• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

রোহিঙ্গা ইস্যুতে ধর্মীয় দুর্বলতা ও ভূ-রাজনৈতিক সংকট 

  আয়াজ উর রাহমান

২৪ আগস্ট ২০১৯, ১৫:২০
রোহিঙ্গা সংকট
কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা মুসলিমরা (ছবি : ফাইল ফটো)

রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দুর্বলতার জায়গা এই বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠী মুসলিম সম্প্রদায়ের। মিয়ানমারে সংখ্যালঘু মুসলিমদের ওপর নির্যাতনকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারবে না মুসলিম প্রধান বাংলাদেশ। আর এই দুর্বলতাই বাংলাদেশকে বড় ভূ রাজনৈতিক সংকটে ফেলেছে।

কিছু কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা ও এনজিও ওয়ালারা শুরু থেকেই বাস্তবায়ন করেছে রাখাইনে মুসলিমরা নির্যাতিত। এটা সত্য যে রাখাইনে জাতিগত নিধনের শিকার হয়েছে রোহিঙ্গা মুসলিমরা। তবে এর পিছনে আঞ্চলিক ও বিশ্বের স্বার্থ যে অর্থনৈতিকভাবে জড়িয়ে আছে তা অনেকটাই আড়াল হয়েছে ধর্মভিত্তিক নির্যাতনের প্রচারণাকে উত্থাপনের ফলে।

ধর্মভিত্তিক এ ধরনের প্রচারণার পিছনেও রয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ব্যক্তিগত স্বার্থ। ধর্মকে উসকে দিয়ে জঙ্গিবাদের উত্থানে এসব আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোই কাজ করে থাকে বলেও বিভিন্ন সূত্রের অভিযোগ রয়েছে।

রাখাইনে বিশাল অর্থনৈতিক অঞ্চল সৃষ্টি করছে মিয়ানমার। যার আর্থিক সহায়তায় রয়েছে তারই বন্ধু রাষ্ট্রগুলো। আর ভূ রাজনৈতিক দৃষ্টিতেও রাখাইন রাজ্য এমন এক অবস্থানে রয়েছে যার জন্য চীন, ভারত এবং অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র সব দেশেরই বিশাল স্বার্থ রয়েছে এই রাজ্যে। এর ফলে মিয়ানমার তার স্বার্থ হাসিলে যেমন নীরব সহযোগিতা পাচ্ছে অন্যদিকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ভূ রাজনৈতিকভাবে বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ। এছাড়া চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক যুদ্ধকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে জঙ্গিবাদের মতো বড় উত্থানের সম্ভাবনাও রয়েছে। যা বড় সংকটে ফেলতে পারে বাংলাদেশকে।

রাখাইন রাজ্য কেন গুরুত্বপূর্ণ?

মিয়ানমারের সঙ্গে বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী রাখাইন রাজ্যে একটি গভীর সমুদ্রবন্দরসহ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড) নির্মাণ করছে চীন। রাখাইন রাজ্যের মংডু ও কিয়াপফু শহরে বিশেষ এই অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির কাজ করছে মিয়ানমার।

মংডুতে মিয়ানমার সরকার আর কিয়াপফুর অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ করছে চীন। মংডুর কানইন চ্যাঙ গ্রামে তৈরি হচ্ছে ‘মংডু স্পেশাল ইকোনমিক জোন’। বিশেষ এই অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়তে ‘নাফ রিভার গ্যালাক্সি ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট গ্রুপ’ নামে একটি কোম্পানির সঙ্গে রাখাইন রাজ্য সরকারের সমঝোতা স্মারক সই হয়। তারপর থেকে এই অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ কাজ শুরু হয়। সেখানে নামমাত্র মূল্যে জমি ইজারা ও করমুক্ত সুবিধা রাখা হয়েছে বিনিয়োগকারীদের জন্য।

রাখাইনের আরেক শহর কিয়াপফু। যেখানে চার হাজার একর জমির ওপর বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজ চলছে। সেখানকার তেল ও গ্যাস টার্মিনালেও অর্থায়ন করেছে চীনের পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন। জমি অধিগ্রহণকালে মূল্য পরিশোধ না করারও অভিযোগ রয়েছে।

রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিতাড়নের পর সেখানে অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির পরিকল্পনা ছিল মিয়ানমারের। রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে বেশ কয়েকটি অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরিই ছিল মিয়ানমারের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। সে কারণে রাখাইন থেকে দফায় দফায় রোহিঙ্গা জোরপূর্বক বাংলাদেশে পাঠিয়ে এখন সেখানের বিভিন্ন স্থানে অর্থনৈতিক জোন তৈরির কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া রাখাইনের বিভিন্ন এলাকায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কাজও শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছে দেশটি।

মিয়ানমারের বাণিজ্যমন্ত্রী এবং এসইজেড কেন্দ্রীয় কমিটির প্রধান উ থান মিন্টের বরাত দিয়ে গত বছরের অক্টোবর মাসে দ্য মিয়ানমার টাইমস এ সংক্রান্ত একটি খবরও প্রকাশ করে।

প্রকাশিত ওই খবরে চীন ও মিয়ানমারের মধ্যকার অর্থনৈতিক চুক্তির কথা জানিয়ে উ থান বলেছিলেন, রাখাইনে কায়ুকফায়ু বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণে রূপরেখা চুক্তি সইয়ের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে মিয়ানমার ও চীন। বিগত বছরের শেষ দিকেই এই চুক্তিটি হওয়ার আশাও প্রকাশ করেন তিনি। এর আওতায় চীন এসইজেড অঞ্চলে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ গভীর সমুদ্রবন্দরের ৭০ শতাংশের মালিক হবে। বাকি ৩০ শতাংশ থাকবে মিয়ানমার সরকার ও স্থানীয় সরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে।

উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, রাখাইন রাজ্যের পশ্চিমে যেখানে কায়ুকফায়ু বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হবে সেখান থেকে মাত্র ২০০ কিলোমিটার দূরে রোহিঙ্গা নিধন অভিযানে নেমেছিল দেশটির সেনাবাহিনী। বাণিজ্য বৃদ্ধি ও শিল্প কাঠামো গড়ে তোলার লক্ষ্যে এ অঞ্চলটিতে ১ হাজার ৭০০ হেক্টর এলাকা নিয়ে এ শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলা হবে।

বাংলাদেশ ও ভারতের সমুদ্র বন্দর থেকে খুব বেশি দূরে না হওয়ায় দেশদুটির কাছে, বিশেষ করে ভারতের জন্য মিয়ানমারে চীনের এই সমুদ্র বন্দর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

বর্তমানে চীনকে বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত সমুদ্রপথ মালাক্কা প্রণালি দিয়ে পশ্চিমা দেশ থেকে পণ্য পরিবহন ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেল আমদানি করতে হয়। রাখাইনের বন্দরটি হলে তা এড়িয়ে সময় ও ঝুঁকি কমাতে পারবে চীন।

বিগত কয়েক দশক ধরেই মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নিধনযজ্ঞ থেকে বাঁচতে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে রোহিঙ্গারা। এর মধ্যে গত বছরের ২৫ আগস্ট থেকে নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে গেলে তাদের দেশত্যাগের পরিমাণ বেড়ে যায়। সে সময় থেকে বাংলাদেশে এসেছে কমপক্ষে ৭ লাখ রোহিঙ্গা। যা পরবর্তীতে ১১ লাখ ছাড়িয়েছে।

মালয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের চায়না স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের গবেষক ড. সৈয়দ মাহমুদ আলী বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে চীনের দুটি স্বার্থের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, এর একটি হলো অন্যদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার পক্ষে তাদের চিরাচরিত পররাষ্ট্রনীতি - যার পাশাপাশি চীন চায় যে তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারেও অন্য কোন দেশ হস্তক্ষেপ না করুক।

"আর অপরটি হচ্ছে, তাদের কৌশলগত ও বাণিজ্যিক স্বার্থ - যার মূল কথা: তাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও তেল-গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য মালাক্কা প্রণালী ছাড়াও মিয়ানমারের ভেতর দিয়ে আরেকটি স্থলপথকে অক্ষুণ্ণ রাখা।"

চীনের এই নীতির বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়ে ড. আলি বলেন, রোহিঙ্গা প্রশ্নে তারা ২০১৭ সাল থেকেই বলে আসছে যে চীন ও বাংলাদেশের সরকারকেই আলোচনার মাধ্যমে একটা সমাধান করতে হবে - বাইরের কোন শক্তির হস্তক্ষেপ করা উচিত হবে না, কারণ তাতে সমস্যার সমাধান হবে না।

তিনি বলেন, চীনের নিজস্ব সমস্যা রয়েছে। তিব্বত বা শিনজিয়াং - এই দুই প্রদেশের অন্য জাতিগোষ্ঠীর লোক বাস করে এবং তাদের সাথে বহু দশক ধরে চীনের সংখ্যাগরিষ্ঠ হান সম্প্রদায়ের সংঘাত চলছে। চীন সরকার এই অঞ্চলগুলোকে শান্ত করার জন্য বেশ কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে।

এ নীতি দেখিয়েই তারা চাইছে, অন্য দেশগুলো চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করুক। এটা হচ্ছে একটি দিক। অন্য আরেকটি বিষয় ভুললে চলবে না যে বহু দশক ধরে মিয়ানমার চীনের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ। এর অনেক কারণ - তবে একটির কথা আমি বলতে চাই।"

সৈয়দ মাহমুদ আলির কথায়, "গত দু দশক ধরে চীনের ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ বাণিজ্য সমুদ্রপথে হচ্ছে। সেই বাণিজ্য মালাক্কা প্রণালী দিয়ে হয় এবং চীন জানে যে তার সাথে শত্রুভাবাপন্ন দেশ যুক্তরাষ্ট্র এবং তার আঞ্চলিক মিত্ররা চাইলেই চীনের বাণিজ্য বন্ধ করে দিতে পারে। এটাকেই বলে চীনের মালাক্কা সংকট।"

"এখন বাণিজ্য পথ খোলা রাখার জন্য চীন যদি সেখানে নৌবাহিনী পাঠায় - তাহলে সংকট আরো ঘনীভূত হবে - যাকে বলে চীনের মালাক্কা ডাইলেমা।"

"সেই মালাক্কা সংকটের কথা মাথায় রেখেই চীন স্থলপথে বিভিন্ন পাইপলাইনের মাধ্যমে তেল এবং গ্যাস যাতে চীনে পৌছাতে পারে- তার ব্যবস্থা করেছে। এরকম দুটি পাইপলাইন আরাকান অর্থাৎ মিয়ানমারের ভেতর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে এসে পৌঁছেছে।

ভারতেরও এ ধরণের বিনিয়োগ রয়েছে কালাদান এবং সিটওয়ে বন্দরে - কিন্তু চীনের অর্থনীতির জন্য এ দুটি পাইপলাইন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সে জন্যই চীন চাইছে না যে মিয়ানমার সরকার যেন আরাকানের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ হারায়, বা আরাকানকে কেন্দ্র করে চীন-মিয়ানমার সম্পর্ক খারাপ হোক।

অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার চীনের যে নীতি - তার সূচনা কিভাবে হয়েছিল তা ব্যাখ্যা করে ড. আলি বলেন, তিব্বতে ১৯৫৪ সালে যখন গৃহযুদ্ধ চলছিল - যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত তখন তিব্বতী যোদ্ধাদের সমর্থন দিচ্ছিল। সেই যুদ্ধ অবসানের লক্ষ্য নিয়ে চীন এবং ভারত সরকার ১৯৫৪ সালে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। সেই চুক্তিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে পাঁচটি আদর্শের কথা বলা হয়েছিল। তার প্রথমটি ছিল - কোন দেশই অন্য কোন দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে না। জাতিসংঘের সনদেও এমনটা লেখা আছে।

"১৯৫৫ সালে ইন্দোনেশিয়ার বান্দুং-এ আফ্রিকান এবং এশিয়ান দেশগুলোর এক সম্মেলনে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সূচনা হয়। সেখানেও বলা হয়েছিল, এই আদর্শগুলোকে অনুসরণ করেই জোটনিরপেক্ষ দেশগুলোকে পরস্পরের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখবে। চীন আনুষ্ঠানিকভাবে এই পাঁচটি নীতিমালা এখনো বজায় রেখেছে, সেকারণেই তারা অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে অন্তত আনুষ্ঠানিকভাবে চাইছে না। মিয়ানমারের ক্ষেত্রেও তাই প্রযোজ্য।"

তাহলে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের ক্ষেত্রে আসল চাবিকাঠি কার হাতে এমন প্রশ্নের জবাবে জবাবে সৈয়দ মাহমুদ আলি বলেন, লক্ষ্য করার বিষয় যে অন্য ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকলেও রোহিঙ্গা বা মিয়ানমার বিষয়ে তাদের নীতি মোটামুটি একই রকম।

তিনি বলেন, "বাংলাদেশ যদি আলোচনার মাধ্যমে মিয়ানমারের সাথে এ সংকটের সমাধানে আগ্রহী হয় - তাহলে আমার মনে হয় বাংলাদেশের দুটি বন্ধু রাষ্ট্র ভারত ও চীন - এই দুই রাষ্ট্রের সহযোগিতার মাধ্যমেই মিয়ানমারের সাথে আলোচনা করা সম্ভব।” কিন্তু ভারত এবং চীনকে বাদ দিয়ে এ সংকটের সমাধান সম্ভব বলে আমার মনে হয় না - বলেন তিনি।

এদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মিয়ানমার সফরে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানের পথ উন্মোচিত হবে বলে আশা করা হয়েছিল। তবে এ বিষয়ে বন্ধু রাষ্ট্র ভারত যে নিজ স্বার্থই আগে দেখবে সেটা বুঝতে হয়ত দেরিই ছিল বাংলাদেশের কাছে।

মূলত অর্থনীতি, ভূ-রাজনীতি এবং দলীয় নীতির কারণেই ভারত রোহিঙ্গাদের নিয়ে কোনো আগ্রহ দেখায়নি৷ বরং ভারতের কাছে গুরুত্ব পেয়েছে দেশের অভ্যন্তরীণ স্বার্থ৷ বিশ্লেষকরা বলছেন, রোহিঙ্গা নয়, মিয়ানমার এখন ভারতের কাছে নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ৷ তাই মিয়ানমারকে না চটিয়ে এই সফরে দেশটিকে আরো কাছে টানতে তৎপর ছিলেন মোদী৷ তিনি মিয়ানমারের ডি-ফ্যাক্টো নেত্রী অং সান সু চির সঙ্গে বৈঠক করেছেন৷ ইয়াঙ্গুনের কালীমন্দিরে গেছেন, পুজোও দিয়েছেন৷

ভারত স্বপ্ন দেখছে ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড – ত্রিদেশীয় হাইওয়ে প্রকল্প নিয়ে। আর তার জন্য প্রথম যাকে লাগবে, সেই দেশটি হলো মিয়ানমার৷ আসিয়ান জোটের দেশগুলোর সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়াতেও প্রথম যাকে ভারতের দরকার, সে দেশটিও হলো মিয়ানমার৷ বিসটেক জোটেও ভারতের সহযোগী মিয়ানমার৷ তাই ‘কানেকটিভিটি' এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে মিয়ানমার ভারতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷

বলা বাহুল্য, মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ভারতের মাথাব্যথার অন্যতম কারণ। মিয়ানমারে কায়াখফু বন্দর তৈরি করে দিচ্ছে চীন৷ এছাড়া দু'দেশের মধ্যে গ্যাস লাইন বসানোর কাজও চলছে৷

অন্যদিকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য দিয়ে ভারত প্রায় ৫০ কোটি ডলার খরচ করে ‘কালাদান মাল্টি-মোডাল ট্রান্সপোর্ট প্রোজেক্ট'-এর কাজ করছে৷ এই ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল আর বঙ্গোপসাগরের মধ্যে সরাসরি সংযোগ গড়ে তুলবে৷ ভারতের টার্গেট – বাংলাদেশ যদি কখনো ভারতকে ট্রানজিট দিতে অস্বীকার করে, তাহলে মিয়ানমারের মধ্য দিয়েই হবে ট্রানজিট৷

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক ড. শান্তনু মজুমদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মিয়ানমারকে চটানোর কোনো কারণ নেই ভারতের৷ তারা চীনের কারণে মিয়ানমারকে সঙ্গে নিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করতে চায়৷ বঙ্গোপসাগরে ভারতের বড় স্বার্থ আছে৷ আর ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্যও মিয়ানমার ভারতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ৷''

তিনি বলেন, ‘‘মিয়ানমার দীর্ঘদিন ধরেই চীনের প্রভাব বলয়ে আছে৷ ভারত চাইছে সেই প্রভাবটা হালকা করে দিতে৷ ভারতের কাছে ভূ-রাজনৈতিকভাবে মিয়ানমার গুরুত্বপূর্ণ৷ বাংলাদেশেরও গুরুত্ব আছে৷ তবে তা মিয়ানমারকে বাদ দিয়ে নয়৷ তাই মিয়ানমার নিয়ে বাংলাদেশের কোনো প্রত্যাশা আছে কিনা, মোদী সেটা মাথায় রাখার প্রয়োজন মনে করেননি৷''

অধ্যাপক মজুমদার মনে করেন, ‘‘বিজেপির নীতির সঙ্গেও চমৎকার মিলে গেছে মোদীর এই আচরণ৷ বিজেপি একটি সাম্প্রদায়িক দল৷ তাই মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমান নির্যাতন নিয়ে মোদীর কথা না বলাটাই স্বাভাবিক৷''

অন্যদিকে ভারতের ইকনমিক টাইমস-এর ডিপ্লোম্যাটিক এডিটর দীপাঞ্জন রায় চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মিয়ানমার সফরে নরেন্দ্র মোদী রোহিঙ্গাদের নিয়ে কথা বলেছেন৷ তবে কথাগুলো তিনি ভিন্নভাবে বলেছেন৷''

দীপাঞ্জন রায় চৌধুরীর কথায়, ‘‘ভারত-মিয়ানমারের যৌথ সমঝোতা স্মারকটা দেখলে বোঝা যায় যে ভারত রোহিঙ্গাদের কথা একটু ঘুরিয়ে বলেছে৷ কারণ বাংলাদেশ যেভাবে দেখবে ভারতের কাছে বিষয়টি সেরকম হবে, সেটা আশা করা যায় না৷ ভারত বলেছে, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি কীভাবে করা যায় যাতে ‘মাইগ্রেশন' না হয়৷ এ নিয়ে যৌথভাবে কিছু কাজ করার কথাও হয়েছে৷ তাই উনি (মোদী) যে রোহিঙ্গাদের নিয়ে কোনো কথা বলেননি, এটা বলা ভুল৷''

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘কালাদান মাল্টি-মোডাল প্রজেক্ট, ত্রিদেশীয় হাইওয়ে, ভারতের উত্তর-পূর্বের সঙ্গে মিয়ানমারে আরো একটি যোগাযোগ প্রকল্প রয়েছে৷ এগুলো ২০২১ সালের মধ্যে শেষ করার তাগিদ আছে৷ এই সফরে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্তও হয়েছে৷''

ভারতের বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘‘বঙ্গোপসাগর ছাড়াও মিয়ানমারের সঙ্গে ভারতের ১৬৪৩ কিলোমিটার স্থল সীমান্ত আছে৷ এই সীমান্ত অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড, মণিপুর ও মিজোরাম – এই চারটি রাজ্য জুড়ে, যার অন্য প্রান্তের গহীন জঙ্গলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অনেক জঙ্গি গোষ্ঠীরই ঘাঁটি রয়েছে৷ তাই মিয়ানমারের সহযোগিতা ভারতের প্রয়োজন৷''

মালাক্কা সংকট ও চীনের ভূ রাজনীতি

২০০৩ সালে তখনকার চীনা প্রেসিডেন্ট হু জিন তাও সর্বপ্রথম ‘মালাক্কা ডিলেমা’ কথাটি চালু করেন। আরও আগে ১৯৪২-৪৩ সালে চীনারা মালাক্কা ডিলেমার বেকায়দাটা ভালোমতো টের পেয়েছিল। বাংলাদেশের কাছেই (দক্ষিণ-পূর্ব দিকে) ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার মাঝের সরু সমুদ্র প্রণালীটি হচ্ছে মালাক্কা প্রণালী। এ প্রণালী হল ভারত মহাসাগর থেকে প্রশান্ত মহাসাগরে ও চীন সাগরে যাওয়ার প্রধান ও সংক্ষিপ্ততম সমুদ্রপথ।

প্রতিবছর ৬০ হাজারেরও বেশি জাহাজ চলাচল করে এ সরু সমুদ্র প্রণালী দিয়ে। গোটা বিশ্বের বার্ষিক বাণিজ্যের ২৫ শতাংশ ঘটে এ সমুদ্রপথ দিয়ে। এর চেয়েও বড় বিষয় হল- চীনের জ্বালানি তেলের চাহিদার শতকরা ৮০ ভাগই এ পথে আরব দেশ (মধ্যপ্রাচ্য) থেকে চীনে আসে। এ জন্য চীনের যত মাথাব্যথা! কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চীনের শত্রুপক্ষ এ মালাক্কা প্রণালীতে অবস্থান নিয়েছিল। ফলে এ প্রণালীর নৌপথে চীনের জাহাজ চলাচল কঠিন ছিল। কার্যত চীন তখন ছিল জাপান দ্বারা অবরুদ্ধ।

ওই সময় বাংলাদেশসহ গোটা ভারতবর্ষই ছিল ব্রিটিশের অধীনস্থ উপনিবেশ, আর ব্রিটিশরা তখন ছিল চীনের বন্ধু। আমেরিকাও ছিল চীনের পক্ষে। যে কারণে আমেরিকান জেনারেল স্টিলওয়েলের নেতৃত্বে আমেরিকান সৈন্যরা ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কলকাতায় অবস্থান নিয়েছিল আর তাদের পাইলটরা বিমানে করে ‘হিমালয়ের কুজে’র (সুউচ্চ হিমালয় পর্বতমালা) ওপর দিয়ে বিপুল পরিমাণ মালামাল ‘এয়ার লিফট’ (বিমান দ্বারা পৌঁছানো) করে অবরুদ্ধ চীনকে স্বস্তি দিয়েছিল। তবে এখন আর সেই খাতির নেই।

ভারত, আমেরিকা, জাপান ও ব্রিটেন এখন চীনকে ভয়ের চোখে দেখে। তারা উপরে উপরে চীনের সঙ্গে বন্ধুভাব দেখালেও সময় মতো যে শত্রুতা করবে, চীন তা ভালোভাবেই বোঝে। তাই আগামীতে মালাক্কা প্রণালী অবরুদ্ধ হলে ভারতের ওপর দিয়ে ‘এয়ার লিফট’ পাওয়া যাবে না- এটা চীনের কাছে পরিষ্কার।

১৯৭৮ সালে চীনা প্রেসিডেন্ট দেং জিয়াও পিংয়ের করা সংস্কারের ফলে চীন দ্রুত শিল্পায়িত হয়েছে, জনসংখ্যাও অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে মালাক্কা প্রণালীর সমুদ্রপথে চীনের জ্বালানি ও পণ্য পরিবহনের চাপও দিন দিন বাড়ছে। এভাবে চীনের কাছে মালাক্কা প্রণালীর গুরুত্ব ও নির্ভরতা যতই বাড়ছে, চীনের প্রতিপক্ষরা ততই মালাক্কা প্রণালীতে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে চলেছে; যেমন- এ অঞ্চলে আমেরিকার বড় নৌঘাঁটি ছিল ফিলিপাইনে। কিন্তু ১৯৯১ সালের দিকে তা এগিয়ে সিঙ্গাপুরে আনার সিদ্ধান্ত নেয় আমেরিকা। আর এ সিঙ্গাপুর হচ্ছে মালাক্কা প্রণালীর একদম দক্ষিণ মুখে- যা বঙ্গোপসাগরের পূর্বদিকের প্রবেশদ্বারও বটে!

উল্লেখ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান দ্রুত হামলা চালিয়ে সিঙ্গাপুর দখল করেছিল, যার দরুন চীন অবরুদ্ধ হয়েছিল। আবার মালাক্কা প্রণালীর উত্তর-মুখে দীর্ঘ শিকলের মতো দাঁড়িয়ে আছে ভারতের আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপমালা। সেখানে পোর্ট ব্লেয়ারে আছে ভারতের শক্ত সামরিক উপস্থিতি। এসব কারণে মালাক্কা প্রণালীর প্রতিটি মুখই বলতে গেলে চীনের প্রতিপক্ষদের কব্জায়। তদুপরি মালাক্কা প্রণালীর ভেতরে আন্তঃদেশীয় জলদস্যুদের উৎপাত দিনে দিনে বাড়ছে, যা এ প্রণালীতে নিরাপদ জাহাজ চলাচলকে ক্রমাগত কঠিন করে তুলছে। এ প্রণালীর আশপাশেই রয়েছে মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া ও অন্যান্য দেশের এমন কিছু এলাকা- যেখানে মুসলিম, বৌদ্ধ এমনকি খ্রিস্টান সশস্ত্র চরমপন্থী দল-উপদলের অবাধ বিচরণ রয়েছে। এ চরমপন্থীরা এক সময় জলদস্যুদের সঙ্গে হাত মেলাতে পারে এ আশঙ্কায় আমেরিকা ও জাপান মালাক্কা প্রণালীর সাগরপথে নৌ ও বিমান টহলদারি চালু করতে চাইছে। তবে সার্বভৌমত্ব রক্ষার স্বার্থে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া তা করতে দিতে রাজি নয়।

মালাক্কা প্রণালীর এহেন নাজুক পরিস্থিতির কারণে চীন বেশকিছু স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি বিকল্প পদক্ষেপ নিয়েছে; প্রথমত- নিজ দেশের খনি থেকে তোলা কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা, রোহিঙ্গাদের আবাসভূমি রাখাইনের ‘স’ (Shew) সামুদ্রিক গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন করে পাইপলাইনের মাধ্যমে চীনে নিয়ে যাওয়া, পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী উৎপাদনের প্রসার ইত্যাদি। এগুলো মূলত মালাক্কা প্রণালী পথে আমদানি করা তেলের ওপর নির্ভরতা কমানোর পদক্ষেপ। এছাড়া জ্বালানি তেলের আপৎকালীন চাহিদা পূরণের জন্য কৌশলগত মজুদ হিসেবে ২০০৪ সালে চীন তার পূর্বাঞ্চলীয় গুং ডং ও হাইনান প্রদেশে চারটি এসপিএস (SPS- Strategic Petroleum Stockpile) তৈরির উদ্যোগ নেয়, যেগুলোতে গোটা চীনের ২০ থেকে ৩০ দিনের চাহিদা পূরণের মতো জ্বালানি তেল মজুদ করা সম্ভব বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু এগুলো স্থায়ী সমাধান নয়।

যতদূর জানা যায়, ১৯৭৭ সালের দিকে চীন সরকার মালাক্কা প্রণালী এড়িয়ে নতুন ট্রানজিট নৌপথ তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিল। চেষ্টা করেছিল আন্দামান সাগর থেকে দক্ষিণ থাইল্যান্ডের ‘ক্রা ইসথমুসে’র ওপর দিয়ে থাই উপসাগর পর্যন্ত দু’লেন বিশিষ্ট একটা কৃত্রিম খাল খননের। সেই খালের সমান্তরালে নির্মাণ করা হতো পূর্ব-পশ্চিমমুখী মহাসড়ক। মহাসড়কের দু’প্রান্তে থাকতো দুটি পোতাশ্রয়, দুটি তেল শোধনাগার এবং দুটি সংরক্ষণাগার। ভাবা হয়েছিল- এতে অনেক কর্মসংস্থান হবে, তেল শোধনাগার ও ট্রানজিট বাবদ অনেক রাজস্ব আসবে, এমনকি বিশ্ব অর্থনীতিও এতে অনেক সুফল পেত। ধারণা করা হয়, এ পথে জাহাজের ২-৩ দিনের চলার সময় বেঁচে যেত। এসব কারণে এর নাম দেয়া হয়েছিল ‘এশিয়ার পানামা খাল’। এ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ভূ-রাজনৈতিক ঝড়-ঝাপটা বাংলাদেশের অনেক দূর দিয়ে বইতো। আমরা ও রোহিঙ্গারা বেশ স্বস্তিতে থাকতে পারতাম। কিন্তু বিধি বাম! আর্থিক, কারিগরি ও নিরাপত্তাজনিত কারণ দেখিয়ে ২০০১ সাল পর্যন্ত সব মিলিয়ে ১০-১২ বার এ প্রকল্পের কাজ থমকে থাকে। এরপর ২০০৩ সালে তখনকার থাই প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রা এ প্রকল্পে অর্থায়ন না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রকল্পটিকে চূড়ান্তভাবে বন্ধ করেন।

এরপর চীন মরিয়া হয়ে ভিন্ন পথ ধরে। এখন তাদের লক্ষ্য মালাক্কা প্রণালীকে একদম এড়িয়ে নিজ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আমদানিকৃত তেল-গ্যাস সরাসরি পৌঁছানো। বাংলাদেশের সেন্টমার্টিন দ্বীপের কিছুটা দক্ষিণ-পূর্বে রাখাইনের (সাবেক আরাকান) সিত্তাওয়ে (প্রাচীন আকিয়াব) বন্দরের কাছে মেড দ্বীপে জ্বালানি তেলের টার্মিনাল তৈরি করেছে চীন। একই সঙ্গে চীন পাশের কিয়াকপিউ দ্বীপে গভীর সমুদ্র বন্দর এবং এর লাগোয়া অঞ্চলে স্পেশাল ইকোনমিক জোনও তৈরি করেছে। এগুলো চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচির অংশ। এর কিছুটা দক্ষিণ-পূর্বে পূর্বোল্লেখিত আন্দামান সাগরের ‘স’ গ্যাসক্ষেত্রে ৯.১ ট্রিলিয়ন কিউবিক গ্যাস সঞ্চিত রয়েছে- যার ৮০ শতাংশ পাবে চীন, বাদবাকি ২০ শতাংশ মাত্র থাকবে মিয়ানমারের ভাগে! এ গ্যাসক্ষেত্র থেকে চীনের কুনমিং প্রদেশ হয়ে গোঞ্জেহ প্রদেশ পর্যন্ত গ্যাস পাইপলাইন বসানো হয়েছে, যা দিয়ে এখন বছরে ২০ মিলিয়ন কিউবিক মিটার গ্যাস সঞ্চালিত হচ্ছে।

আরাকানের মেড দ্বীপে চীনের জ্বালানি তেলের টার্মিনাল থেকে কুনমিং প্রদেশ পর্যন্ত বসানো হয়েছে দীর্ঘ পাইপলাইন। জানা যায়, ২০১৭ সালের জুলাইয়ে যখন রোহিঙ্গা উচ্ছেদের প্রস্তুতি নিচ্ছিল মিয়ানমারের সেনাবাহিনী, তখন এ টার্মিনালে প্রথম সৌদি অশোধিত তেল খালাস করা হয়েছে। রাখাইন থেকে চীন পর্যন্ত রেললাইন বসানোর পরিকল্পনাও রয়েছে, তবে বিভিন্ন আপত্তির মুখে তা এখনও হয়ে ওঠেনি।

মার্কিন ভূ রাজনীতি ও জঙ্গিবাদের উত্থান

রোহিঙ্গা ইস্যুতে যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। এই স্বার্থটা যেমন মিয়ানমারের সঙ্গে তেমনই রয়েছে বাংলাদেশের সঙ্গেও এমনটাই মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক তারেক শামসুর রেহমান।

তিনি বলেন, স্ট্র্যাটেজিক্যালি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ওই অঞ্চলের গুরুত্ব অনেক বেশি। মিয়ানমারের তথাকথিত ‘গণতান্ত্রিক সরকারকে’ আস্থায় রেখে যুক্তরাষ্ট্র তাদের স্বার্থ আদায় করে নিতে চায়। তাদের স্ট্র্যাটেজি পরিষ্কার—চীনের বিরুদ্ধে মিয়ানমারকে ব্যবহার করা। এ অঞ্চলে বিদ্রোহীদের উসকে দিয়ে চীনে গ্যাস তথা তেল সরবরাহের পাইপলাইন বন্ধ করে দেওয়া। এর ফলে চীনের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। একই সঙ্গে বৃহত্তর বঙ্গোপসাগরে যুক্তরাষ্ট্র তার মেরিন উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায়। এই মেরিন উপস্থিতি প্রয়োজনে চীনা গ্যাস ও তেল সরবরাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারবে। চীনের প্রচুর জ্বালানি শক্তির প্রয়োজন। চাহিদাও বেশি। ওই জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতেই চীন এ অঞ্চলের সমুদ্রবন্দরগুলোকে একটি নেটওয়ার্কের আওতায় এনেছে, যাকে চীন বলছে ‘মুক্তার মালা’ নীতি। এই নেটওয়ার্ক যদি ভেঙে ফেলা যায়, তাহলে চীনের জ্বালানি সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেবে। এমনকি চীন যে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ নামে এক মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে তা-ও বাস্তবায়িত হবে না। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজির সঙ্গে মিল আছে ভারতের। ভারত এ মহাপরিকল্পনায় যুক্ত হয়নি। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ হচ্ছে মিয়ানমারকে তাদের একটি পরিকল্পনায় যুক্ত করা।

মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। ফলে মিয়ানমারের সেনা নেতৃত্ব কখনোই চীনবিরোধী কোনো অ্যালায়েন্সে যোগ দেবে না। তাই সংগত কারণেই মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ইস্যুটি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্ব পাবে কম। তবে এখানে আরো একটা সম্ভাবনার কথা একেবারে ফেলে দেওয়া যায় না। আর তা হচ্ছে আরাকান মুসলিম নিধনকে সামনে রেখে এ অঞ্চলে আল-কায়েদা ও আইএসের জঙ্গি সংগঠনের উত্থান ও তাদের সামরিক তৎপরতা!

মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস

আরাকান স্যালভেশন আর্মির খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের সশস্ত্র তৎপরতা ও তাদের নেতাদের বক্তব্য প্রচারিত হচ্ছে। আইএস এভাবেই সিরিয়া ও ইরাকে তাদের তৎপরতা বৃদ্ধি করে বিশ্বকে অবাক করে দিয়েছিল। এখন তাদের সেই ‘খিলাফতের’ দিন শেষ। সিরিয়ার রাকা থেকে আইএস এখন পালাচ্ছে। ভুলে গেলে চলবে না, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়ায় আইএস তথা আল-কায়েদা সংশ্লিষ্ট জঙ্গি সংগঠনগুলো তৎপর। ফিলিপাইনের সলু দ্বীপপুঞ্জের একটি এলাকা নিয়ে তারা সেখানে তাদের ‘প্রশাসন’ প্রতিষ্ঠা করেছে। সেনাবাহিনী সেখানে দীর্ঘদিন ধরে অপারেশন পরিচালনা করছে।

ফলে জঙ্গি সংগঠনগুলোর তৎপরতা এখন সিরিয়া-ইরাক থেকে হ্রাস পেয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কেন্দ্রীভূত হয়েছে। সুতরাং জঙ্গি সংগঠনগুলোর কাছে আরাকান এখন একটি মোক্ষম এলাকা। বঙ্গোপসাগরবেষ্টিত আরাকানে জঙ্গি তৎপরতা বেড়ে যাওয়ার জন্য উত্তম একটি জায়গা। ভয়টা হচ্ছে আইএস যদি আরাকানে ঘাঁটি গাড়তে পারে তাতে আক্রান্ত হবে বাংলাদেশও। বৃহত্তর কক্সবাজার অঞ্চলে জঙ্গি তৎপরতা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকবে।

রোহিঙ্গা সমস্যার একটি ধর্মীয় দিক আছে, এটা সত্য। মিয়ানমারে কট্টরপন্থী বৌদ্ধদের প্রভাব বাড়ছে। তারা মিয়ানমারকে একটি বৌদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়। তারা মুসলমানদের উৎখাত করে আরাকানে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়াতে চায়, এটা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও সত্য, মিয়ানমারে একদিকে বহুজাতিক কম্পানির প্রভাব বাড়ছে, অন্যদিকে বৃহৎ শক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের আর্থিক সংশ্লিষ্টতা বাড়ছে। আরাকানের গভীর সমুদ্রে গ্যাস ও তেলপ্রাপ্তি ভবিষ্যতে এ অঞ্চলের পরিস্থিতিকে আরো জটিল করবে। চীন একদিকে তার তেল ও গ্যাস সরবরাহ (থান শ গ্যাসক্ষেত্র থেকে পাইপযোগে ইউনানের কুনমিং) যেমন নিশ্চিত করতে চাইবে, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র চাইবে এতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে। ফলে আরাকানের পরিস্থিতি যে ভবিষ্যতে আরো জটিল হবে, তা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি। ফলে এই ভূ-রাজনীতি আর করপোরেট স্বার্থ রোহিঙ্গা পরিস্থিতিকে ‘নিয়ন্ত্রণের বাইরে’ নিয়ে যেতে পারে।

মিয়ানমারে বাংলাদেশের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে। বিমসটেক কিংবা বিসিআইএম করিডরে দেশ দুটি একসঙ্গে কাজ করছে। বাংলাদেশ তাই অর্থনৈতিক স্বার্থকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। বাংলাদেশ প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে মানবিকতা প্রদর্শন করেছে, যা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু এর নেতিবাচক দিকটিও বিবেচনায় নিতে হবে। এত বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার উপস্থিতি, আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনগুলোর তৎপরতা আরাকানসহ বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী একাধিক জেলাকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। আইএস সিরিয়া ও ইরাকের একটা অংশ নিয়ে তথাকথিত ‘ইসলামিক স্টেট’ প্রতিষ্ঠা করেছিল। মার্কিন (এবং ইসরায়েলি কানেকশনে) গোপন দলিলে একটি তথাকথিত ‘রোহিঙ্গা ল্যান্ড’ প্রতিষ্ঠার খবরও আমি পড়েছি। ভবিষ্যতে কী হবে বলা মুশকিল। তবে বাংলাদেশ যে বড় ধরনের সংকটের মধ্যে পড়ল, তা অস্বীকার করা যাবে না।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবাদ দমন ও সহিংস জঙ্গিবাদ মোকাবিলা বিষয়ক ব্যুরোর আঞ্চলিক ও বহুপাক্ষিক বিষয়ক উপ-সমন্বয়কারী জন টি গডফ্রে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের অবস্থান এমন একটা জায়গায়, যেখানে আইএস ও অন্যান্য জঙ্গিগোষ্ঠীর ব্যাপক আগ্রহ আছে। তারা নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধি কিংবা নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। এই হুমকি মোকাবিলায় আরও বেশি সতর্ক থাকা প্রয়োজন। প্রয়োজন নজরদারি বাড়ানো।’

গত কয়েক বছর ধরে আইএস-এর উত্থান-পতন হয়েছে, কিন্তু আল কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশের যে শাখা, তারা চুপচাপ রয়েছে। তারা বাংলাদেশের জন্য ভবিষ্যতে আতঙ্কের বিষয় হতে পারে কিনা এ প্রসঙ্গে গডফ্রে বলেন, “হ্যাঁ, গত কয়েক বছর ধরেই পুরো বিশ্ব আইএস-এর দিকে বেশি নজর দিয়েছে। কারণ, তারা ইরাক-সিরিয়াসহ বিভিন্ন জায়গায় নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। কিন্তু আল কায়েদা হলো সুযোগসন্ধানী একটা সংগঠন। তারা চুপচাপ থেকে নিজেদের পুনর্গঠিত করেছে। তাদের নেটওয়ার্ক বৃদ্ধি করেছে। আন্তঃদেশীয় সন্ত্রাসবাদের জন্য তারা ‘ভ্যানগার্ড’ হিসেবে কাজ করে। তারা আবার নিজেদের অবস্থান ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছে। এটা অবশ্যই চিন্তার বিষয়।”

ওডি/এআর

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড