• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

কাশ্মীর ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থান! 

  আয়াজ উর রাহমান

০৮ আগস্ট ২০১৯, ১৫:৩৯
কাশ্মীর ইস্যুতে বাংলাদেশ
কাশ্মীর ইস্যুতে বাংলাদেশে বিক্ষোভ (ছবি : সম্পাদিত)

কাশ্মীর ইস্যুতে ইতোমধ্যেই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে দক্ষিণ এশিয়ার পারমাণবিক ক্ষমতাধর দুই রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে। চুপ নেই এই দুই রাষ্ট্রের পার্শ্ববর্তী আরেক ক্ষমতাধর চীন। আর এই উত্তেজনার মধ্যে অনেকটা নীরব ভূমিকাতেই রয়েছে ভারত ও চীনের বন্ধু প্রতিম বাংলাদেশ।

গত ৫ আগস্ট ভারতের সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপ করে কাশ্মীরের ‘বিশেষ মর্যাদা’ বাতিল করা হয়। একই সঙ্গে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়। ভারতের এই সিদ্ধান্তে তীব্র প্রতিবাদ জানায় পাকিস্তান। ভারতের হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকারের এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে কাশ্মীরের জনগণের অধিকার রক্ষায় সব ধরনের পদক্ষেপ নেবে বলে জানায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান।

এদিকে কাশ্মীরের জনগণের অধিকার রক্ষার প্রতিবাদে ভারতের অভ্যন্তরেও চলে প্রতিবাদ। বিরোধী দল কংগ্রেসসহ দেশটির বাম ও ছাত্র সংগঠন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করে।

কাশ্মীরকে বিশেষ সুবিধা প্রদানকারী সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদ করার জেরে ইসলামাবাদে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করেছে পাকিস্তান। একই সঙ্গে ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বন্ধের ঘোষণাও দিয়েছে দেশটি। ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের বহর কমিয়ে দেয়া হবে বলেও সরকারিভাবে জানানোর পর এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিয়েছে ইসলামাবাদ।

হিন্দুত্ববাদী মোদী সরকার আচমকা জম্মু-কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন কেড়ে নিলে এর তীব্র প্রতিবাদ জানায় পাকিস্তান, এমনকি রীতিমতো যুদ্ধের প্রস্তুতির কথাও জানিয়েছে তারা। এছাড়াও বিষয়টি জাতিসংঘে তোলা হবে বলেও ঘোষণা করেছে ইমরান খানের সরকার।

অন্যদিকে ভারত ও পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করেছে। এমনকি পাকিস্তানের বেলুচিস্তান নিয়েও হুঁশিয়ারি দিয়েছে ভারত।

এছাড়া ভারত ও চীনের মধ্যে দীর্ঘকালীন সীমান্ত বিরোধ রয়েছে। সোমবার ভারতের রাজ্যসভায় কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা অপসারণের পদক্ষেপের সঙ্গে লাদাখের স্বায়ত্তশাসন ও বিলুপ্ত হয়েছে, যা পারমাণবিক শক্তিধর চীনকে ভারতের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হতে উদ্বুদ্ধ করেছে। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে চীনা সেনারা বেশ কয়েক কিলোমিটার উত্তরে এই লাদাখের দিকেই অগ্রসর হয়েছিল, তখন প্রায় দু-সপ্তাহের মতো দু-দেশের মধ্যে স্থবিরতা দেখা গিয়েছিল।

আর চাঞ্চল্যকর এই পরিস্থিতির মধ্যেই ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ্ পাকিস্তান অধিকৃত আজাদ কাশ্মীর ও চীনের আকসাই অঞ্চলকেও ভারতের ভূমি বলে দাবি করে। আর এতে এশিয়ার অর্থনৈতিক ক্ষমতাধর চীন ও ক্ষেপে উঠে। ভারতের বিরুদ্ধে একে একে নানা নিষেধাজ্ঞাও জারি করে দেশটি।

উত্তেজনাকর এই পরিস্থিতির মধ্যে ভারতকে সমর্থন জানায় মুসলিম প্রধান দুই রাষ্ট্র আরব আমিরাত ও সৌদি আরব। ভারতের পক্ষে সমর্থন জানায় যুক্তরাষ্ট্রও। অন্যদিকে পাকিস্তানের পক্ষে সমর্থন জানায় মুসলিম প্রধান মালয়েশিয়া ও তুরস্ক। এছাড়া এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী রাষ্ট্র চীনও সমর্থন জানায় পাকিস্তানকে।

কাশ্মীর ইস্যুকে ঘিরে দক্ষিণ এশিয়ার চির প্রতিদ্বন্দ্বী দুই রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান ইতোমধ্যেই যে অনেকটা যুদ্ধের অবস্থানে যেতে চলেছে তা অনেকটাই পরিষ্কার। এশিয়ার ক্ষমতাধর এই দুই রাষ্ট্র নিজেদের বন্ধু রাষ্ট্রগুলোকে এক করতে তৎপর হয়ে উঠেছে।

কাশ্মীর উত্তেজনার মধ্যে চুপ নেই বাংলাদেশও। কাশ্মীরের জনগণের অধিকার রক্ষায় প্রতিবাদের ঝড় তুলে বাংলাদেশের বিভিন্ন বাম দল ও ছাত্র সংগঠনগুলো। বাংলাদেশ ইসলামী আন্দোলনও কাশ্মীরের জনগণের স্বাধীনতা রক্ষার প্রতিবাদে বিক্ষোভ করে। এছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও কাশ্মীরের জনগণের স্বাধীনতার দাবিতে প্রতিবাদ জানায়।

তবে কাশ্মীর উত্তেজনায় বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কোনো প্রকার আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি। এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ ইস্যু বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

তবে বাংলাদেশ সরকার ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা রদে জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল ও রাজ্যটি বিভাজন ঘিরে সৃষ্ট চলমান সঙ্কট গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বলেও জানিয়েছেন সরকারের দায়িত্বশীল এই মন্ত্রী।

অন্যদিকে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধলে বাংলাদেশ ভারতের পক্ষেই থাকবে।

এর আগে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি অনুষ্ঠানে এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ রয়েছে। সবখানে ভারত আমাদের সহযোগিতা করে। ভারত যখন আক্রান্ত হবে, তখন নিশ্চয়ই আমরা ভারতের সঙ্গে থাকব।’

চলমান অবস্থায় বাংলাদেশের কোনো প্রস্তুতি রয়েছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের বর্ডার নেই। ১ হাজার ২০০ মাইল দূরে তাদের অবস্থান। তাদের হুংকার, হাঁকডাকে আমাদের কিছু আসে-যায় না। আমরা তাদের ১৯৭১ সালে পরাস্ত করে বিদায় করে দিয়েছি। তাদের কথা চিন্তাও করতে চাই না, স্মরণও করতে চাই না।’

তবে বাংলাদেশের সংবিধানে বলা আছে, ‘জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সমতার প্রতি শ্রদ্ধা, অন্যান্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং আন্তর্জাতিক আইনের ও জাতিসংঘের সনদে বর্ণিত নীতিসমূহের প্রতি শ্রদ্ধা-এই সকল নীতি হইবে রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি এবং এই সকল নীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র।’

অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালনা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে, কারও সঙ্গে যুদ্ধ নয়, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব সম্পর্ক বজায় রেখেই চলে বাংলাদেশ। কাজেই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার চাঞ্চল্যকর পরিস্থিতির মধ্যে বাংলাদেশের নীরব ভূমিকাই স্বাভাবিক বিষয়।

অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারত ও চীন এই দুই দেশের সঙ্গেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখছে বাংলাদেশ সরকার। পাশাপাশি এই দুই রাষ্ট্রের সঙ্গে অর্থনৈতিকভাবেও গভীর সম্পর্ক রাখছে বাংলাদেশ। আর কাশ্মীর সংকটে যেহেতু পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের সমর্থন রয়েছে অন্যদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত তাই বাংলাদেশের এমন ইস্যুতে নীরব ভূমিকায় থাকাটাই স্বাভাবিক।

কাশ্মীর ইস্যুতে বাংলাদেশের নীরব থাকাটাই যৌক্তিক বলে মনে করছেন দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাস বিষয়ক গবেষক আলতাফ পারভেজ। তিনি বলেন, কাশ্মীর প্রসঙ্গ নিয়ে এই মুহূর্তে বাংলাদেশ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাবে বলে মনে করি না। বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে এমনিতেই বিশ্বপরিসরে ঝামেলায় আছে। আর তাই কাশ্মীর নিয়ে বাংলাদেশ নীরব ভূমিকাতেই থাকবে বলে মনে করি।

তবে কাশ্মীর ইস্যুতে অবশ্যই বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন রাজনীতি ও ইতিহাস বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. সলিমুল্লাহ খান৷ ডয়চে ভেলেকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ প্রতিক্রিয়া দেখাবে৷ এরইমধ্যে নানা মাধ্যমে তারা প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে, কিন্তু সরকারের প্রতিক্রিয়া দেখানোর সাহস নেই৷ বাংলাদেশই কাশ্মীর সমস্যা সমাধানের পথ দেখিয়েছে, বাংলাদেশই মডেল কিন্তু সেই মডেল বাংলাদেশ নিজেই এখন উপস্থাপন করতে পারবে না।’

তিনি বলেন, ‘কাশ্মীরের ব্যাপারে বাংলাদেশের মানুষের প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি হিন্দু মুসলমানের প্রশ্ন বা পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশ্নে মূখ্য নয়, মূখ্য স্বাধীনতার প্রশ্নে৷ পার্বত্য চট্টগ্রামের বিষয়টি সুন্দর সমাধানের মডেল৷ বাংলাদেশের মানুষ যেমন পাকিস্তানের অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে তেমনি তারা ভারতের অন্যায়ও মেনে নেবে না৷ কারণ এদেশের মানুষ স্বাধীনচেতা এবং অন্যায়ের প্রতিবাদকারী৷ মনে রাখতে হবে সরকার আর জনগণ এক নয়৷ সরকার চুপ থাকলেও সাধারণ মানুষ প্রতিক্রিয়া দেখাবেই।’

বাংলাদেশের মানুষ কাশ্মীরের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারকে ব্যাপকভাবে সমর্থন করে বলে ডয়চে ভেলেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মত দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এম শহীদুজ্জামান৷ কাশ্মীর ইস্যুতে সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া আছে জানিয়ে তিনি বলেন, এখন বাংলাদেশের উদ্বেগের বিষয় হতে পারে উত্তর-পূর্ব ভারতের পরিস্থিতি কোন দিকে যায়৷ আসামে মুসলামানদের ভারতীয় নাগরিকত্ব বাতিলের যে প্রক্রিয়া চলছে তা যদি এখন মোদী সরকার আরো এগিয়ে নেয় তাহলে বাংলাদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে।’

তিনি বলেন, সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া ভারতের দিকে৷ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ কোনো ধর্মীয় বা আঞ্চলিক ক্ষেত্রে তার প্রভাব পড়বে না বলে মনে করি না৷ আর এই অঞ্চলে কাশ্মীরের কারণে এখন অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির আশঙ্কা আছে৷ সেটা হলে স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশে তার প্রভাব পড়বে।’

ওডি/এআর

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড