• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

আশার বাণীতে প্রত্যাবাসন, কেন ফিরতে নারাজ রোহিঙ্গারা?  

  আয়াজ উর রাহমান

২২ আগস্ট ২০১৯, ১৫:৪২
রোহিঙ্গা সংকট
রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির (ছবি : সংগৃহীত)

মিয়ানমারে জাতিগত নিধন ও নির্যাতনের শিকার হয়ে কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে ইতোমধ্যেই ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে বাংলাদেশ। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে ঘিরে মিয়ানমার, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিনিধি দলও কক্সবাজারে অবস্থান করছে। তবে সব প্রস্তুতি ভেস্তে দিলো বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীরা।

বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) দুপুরে শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. আবুল কালাম সাংবাদিকদের জানান, সাক্ষাৎকার দেওয়া ২৯৫ রোহিঙ্গা পরিবারের কেউ স্বেচ্ছায় মিয়ানমার ফিরতে রাজি নয়। রোহিঙ্গারা রাজি না হওয়ায় প্রত্যাবাসন শুরু হবে কিনা তা এখন প্রায় অনিশ্চিত।

এদিকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ঘিরে শরণার্থী ক্যাম্পের ভেতরে সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, ইউএনএইচসিআর প্রতিনিধি, সেনাবাহিনী ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য উপস্থিত রয়েছেন।

একই সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের শালবাগান ২৬ নম্বর রোহিঙ্গা শিবিরের সামনে প্রধান সড়কের পাশে ৫টি মাইক্রো, ৩টি বাস ও ২ ট্রাক প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এছাড়া লেদা ক্যাম্পের পাশে আরও দুটি বাস অপেক্ষা করছে।

তবে সব প্রস্তুতির মধ্যেই রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় ফেরত না যাওয়ার মতামত অনেকটাই থমকে দিয়েছে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে।

এর আগে রাখাইনে জাতিগত নিধন ও নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে ৩ হাজার ৫৪০ জনকে ফেরত নেওয়ার আশা দেয় মিয়ানমার। গত বৃহস্পতিবার মিয়ানমারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্স এ তথ্য জানায়। রয়টার্সের খবরে বলা হয়, আগামী ২২ আগস্ট প্রাথমিকভাবে তিন হাজার ৫৪০ জন রোহিঙ্গা নাগরিককে ফিরিয়ে নেবে মিয়ানমার।

তবে জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রস্তাবিত শর্ত মানলেই কেবল মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা ফিরতে রাজি বলে আগেই জানায় বাংলাদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গা নেতারা। তাদের অভিযোগ, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য যেসব শর্ত বাংলাদেশ সরকার উত্থাপন করেছে মিয়ানমার সেগুলো অগ্রাহ্য করে বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে।

রোহিঙ্গা নেতা হামিদ হোসেন ও মোঃ ইলিয়াছ দাবি করেন, প্রত্যাবাসনের নামে ৪৫টি ক্যাম্পে বন্দি করে রোহিঙ্গাদের ফের অমানবিক নির্যাতনের পাঁয়তারা করছে মিয়ানমার সরকার। তাদের হারানো ১৯৮টি পাড়া-মহল্লায় পুনর্বাসন, সহায় সম্পদ ফেরত ও নাগরিকত্বের দাবি না মানা পর্যন্ত কোনো রোহিঙ্গাই মিয়ানমারে ফিরে যাবে না।

অন্যদিকে শরণার্থী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব) আবুল কালাম জানান, এই পরিস্থিতিতে কেবল স্বেচ্ছায় যেতে চাইলেই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন করা হবে।

তবে মিয়ানমারে জাতিগত নিধন ও হত্যার শিকার রোহিঙ্গারা নিরাপত্তার অভাব বোধ করায় আগে থেকেই সেখানে ফেরতের ব্যাপারে অনেকটাই অনিচ্ছুক ছিল। তাই বাংলাদেশে স্থায়ী বসবাসে শিশু জন্মের হারও বাড়ায় রোহিঙ্গারা। এ বিষয়ে তাদের উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে কিছু এনজিও প্রতিষ্ঠান বলে জানায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক যুগ্ম সচিব।

ইন্টার সেক্টর কোঅর্ডিনেশন গ্রুপের দেওয়া তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৬৩ শতাংশ নারী। এদের মধ্যে ১৩ শতাংশ কিশোরী এবং ২১ শতাংশ গর্ভবতী ও প্রসূতি। শিশুদের মধ্যে ৬-১৮ বছর বয়সী শিশুর হার ২৩ শতাংশ, ৫ বছরের কম বয়সী শিশুর হার ২১ শতাংশ এবং ১ বছরের কম বয়সের শিশুর হার ৭ শতাংশ।

জাতিসংঘ জানিয়েছে, বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রতিদিন অন্তত ৬০ শিশু জন্ম নিচ্ছে। বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি এডওয়ার্ড বেইগবেডার এই তথ্য জানান।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে পরবর্তী তিন মাসে মিয়ানমারে সেনা নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে আশ্রয় নেয় ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। এদের মধ্যে প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা নারী গর্ভবতী অবস্থায় বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এর আগে ১৯৬৮ সাল থেকে বাংলাদেশে আশ্রিত রয়েছে আরও অন্তত চার লাখ রোহিঙ্গা। নতুন করে অনুপ্রবেশের পর গত ২০ মাসে এখানে জন্ম নিয়েছে আরও প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গা শিশু। জানা গেছে, ক্যাম্পগুলোতে প্রতিদিন গড়ে জন্ম নিচ্ছে ৮০ থেকে ১০০ শিশু।

অন্যদিকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের খবরে উদ্বেগ প্রকাশ করে মিয়ানমার এবং বাংলাদেশে কর্মরত ৬১টি স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা (এনজিও)।

বুধবার (২১ আগস্ট) এক যৌথ বিবৃতিতে তারা জানায়, দুই বছরেও ন্যায় বিচার পায়নি মিয়ানমারে অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। তারা সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে সুরক্ষা ও মর্যাদার জন্য। সেই সাথে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন বিষয়ক সাম্প্রতিক খবরে তারা শঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন এবং নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্কিত।

বিবৃতিতে বলা হয়, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গাদের অংশগ্রহণ খুবই সীমিত। তাই ভবিষ্যতেও স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার সুরক্ষিত হয় না বলে মনে করে মানবাধিকার সংগঠনগুলো।

চলতি সপ্তাহের মধ্যে আনুমানিক ৩,৪৫০ রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনের সংবাদ প্রকাশ পাওয়ার পর নিরাপদ, স্বেচ্ছা ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিশ্চিতের জন্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানায় ৬১ এনজিও।

রাখাইন রাজ্যে এখনো রোহিঙ্গাদের চলাচলের স্বাধীনতা ও মানবাধিকার চর্চার ক্ষেত্রে কোনো অর্থপূর্ণ অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না এবং বাস্তুচ্যুত কমিউনিটির সঙ্গে আলোচনার পরিসর খবই সীমিত বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

এতে আরও বলা হয়, বৈষম্যমূলক নীতির কারণে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর চলাচলের ক্ষেত্রে কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপের পাশাপাশি পড়াশোনা, স্বাস্থ্যসেবা এবং জীবিকার অধিকারের ক্ষেত্রে আরও সীমিত করে দেওয়া হয়েছে সুযোগ-সুবিধা।

২০১২ সাল থেকে প্রায় ১ লাখ ২৮ হাজার রোহিঙ্গা ও অন্যান্য মুসলিম সম্প্রদায় রাখাইন রাজ্যের শিবিরে আটকা পড়ে আছে, ফিরতে পারছে না নিজ বাড়িতে। অন্যদিকে সীমিত করে দেওয়া হয়েছে মানবাধিকার সংস্থাদের প্রবেশাধিকার, যোগ করা হয় বিবৃতিতে।

তাই রাখাইন রাজ্যের অধিবাসীদের মানবাধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিজের জীবন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া এমনকি মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে শর্ত দেওয়াসহ তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়েছে এনজিওগুলো।

তারা মনে করে, রোহিঙ্গাদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতের পাশাপাশি রাখাইন রাজ্যের সব সম্প্রদায় যাতে নিরাপদে থাকতে এবং প্রাথমিক পরিষেবা ও জীবিকার সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করতে পারে তা মিয়ানমার সরকারের নিশ্চিত করা উচিত।

বর্তমান সমস্যার সমাধানে এনজিওগুলো কিছু সুপারিশ দিয়েছে। যার মধ্যে আছে- রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যত নির্ধারণের জন্য যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের অর্থবহ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকারকে সম্মান করা, শিক্ষা, জীবিকা ও সুরক্ষায় রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ে সহায়তা দেওয়া এবং মধ্যম বা দীর্ঘ মেয়াদী সমাধান বের করা।

বিবৃতিতে বলা হয়, গত দুই বছর ধরে উদ্বাস্তু রোহিঙ্গাদের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিতের জন্য বাংলাদেশ সরকার এবং জাতিসংঘের সংস্থাগুলোকে সহায়তা করে আসছে স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক এনজিওগুলো। তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় রোহিঙ্গা শিবিরের পরিস্থিতি স্থিতিশীল রয়েছে, বর্ষার প্রস্তুতি জোরদার করা হয়েছে ও রোগের প্রাদুর্ভাব প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এতোটুকু যথেষ্ট নয়। আরও অনেক কিছু করা দরকার বলে মনে করে মানবাধিকার সংগঠনগুলো।

তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও তহবিল বরাদ্দের আহ্বান জানিয়েছে, যাতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে শরণার্থী, স্থানীয় বাসিন্দা ও অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুতদের জীবনমান উন্নয়ন করা সম্ভব হয়।

তবে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে ফেরত না যেতে প্ররোচণা দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের থাকার জন্য অনেকেই প্ররোচণা চালাচ্ছেন। লিফলেট বিতরণ করছেন এবং ইংরেজিতে প্ল্যাকার্ড লিখে দিচ্ছেন।

তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে থাকার জন্য যারা প্ররোচণা দিচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ওডি/এআর

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড