আয়াজ উর রাহমান
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কাছে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ তুলে দেশ থেকে ৩ কোটি ৭০ লাখ সংখ্যালঘু গুম হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন মানবাধিকার কর্মী ও হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক প্রিয়া সাহা। তার গুমের অভিযোগকে প্রত্যাখ্যান করলেও তৎকালীন পাকিস্তান আমল থেকেই সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত হয়ে হারিয়ে যাওয়ার বিষয়ে একমত ওই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত।
বৃহস্পতিবার সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এই হিসাব দেখান রানা দাশগুপ্ত। সংগঠনটির দাবি, ১৯৪৭ ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে পাকিস্তান সৃষ্টির পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালী জনগোষ্ঠীর মধ্যে ২৯.৭% ছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। যা পাকিস্তান পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, ১৯৫১ সালে নেমে আসে ২৩.১%- এ, ১৯৬১ সালে ১৯.৬%-এ।
বাংলাদেশে পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, ১৯৭৪ সালে ১৪.৬%-এ, ১৯৮১ সালে ১৩.৩%-এ, ১৯৯১ সালে ১১.৭%-এ, ২০০১ সালে ১০.৩%-এ আর ২০১১ সালে ৯.৭%-এ যার মধ্যে হিন্দু জনগোষ্ঠী ৮.৪%।
গত মাস আটেক আগে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিগত এক দশকে শেখ হাসিনা সরকারের আমলে হিন্দু জনসংখ্যা ৮.৪% থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০.৭%-এ।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. আবুল বারাকাতের গবেষণাগ্রন্থের তথ্যের বরাত দিয়ে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ বলছে, শুধুমাত্র কুখ্যাত কালাকানুন শক্র (অর্পিত) সম্পত্তি আইনের ছোবলে ১৯৬৪ থেকে ২০১৩-এ পাঁচ দশকের মধ্যে ১ কোটি ১৩ লক্ষ হিন্দু জনগোষ্ঠী হারিয়ে গেছে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৪ সালের মধ্যে সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানি আমলে অব্যাহত বঞ্চনা-বৈষম্য-নিগৃহণ-নিপীড়ন ছাড়াও ১৯৫০ ও ১৯৬৪ সালের একতরফা রাষ্ট্রীয় সাম্প্রদায়িক সহিংসতার কথা আমরা আজও ভুলি নাই।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৪ সালের প্রথম আদমশুমারিতে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর হার ছিল ১৪.৬ শতাংশ। ২০১১ সালে সেটি কমে আসে ৯.৬ শতাংশে। অর্থাৎ বাংলাদেশ আমলে ৩৭ বছরে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর হার কমেছে ৫ শতাংশ। আদমশুমারিতে অবশ্য সবসময়ই মুসলিম জনগোষ্ঠীর মোট সংখ্যা এবং আনুপাতিক হার দুটোই বেড়েছে।
বাংলাদেশ আমলে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর হার কমেছে ৫ শতাংশ। তবে বাংলাদেশে মুসলিম সম্প্রদায়রা আগে থেকেই সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং তাদের জন্মহারের সঙ্গে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্মহার বা বৃদ্ধির প্রবণতাকে তফাৎ হিসেবে মানতে যেমন নারাজ তেমনই এই বিষয়টাকে অস্বাভাবিকভাবে দেখার কোনো কারণ নেই বলে দাবি বিশেষজ্ঞদের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের চেয়ারপার্সন মোহাম্মদ মইনুল ইসলাম বলছেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হার কমলেও আকার কিন্তু কমছে না, বরং বাড়ছে।
আনুপাতিক হার কমার বিষয়ে তিনি বলেন, "সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সঙ্গে যদি মুসলিম সম্প্রদায়ের তুলনা করি তাহলে দেখা যাবে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে জন্মহার কিংবা সন্তান বেশি নেবার প্রবণতা বেশি। এটা বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক গবেষণাতেও দেখা গেছে যে মুসলমানদের মধ্যে জন্মহার বেশি। বাংলাদেশেও আমরা ছোট আকারে বিভিন্ন গবেষণায় এটা দেখেছি।"
তিনি বলছেন, একদিকে মুসলিম জনসংখ্যা অনেক বেশি। অন্যদিকে তাদের মধ্যে জন্মহারও বেশি। ফলে তাদের আকার যেমন দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি মোট জনসংখ্যায় আনুপাতিক হারেও এটা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আকার বাড়লেও আনুপাতিক হার কমছে।
তবে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বলছেন, স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী অবস্থান থেকে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন ও বৈষম্য অব্যাহত আছে। তবে এটিও অস্বীকারের উপায় নেই, বিগত দশ বছরে অর্থাৎ বর্তমান সরকারের আমলে ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘুদের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষায় বেশ খানিকটা অগ্রগতি ঘটেছে।
তিনি বলেছেন, ২০০১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক সদিচ্ছায় প্রণীত হলেও তার বাস্তবায়ন আজও থমকে আছে। তবে দ্রুততম সময়ে তা’ বাস্তবায়নে নির্বাচনি অঙ্গীকার আছে। রাষ্ট্রীয় মৌলনীতি হিসেবে সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ফিরে এসেছে ঠিক, তবে সাম্প্রদায়িক আবরণ ও আভরণ থেকে তা আজো মুক্ত হতে পারেনি। ধর্মীয় বঞ্চনা ও বৈষম্যের ক্ষেত্রে বেশ খানিকটা অগ্রগতি ও ঘটেছে। নিয়োগ-পদোন্নতিতে ধর্মীয় পরিচয় আর বেড়াজাল হয়ে থাকছে না।
তবে বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাওয়া সংখ্যালঘুরা কোথায় এমন প্রশ্নে দৈনিক অধিকারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রানা দাশগুপ্ত ভারতের দিকে ইঙ্গিত দেন। ভারতের বর্তমান বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী রয়েছে বলে দাবি করে। আর ওই বিষয়টিকেই ইঙ্গিত করেন রানা।
তিনি বলেন, ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারীদের সনাক্তের নির্দেশ দিয়েছে। খুঁজে বের করা শুরু হয়ে গেছে। আসামে ৪০ লক্ষকে খুঁজে পেয়েছে। তার মধ্যে ১৭ লক্ষ মুসলিম এবং ২৩ লক্ষ হিন্দু সম্প্রদায়ের।
সংখ্যালঘুদের নাগরিকত্ব দেবে ভারত বলে বিজেপি সরকার যে ঘোষণা দিয়েছেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, তারা অনুপ্রবেশকারীদের ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন টানছেন। আমরা এর তীব্র বিরোধিতা করছি।
তিনি আরও বলেন, গত নির্বাচনে তারা বলেছেন ২০১৪ সাল পর্যন্ত যারা গেছে তাদেরকে তারা শরণার্থী মর্যাদা দিয়ে নাগরিকত্ব দেবে। আমরা বলতে চাই যদি তারা এমনটি করে তবে বাংলাদেশে একটি সংখ্যালঘুও থাকবে না।
তবে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীসহ সাম্প্রতিক অনুপ্রবেশ ঘটনার এসব বিষয়কে আঞ্চলিক অর্থনীতির প্রভাব ও ভূ-রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে বাম রাজনৈতিক দল জাতীয় গণতান্ত্রিক গণমঞ্চের সভাপতি মাসুদ খান দৈনিক অধিকারকে বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। আর মার্কিন-চীন বাণিজ্যিক যুদ্ধ প্রতিযোগিতার মধ্যে এ দেশে এক ধরনের অনুপ্রবেশ ঘটানোর চাপ সৃষ্টি করে নিজস্ব স্বার্থ হাসিলের অপচেষ্টাই চালানো হচ্ছে। এসব বিষয়ে আমাদের সতর্ক হতে হবে।
ওডি/এআর
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড