলে ধরেছেন এবং তার নিকট যে ছোট্ট সন্তান খুব প্রিয় ছিল সেটিও ফুটিয়ে তুলেছেন এবং তিনি মাঝে মাঝে নিজেকে বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতেন ছেলেটিকে সময় না দেওয়ার কারণে।
রাসেলের জন্মের সময় বঙ্গবন্ধু ছিলেন চট্টগ্রামে। রাসেলের জন্মটি পরিবারের সকলের কাছে ভিন্ন আনন্দের মাত্রা প্রদান করে। রাসেলের জন্মের সাথে সাথে বড় ভাইবোনদের সকলেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে রাসেলের পরিচর্যায়। রাসেলের যা যা ভালো লাগে সেগুলো কিংবা সে বিষয়গুলো সবাই করার চেষ্টা করতেন। রাসেলের সার্বক্ষণিক খোঁজখবর নিতেন বঙ্গবন্ধু। সভা-সমাবেশ করে ফিরতে রাত হলেও রাসেলকে ঘুমের মধ্যে আদর করতেন শেখ মুজিব। জন্মালগ্ন থেকেই রাসেল ছিল চঞ্চল প্রকৃতির। সারাবাড়ি সবসময় মাথায় তুলে রাখত। তবে রাসেলের দুর্ভাগ্য বাবাকে খুব বেশি কাছে পায়নি।
১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলনের পর থেকেই রাজবন্দি হিসেবে জেলে ছিলেন রাসেলের বাবা। কারাগারে দেখা করার সময় রাসেল কিছুতেই তার বাবাকে রেখে আসবে না। এ কারণেই তার মন খারাপ থাকত। পরিবারের সকলেই চাইত রাসেলের মন যেন কোনো কারণে খারাপ না হয়। রাসেলের আম্মা রাসেলকে একটা তিন চাকার সাইকেল কিনে দিয়েছিল। সাইকেলটি রাসেলের খুব প্রিয় ছিল ও সর্বক্ষণ খেলাধুলায় ব্যস্ত থাকত। রাসেলের চরিত্রে আভিজাত্যের ছোঁয়া ছিল, গাম্ভীর্যতাও লক্ষ্য করা গেছে। পরিস্থিতি এবং সময়ের দাবি মিটিয়ে রাসেল তাল মিলিয়ে চলেছেন। বাড়িতে দুষ্টুমি করত সবসময়, কিন্তু রাষ্ট্রীয় সফরে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন সর্বদাই। অনুষ্ঠান এবং পরিস্থিতির সাথে মিল রেখেই পোশাক পরিধান করতেন ছোট্ট শিশু রাসেল। সচরাচর প্রিন্স কোট, সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি ও মুজিবকোট পরত রাসেল। বঙ্গবন্ধুর পোশাক পরিধানেও মাঝে মধ্যেও নজরদারি করতেন ছোট্ট শেখ রাসেল।
একবার বঙ্গবন্ধু বন্যার্ত এলাকা পরিদর্শনে যাবেন সে সময়ে বঙ্গবন্ধুর পোশাক, পায়ের স্যান্ডেল কী হবে ঠিক করে দিয়েছিলেন শেখ রাসেল। পরিবারের অন্যদের ভাল-মন্দের বিষয়ে নজরদারি করতেন শেখ রাসেল।
রাসেল ৪ বছর বয়সে প্রথমে স্কুলে যাওয়া শুরু করে। প্রথম দিকে পরিবারের কাউকে না কাউকে স্কুলে দিয়ে আসতে হতো। ধীরে ধীরে নিজেই আগ্রহ নিয়ে স্কুলে যেত এবং স্কুলে তার বেশ কিছু বন্ধুও জুটেছিল। বন্ধুবৎসল ছিল রাসেল। পর্যায়ক্রমে পড়াশোনায় মনোযোগী হয়ে উঠে রাসেল। নিজেই পড়তে বসত এবং স্কুলে একাই যেত।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে শেখ রাসেলের জন্য একজন গৃহশিক্ষিকা রাখা হয়। শেখ হাসিনার বরাতে জানা যায়, শিক্ষিকাকে খুব সম্মান করতেন শেখ রাসেল। খুব দুষ্টু প্রকৃতির ছিল তাই শিক্ষককে রাসেলের কথা শুনতে হতো নইলে সে পড়াশোনায় মনোযোগী হতো না। তাই শিক্ষিকাও রাসেলের কথা অনুযায়ী শিক্ষা দান করতেন। শিক্ষিকার খাবার-দাবারের ব্যাপারে খুব সচেতন ছিল শেখ রাসেল। প্রত্যেকদিন শিক্ষিকার জন্য দুটি করে মিষ্টি বরাদ্দ থাকত এবং শিক্ষিকাকে তা খেতে হতো রাসেলের ইচ্ছানুযায়ী। এরকমভাবে বাড়িতে কোনো আত্মীয়স্বজন আসলে তাদের ব্যাপারে শেখ রাসেলকে উৎসাহী হতে এবং অগ্রণী ভূমিকা নিতে দেখা গেছে।
মাত্র অল্প বয়সেই শেখ রাসেলের বিচক্ষণতা পরিবারের সবাইকে বিমোহিত করে তুলেছিল। সে কারণেই তথা পরিবারের কনিষ্ঠ হওয়ায় পরিবারের সকলের বিশেষ নজর ও ভালবাসা শেখ রাসেলের পৃথিবীটাকে বাসযোগ্য করে তুলেছিল কিন্তু দুঃখ ছিল বাবার কারাবরণ। বঙ্গবন্ধু ও এ বিষয়ে বিভিন্ন জায়গায় আক্ষেপ করেছেন ছোট ছেলেটাকে সময় না দিতে পারার জন্য। ‘কারাগারের রোজনামচা’ শেখ রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছেন: “৮ই ফেব্রুয়ারি ২ বৎসরের ছেলেটা এসে বলে, “আব্বা বালি চলো।” কী উত্তর ওকে আমি দিব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম ওতো বোঝে না আমি কারাবন্দি। ওকে বললাম, “তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো।” ও কি বুঝতে চায়! কি করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে!
দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলেমেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনো বুঝতে শিখে নাই। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে।” এই ছিল শেখ রাসেলের প্রতি বঙ্গবন্ধুর আদর। ভালো থাকুক শেখ রাসেল, আর বেঁচে থাকুক শেখ রাসেলের জয় বাংলার (মুক্তিযুদ্ধের সময়টায় বাসায় উচ্চস্বরে জয় বাংলা স্লোগান দিতেন শেখ রাসেল) স্বপ্ন।
তবে বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে আদরের ছোট্ট রাসেল সেদিন রক্ষা পায়নি ঘাতকদের বুলেট থেকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করা হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ওইদিন ঘাতকদের নির্মম বুলেটের আঘাতে নিহত হন ছোট্ট রাসেল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ওয়াজেদ মিয়ার ভাষ্যমতে; রাসেল ঘৃণিত আর্মিদের বলেছিলেন: “আল্লাহর দোহাই, আমাকে জানে মেরে ফেলবেন না। বড় হয়ে আমি আপনাদের বাসায় কাজের ছেলে হিসেবে থাকব। আমার হাসু আপা দুলাভাইয়ের সাথে জার্মানিতে আছেন। আমি আপনাদের পায়ে পড়ি, দয়া করে আপনারা আমাকে জার্মানিতে হাসু আপা ও দুলাভাই-এর কাছে পাঠিয়ে দিন।”
তবে শেখ রাসেলের এই আকুতি সেদিন একবারের জন্যেও মায়া জন্মায়নি ঘাতকদের মনে। বুলেটের আঘাতে প্রাণ হারাতে হয় নিষ্পাপ শেখ রাসেলকেও।
ওডি/এআর
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড